বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন

সরকারপ্রধান পদে অনন্য নজির স্থাপন শেখ হাসিনার

প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে অনন্য নজির স্থাপন করে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। গতকাল সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে শপথগ্রহণ করেন তিনি। আর এর মাধ্যমে এদিন তিনি টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর শপথ নিলেন। এর আগে ১৯৯৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত প্রথম দফায় প্রধানমন্ত্রীর পদে ছিলেন শেখ হাসিনা। নিজের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে তিনি এরই মধ্যে চার মেয়াদে ২০ বছর সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

চলতি সপ্তাহে এক প্রতিবেদনে বার্তা সংস্থা রয়টার্স বলেছে, সর্বশেষ নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একসময় গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের অগ্রসারির এই সৈনিক বিরোধীদের সঙ্গে যুগপৎভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে পরিবারের প্রায় সব সদস্যসহ নিহত হন তিনি। ওই সময় ইউরোপে অবস্থানের কারণে সৌভাগ্যবশত সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা।

১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জন্মগ্রহণ করা শেখ হাসিনা তার পিতা-মাতার পাঁচ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে বড়। ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। শিক্ষার্থী থাকার সময়ই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন শেখ হাসিনা।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান এবং ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের যে অংশটি শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসারি ছিলেন, সেটির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা ছিল তার। ১৯৮১ সালের আগ পর্যন্ত মূলত এটিই ছিল শেখ হাসিনার প্রধান রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা। আর ১৯৭৫ সালের সেই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের পর ৬ বছর দিল্লিতে নির্বাসিত জীবন কাটানো শেখ হাসিনা দেশে ফেরেন ১৯৮১ সালে; সেই বছরই তিনি দায়িত্ব গ্রহণ করেন আওয়ামী লীগের। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা প্রথম ১৯৮৬ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৯১ সাল, ১৯৯৬ সাল, ২০০১ সাল, ২০০৮ সাল, ২০১৪ সাল ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।

১৯৯৬ সালের ১২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে প্রথমবার বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সেবার জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে দলটি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার ২১ বছর পর সেই নির্বাচনের মধ্যদিয়ে প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নেন শেখ হাসিনা।

এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা নিজের রাজনৈতিক জীবনে ওই সময়ই দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন। আর এরপর থেকে এ পর্যন্ত যে তিনটি নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই জয়ী হয়েছেন শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগ। রয়টার্স বলছে, ১৭ কোটি লোকের দরিদ্র দেশ বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং দেশের রপ্তানি-নির্ভর পোশাক শিল্পকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনাকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়ে থাকে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা যখন দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেন, তখন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল পাঁচের কাছাকাছি, ১০ বছরের মধ্যে সেই প্রবৃদ্ধি পৌঁছায় প্রায় ৮-এ। অল্প সময়ের মধ্যে জিডিপি প্রবৃদ্ধি দশের ঘরে নেওয়ার প্রচেষ্টা থাকলেও করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অস্থিতিশীলতার কারণে সেটি বাধাগ্রস্ত হয়।

অবশ্য শেখ হাসিনা ছাড়াও বিশ্বের আরও অনেক নেতাই তাদের নিজ নিজ দেশে দীর্ঘদিন ধরে ক্ষমতাসীন আছেন। একই সঙ্গে তারা নিশ্চিত করে চলেছেন মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। গত বছরের মাঝামাঝিতে বিশ্বব্যাপী দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতাসীন নেতাদের নিয়ে রিপোর্ট প্রকাশ করে অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক স্বাধীন, নির্দলীয় ও আন্তর্জাতিক নীতিবিষয়ক থিংক ট্যাংক লোই ইনস্টিটিউট।

সেখানে আরো অনেক নেতার কথা তুলে ধরা হয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ কম্বোডিয়ায় দীর্ঘসময় ধরে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হুন সেন। গত বছরের মাঝামাঝিতে পদত্যাগ করা ৭০ বছর বয়সি হুন সেন কম্বোডিয়ার ক্ষমতায় ছিলেন ৩৮ বছর। গত বছরের মাঝামাঝিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভূমিধস জয়লাভ করে হুন সেনের রাজনৈতিক দল কম্বোডিয়ান পিপলস পার্টি (সিপিপি)। পরে নিজের বড় ছেলের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পদত্যাগ করেন ১৯৮৫ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা এই নেতা। অবশ্য অসাধারণভাবে ৩৮ বছর ধরে ক্ষমতার শীর্ষে থাকার পরেও হুন সেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় দীর্ঘসময় ধরে ক্ষমতাসীন শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি নন। প্রকৃতপক্ষে সারা বিশ্ব থেকে দেখলে দীর্ঘমেয়াদি শাসকদের তালিকায় তিনি স্থান পেয়েছেন শীর্ষ পাঁচে।

ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ রয়েছেন সবার ওপরে। তিনি ১৯৬৭ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছেন। সরকার প্রধান এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের মধ্যে পার্থক্যের কারণে এই ধরনের তুলনা মাঝে মাঝে কিছুটা গভীর তাৎপর্যময় বলে মনে হতে পারে। তবে অন্য অনেক দেশের মতো ব্রুনাইতে এই ভূমিকাগুলো একে-অপরের সাথে জড়িত।

ব্রুনাইয়ের সুলতান হাসানাল বলকিয়াহ বর্তমানে দেশটির প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা, অর্থ ও অর্থনীতি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১২ সাল থেকে দেশটির ক্ষমতায় রয়েছেন। গত বছর তার শাসন বেশ দৃঢ়ভাবেই তৃতীয় মেয়াদে প্রসারিত হয়। আর ‘তার সীমাহীন অংশীদার ও বন্ধু’ ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার শাসন ক্ষমতায় কখনো প্রেসিডেন্ট এবং কখনোও প্রধানমন্ত্রী- আছেন ২০০০ সাল থেকে।

মূলত দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে ক্ষমতায় আছেন ভ্লাদিমির পুতিন। আর চলতি বছরের মার্চে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তিনি আরো ছয় বছরের মেয়াদের জন্য জয়ী হবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ৭১ বছর বয়সি পুতিনের জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। রাষ্ট্রযন্ত্র ও রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যমের নিরঙ্কুশ সমর্থন এবং প্রায় প্রধান কোনো বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষহীন নির্বাচনে তার জয়ী হওয়াটা একরকম নিশ্চিতই।

লোই ইনস্টিটিউট বলেছে, বিশ্বব্যাপী দ্বিতীয় দীর্ঘতম শাসক হলেন তেওডোরো ওবিয়াং এনগুয়েমা এমবাসোগো। তিনি নিরক্ষীয় গিনির প্রেসিডেন্ট। সামরিক বাহিনীর সাবেক জেনারেল ওবিয়াং ১৯৭৯ সালে একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন এবং পরে জাল ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেন।

তার মতো আফ্রিকান কিছু দেশের শাসকরাও ক্ষমতায় আছেন দীর্ঘদিন ধরে। এর মধ্যে ১৯৮২ সাল থেকে ক্যামেরুনের ক্ষমতায় রয়েছেন পল বিয়া, ১৯৮৬ সাল থেকে উগান্ডার ক্ষমতায় আছেন ইওওয়েরি মুসেভেনি এবং ডেনিস সাসু এনগুয়েসো আফ্রিকার কঙ্গো প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন ১৯৯৭ সাল থেকে। আর তার আগে ১৯৭৯ সাল থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত একই দায়েত্বে ছিলেন তিনি।

ইরিত্রিয়ার ইসাইয়াস আফওয়ারকি ১৯৯১ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে দেশটি শাসন করে চলেছেন। আর রুয়ান্ডার পল কাগামে ১৯৯৪ সাল দেশটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্বপালন করছেন।

সেই একই বছর আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কোও পূর্ব ইউরোপের দেশ বেলারুশের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আর এখনো তিনি তার সেই দায়িত্ব চালিয়ে যাচ্ছেন। এছাড়া তাজিকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইমোমালি রহমান ১৯৯২ সাল থেকে ৩২ বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন এবং তার পর তার পুত্রের ক্ষমতা গ্রহণের পথও তৈরি করে রেখেছেন তিনি। এই তালিকায় আরো আছেন ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আলী খামেনি। ১৯৮৯ সাল থেকে পশ্চিম এশিয়ার এই দেশটির সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। যদিও সেই অর্থে তাকে রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান হিসেবে তালিকাভুক্ত করা যায় না।