উন্নয়নকাজে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যবহার করা নিয়ে তৈরি হয়েছে ধূম্রজাল। কোন কৌশলে, কীভাবে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার হবে, তা এখনও নির্ণয় হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুপারিশে, অর্থ ব্যবহারে ইতিবাচক তেমন কোনো বার্তা মেলেনি। বরং উন্নয়ন কাজে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগকে সতর্ক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। অন্যদিক, রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ব্যাংকের কাছে ধরনা দিয়েছে ব্যক্তি খাতের একটি প্রতিষ্ঠান। সবদিক মিলিয়ে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার আদৌ সম্ভব কি না, সে বিষয়ে এখনও কার্যকর কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেনি সরকার।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সরাসরি সরকার বা অন্য কোনো গ্রুপকে দেওয়া যাবে না বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। আলোকিত বাংলাদেশকে তিনি বলেন, রিজার্ভের অর্থ আমদানি-রপ্তানি ব্যয়সহ নির্দিষ্ট কিছু কাজে ব্যবহার করা হয়। এটা সরাসরি বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি করে। যদি আইনের আওতায় পড়ে, ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশন অ্যাক্ট মেনে বাংলাদেশ ব্যাংক এটা ব্যবহারের জন্য পুনঃঅর্থায়ন স্কিম করতে পারে। অন্যান্য দেশে কোন উপায়ে রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেটাও পর্যালোচনা করতে পারে। স্মরণকালের সর্বোচ্চ উচ্চতায় বিদেশি মুদ্রার মজুত, যার আকার ৪০ বিলিয়ন ডলার। এই অর্থ দিয়ে মেটানো যাবে ১০ মাসের আমদানি ব্যয়। অথচ আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী, তিন মাসের মজুত থাকাই যথেষ্ট। রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধি এবং আমদানি কমে যাওয়াতেই রিজার্ভের এ উল্লম্ফন। উদ্বৃত্ত এ বিদেশি মুদ্রার মজুত উন্নয়নকাজে ব্যবহার করতে চায় সরকার। গত ৬ জুলাই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ঋণ নেওয়া কিংবা এ অর্থ উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যবহার করা যায় কি না, সেটির পরীক্ষা-নিরীক্ষার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ অর্থ ব্যবহার করলে অর্থনৈতিক কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে, সেটি বিশ্লেষণ করে এরই মধ্যে রিপোর্ট দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, অর্থ ব্যবহারের ক্ষেত্রে গ্যারান্টার হতে হবে সরকারকে। পাশাপাশি বিদেশি মুদ্রায় অর্থ ফেরত দিতে হবে। সার্বভৌম কোম্পানি খুলে অর্থ ব্যবহার করে, রিজার্ভ থেকে বিদেশি মুদ্রা কিনতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্পষ্ট করে বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার, ১৯৭২ অনুসারে প্রকল্পে রিজার্ভ
ব্যবহারের সুযোগ নেই। কিন্তু এরই মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান রিজার্ভ থেকে অর্থ চেয়ে বাণিজ্যিক একটি ব্যাংকে আবেদন করেছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিনিয়োগের জন্য এ অর্থ চাওয়া হয়েছে। তবে, ব্যাংক এখনও এ বিষয়ে স্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারেনি। বড় প্রশ্ন হয়ে সামনে এসেছে, রিজার্ভের অর্থ ব্যক্তি খাতের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হলে, তা সঠিক সময়ে পাওয়া যাবে কি না।
পৃথিবীর ধনী দেশগুলোয় ব্যবহার হয়েছে রিজার্ভের অর্থ। তবে, এতে বড় সাফল্য নেই। জানা যায়, বিশ্বের যেসব দেশ রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করেছে, তাদের প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন। অর্থাৎ, স্থানীয় মুদ্রায় রূপান্তর না করে, পৃথক কোম্পানি খুলে অর্থ ব্যবহার করা হয়। বিশেষ করে বিদেশি কেনাকাটার দায় মেটানোর কাজে এ অর্থ ব্যবহার হয় বেশি। যেখানে শর্ত ছিল, যে কোনো সময় এ অর্থ ফিরিয়ে দিতে হবে। রিজার্ভ ব্যবহার করেছে চীন, জাপান, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং, সিঙ্গাপুর। সেক্ষেত্রে দেখা যায়, সিঙ্গাপুর রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করেছে পৃথক কোম্পানির মাধ্যমে। যার নাম সিঙ্গাপুর বিনিয়োগ করপোরেশন (জিআইসি)। জেআইসি হলো ওই দেশের সরকারের প্রধান বিনিয়োগকারী এজেন্ট।
তবে, বিশাল রিজার্ভ নিয়ে অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বিদেশিদের আস্থার নির্দেশক। তবে শুধু রিজার্ভ বেশি হলেই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বলার সুযোগ নেই। বেশি রিজার্ভ থাকলে অর্থনৈতিক খাতে বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মোকাবিলা করা যায়। এজন্য প্রায় সব দেশই রিজার্ভের পরিমাণ বেশি রাখতে চায়। তারা জানান, করোনা সংকটকালীন এ সময়ে রিজার্ভ ধরে রাখাই নিরাপদ কৌশল। এখন কত মাসের রিজার্ভ রাখা হবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। সংকটের সময় তিন মাস নাকি ছয় মাসের মজুদ প্রয়োজন, তাও খতিয়ে দেখা দরকার।
এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ বা সিপিডির রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাইলেই যে অবকাঠামোগত কাজে ব্যবহার করা যাবে, সেটা নয়। অনেক দেশের রিজার্ভের পরিমাণ আরও বেশি কিন্তু তারা অবকাঠামো কাজে ব্যবহার করছে এমন নয়। এর বড় কারণ হলো, যে পরিমাণ রিজার্ভ এখনও আছে, সেটা আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য যথেষ্ট না। রিজার্ভের অর্থ ব্যবহার করতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন, আইনি প্রস্তুতি লাগবে। এ তহবিল পরিচালনা করার মতো দক্ষতা ও কাঠামো আছে কি না, সেটাও বিবেচনায় নিতে হবে। ফলে খুব দ্রুত এটাকে ব্যবহার করা যাবে না। এ ধরনের তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে সরকারি অন্যান্য কোষাগারের টাকা যেভাবে ব্যবহার করা হয়, সেভাবে ব্যবহার করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ ও বিশ্ববাজারের অর্থনীতি এক ধরনের অনিশ্চতায় ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে রিজার্ভ থেকে অর্থ ব্যবহারে সতর্ক হওয়া উচিত। বন্ড মার্কেটকে শক্তিশালী করে সেখান থেকে অর্থ নেওয়া যেতে পারে। রিজার্ভ ব্যবহারের জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক দক্ষতাসহ যে সময় ব্যয় হবে, তার চেয়ে বন্ড মার্কেট উন্নত করতে পারলে অনেক বেশি লাভ হবে।