ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নানামুখী ট্রলের মুখে নতুন শিক্ষাক্রম

আস্থার অভাবে ব্যর্থ হবে সব আয়োজন

* শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়বে : শিক্ষাবিদ * শিক্ষাক্রম নতুন শতকের জীবিকার সঙ্গে সম্পর্কিত
আস্থার অভাবে ব্যর্থ হবে সব আয়োজন

নতুন বছরে নতুন পাঠবই বিতরণ করা হচ্ছে। তবে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে মিথ্যাচার, গুজব, অপপ্রচার ও আজগুবি প্রোপাগান্ডা ছড়ানো বন্ধ হয়নি। উল্টো পক্ষ-বিপক্ষ তৈরি হয়েছে। এক শ্রেণির মানুষ নতুন শিক্ষাক্রমকে স্বাগতম জানালেও অনেকে আবার বিরোধিতা করছেন। জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষার্থীদের পারস্পরিক সহযোগিতা বাড়লেও তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা নষ্ট হবে, পড়াশোনার আগ্রহ কমবে। কিন্তু বাস্তবে ঠিক উল্টো ঘটছে। শ্রেণিকক্ষে এবং শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার আনন্দময় পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখতে চাওয়ার আগ্রহও বাড়ছে। মুখস্থনির্ভরতার পরিবর্তে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিখনকে অগ্রাধিকার দেবে। রেজাল্ট কার্ডে নম্বর বা গ্রেডের পরিবর্তে শিক্ষার্থীর পারদর্শিতার বিস্তারিত বিবরণের সুযোগ থাকছে।

শিক্ষাবিদরা বলেছেন, কোনো কার্যক্রম চালু কিংবা বন্ধের ব্যাপারে বরাবরেই সমালোচনা ও মতপার্থক্য থাকছে, সেই মতপার্থক্য দূর করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নজর বাড়ানো প্রয়োজন। শিক্ষক, শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকের মধ্যে নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে যেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে না থাকেন। সবাইকে আস্থায় নিতে না পারলে এত আয়োজন ব্যর্থ হয়ে যাবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের ইস্যুতে তুমুল বিতর্ক চলছে, যা নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাপের মধ্যে পড়ছে। আন্দোলনকারী অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের দিকে নজর রাখতে শিক্ষকদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। জানা গেছে, নতুন শিক্ষাক্রমের কাঁটাছেড়া করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার ও ইউটিউবে ভিডিও তৈরি করা হচ্ছে। নতুন পাঠ প্রক্রিয়ায় শিক্ষকদের ব্যাঙের লাফ ও হাঁসের ডাকের মতো ভিডিও ছড়িয়ে নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনা করা হচ্ছে। তবে নানামুখী ট্রলের মুখে ‘অপপ্রচার ঠেকাতে’ আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে সতর্ক করে সরকারি কর্তৃপক্ষকে বিজ্ঞপ্তি দিতে হয়েছে।

তবে শিক্ষাক্রম বাতিলের আন্দোলনে থাকা সংগঠকরা বলছেন, স্কুলে সন্তানের শিক্ষাজীবন রক্ষার স্বার্থে আন্দোলন করতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন। প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রমে পড়েছে শিক্ষার্থীরা। নতুন শিক্ষাবর্ষে দ্বিতীয়, তৃতীয়, অষ্টম ও নবম শ্রেণি শিক্ষাক্রমের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে। নতুন শিক্ষাক্রমে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা না রাখা, এসএসসির আগে পাবলিক পরীক্ষা না নেওয়া, নবম-দশম শ্রেণিতে বিভাগভিত্তিক বিভাজন তুলে দেওয়াসহ একগুচ্ছ পরিবর্তন আনা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের চাপ কমাতে শিক্ষাবর্ষজুড়ে শিখনকালীন মূল্যায়নের বিষয় রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, পরীক্ষা ও মুখস্ত নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে এসে অভিজ্ঞতাভিত্তিক শেখার মাধ্যমে নতুন শিক্ষাক্রমে পাঠ প্রক্রিয়া হয়েছে আনন্দময়। নতুন শিক্ষাক্রমের সমালোচনাকারীরা দাবি করছেন, শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘ধ্বংস করে দেওয়ার’ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার চাপ কমিয়ে নতুন প্রজন্মকে পাঠবিমুখ করে ‘গুরুত্বহীন বিষয়ে’ ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবিতে ‘সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন’র ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধনের মতো কর্মসূচি পালন করছেন একদল অভিভাবক। এছাড়া বিভিন্ন সংগঠন বিচ্ছিন্নভাবে শিক্ষাক্রম বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে।

নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে ‘অপপ্রচার’ করায় মামলা করে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি)। পরে চারজনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এনসিটিবি সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, স্বার্থান্বেষী একটি গোষ্ঠী শিক্ষাক্রম নিয়ে মিথ্যা তথ্য ও ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনমনে বিরূপ মনোভাব সৃষ্টির চেষ্টা করছে। শিক্ষাক্রমের সমালোচনা করে ছড়ানো ভিডিওকে ‘মিথ্যা প্রচার’ হিসেবে বর্ণনা করে এনসিটিবি বলেছে, এ রকম অপপ্রচার করলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন হলে শিক্ষার্থীরা কোচিং ও নোট-গাইড নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসবে বলে দাবি করে আসছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ বাস্তবতাকে সামনে এনে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি শিক্ষাক্রমের বিরোধিতার সঙ্গে ‘নোট-গাইড এবং কোচিং ব্যবসায়ীদের’ যোগসূত্র থাকার অভিযোগ করে আসছেন। এর সঙ্গে ডান-বাম রাজনীতিও জড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন তিনি। নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্বে রয়েছে সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলন। অপপ্রচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়া চারজন এই আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

সম্মিলিত শিক্ষা আন্দোলনের আহ্বায়ক রাখাল রাহার বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হচ্ছে, এতে তাদের সঙ্গে কোনো গোষ্ঠীর যোগসূত্র নেই। শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতেই তারা লড়ছেন। এর সঙ্গে গাইড-বই ব্যবসায়ী বা কোচিং ব্যবসায়ীরা জড়িত নন। তিনি আরো বলেন, কোনো শিক্ষাক্রমই শতভাগ পরিবর্তন করার কথা বলা হয় না, কিন্তু এখানে সবকিছুই ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। টিচিং-লার্নিং, মূল্যায়ন, পাবলিক পরীক্ষা সবকিছুই একেবারে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোনো স্মার্ট দেশও এতটা সাহস করে না।

বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সহ-সভাপতি শ্যামল পাল বলেছেন, নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গে লাখ লাখ শিক্ষার্থী জড়িত, সেখানে ৫০ থেকে ৬০ জন প্রকাশক কি করবেন? প্রকাশকদের তো অন্য ব্যবসা আছে, নোট-গাইড বের করা তাদের প্রধান ব্যবসা নয়।

নরসিংদীর হাড়িসাঙ্গান উচ্চ বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির মেধাতালিকায় প্রথম অবস্থানে থাকা ঝিমু আক্তার জানাল, নতুন শিক্ষাক্রমে শ্রেণিকক্ষেই তার সব পড়া হয়ে যাচ্ছে। আগের চেয়ে পড়ালেখা এখন একদম আলাদা। বাসায় চাপ নেই। বন্ধুদের সঙ্গে গ্রুপ করে কাজ ভালো লাগছে। আলাদা শিক্ষক, গাইড বইয়ের প্রয়োজন হচ্ছে না। ঢাকার মালিবাগের ফয়জুর রহমান আইডিয়াল স্কুলের সপ্তম শ্রেণির এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আব্দুল করিম বলেছেন, আগে বছরে তিন থেকে চার মাস বাসায় শিক্ষক রেখে মেয়েকে পড়াতে হতো। এখন হাতে-কলমে শিখছে। এ বছর আর আলাদা করে পড়াতে হয়নি। বাসায় নানা ধরনের খাতায় আঁকছে, ভালোই মনে হচ্ছে। রাজধানীর নালন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সুমনা বিশ্বাস বলছেন, নতুন শিক্ষাক্রমে তাদের কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। শিক্ষার্থীরা আনন্দে স্কুলে আসছে, পড়ছে। নতুন শিক্ষাক্রম-বিরোধী আন্দোলনের উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দিহান বিশেষজ্ঞরা। এর সঙ্গে কোচিং বাণিজ্য জড়িত বলেও মনে করেন গণস্বাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধুরী। তার ভাষ্য, মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্তরা এটা নিয়ে কথা বলছেন। গ্রামের মায়েরা তো কথা বলছেন না। আমি ভিডিওগুলো দেখেছি, এই অভিভাবকরা কোচিংয়ের সাথে জড়িত। ৩২ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য যেখানে, সেখানে লাভের কিছু অংশ ব্যয় করে যদি আন্দোলন করা যায়- সেটা তো ভালো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক তারিক আহসান বলেন, নতুন শিক্ষাক্রমের যে সব বিষয় নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, তার ৯৮ শতাংশই বানানো। এর সঙ্গে শিক্ষাক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই। খণ্ডিতভাবে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।

জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্য তারিক আহসান বলেন, ট্রেনিংগুলো নিয়ে যে ট্রল করা হচ্ছে, এগুলোর কোনোটিই নতুন শিক্ষাক্রমের কোনো বিষয় নয়। হাঁসের মতো যে ট্রেনিংটার কথা বলা হচ্ছে, সেটা গণিত অলিম্পিয়াডের। ব্যাঙেরটা স্কাউটিংয়ের ট্রেনিংয়ের অংশ। আর সাইকেলেরটা আসামের এক শিক্ষকের। তারা মনে যদি শিক্ষার্থীরা আধুনিক প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষায় শিক্ষিত হয় তাহলে তাদের মগজধোলাই দিতে পারবে না। তাদের দিয়ে খারাপ কাজ করানো যাবে না। অনেক ক্ষেত্রে তারা ঘরেই প্রতিরোধের শিকার হবে। সেজন্যই নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে তাদের ভয়, শঙ্কা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত