দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

ভোট আয়োজনে সফল সমাপ্তি : স্বস্তিতে ইসি

প্রকাশ : ১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী এমপি-মন্ত্রীদের শপথগ্রহণের মধ্যে দিয়ে সফলভাবে সমাপ্ত হলো নির্বাচনের আগে-পরের সব কার্যক্রম। তপশিল ঘোষণার পর থেকে শুরু করে সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণ ও গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত সবকিছুই বিতর্ক ছাড়াই শেষ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ফলে এখন স্বস্তিতে রয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। সূত্র জানায়, গত ৭ জানুয়ারির ভোট সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে বলে জানিয়েছে দেশি-বিদেশি পর্যবেক্ষকরা। এছাড়া নির্বাচনকে ঘিরে বড় ধরনের রক্তক্ষয়ী কোনো সহিংস ঘটনা ঘটেনি। হতাহতের সংখ্যাও অনেক কম। ফলে তুলনামূলক একটি ভালো ইমেজ গড়ে তুলতে পেরেছে ইসি। এখন সারা দেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করার কথা চিন্তা করছে ইসি।

ইসি কর্মকর্তারা জানান, তপশিলের আগে থেকে ইভিএম না ব্যালটে ভোট হবে তা নিয়ে আলোচনা চলছিল। কোনো কোনো রাজনৈতিক দল ইভিএমে ভোটগ্রহণে অনীহা প্রকাশ করে। নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার জন্য শেষ পর্যন্ত ব্যালটে আস্থা রাখে ইসি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কি না তা নিয়েও চিন্তায় ছিল ইসি। তবে শেষ পর্যন্ত ৪৪টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে ২৮ দল অংশগ্রহণ করে। এছাড়া রেকর্ড সংখ্যক সতন্ত্র প্রার্থী ভোটে অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হয়েছেন।

গত ১৫ নভেম্বর সন্ধ্যায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করেন সিইসি। ঘোষিত তপশিল অনুযায়ী, নির্বাচনের জন্য মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার শেষ তারিখ ছিল গত ৩০ নভেম্বর। মনোনয়নপত্র বাছাই হয় ১ থেকে ৪ ডিসেম্বর। এছাড়া প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ ছিল ১৭ ডিসেম্বর। আর প্রতীক বরাদ্দ দেয়া হয় গত ১৮ ডিসেম্বর। ভোটগ্রহণ হয় ৭ জানুয়ারি।

৩০০ আসনের মধ্যে নওগাঁ-২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর মৃত্যুতে এ আসনে ভোটগ্রহণ স্থগিত করে ইসি। বাকি ২৯৯ আসনে ভোটগ্রহণ হয়। এবারের নির্বাচনে ২৮টি রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থী মিলিয়ে ১ হাজার ৯৭০ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

ইসির দেয়া তথ্য অনুযায়ী, নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ছিল ১১ কোটি ৯৬ লাখ ৮৯ হাজার ২৮৯ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৬ কোটি ৭৬ লাখ ৯ হাজার ৭৪১, নারী ৫ কোটি ৮৯ লাখ ১৮ হাজার ৬৯৯ ও তৃতীয় লিঙ্গের ৮৪৯ জন। চূড়ান্ত ভোট কেন্দ্রের সংখ্যা ৪২ হাজার ১৪৮টি। সেই সঙ্গে চূড়ান্ত ভোটকক্ষ রয়েছে ২ লাখ ৬১ হাজার ৫৬৪টি। নির্বাচনে ২৮টি দলের মনোনীত প্রার্থী ১ হাজার ৫৩৪ জন আর স্বতন্ত্র ৪৩৬ জন ছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ২২২, জাতীয় পার্টি ১১, ওয়ার্কার্স পার্টি ১, জাসদ ১, কল্যাণ পার্টি ১ এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬২ আসনে বিজয়ী হয়েছেন।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়েছে। মোট ভোটার ১১ কোটি ৯৫ লাখ ১ হাজার ৫৮৫ জন। তাদের মধ্যে ৪ কোটি ৯৯ লাখ ৫৫ হাজার ৪৪৫ জন ভোটার ভোট দিয়েছেন। এর শতকরা হার ৪১ দশমিক ৮ ভাগ।

সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থাসহ (ওআইসি) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বেশ কয়েকটি দেশের পর্যবেক্ষকরা। আমন্ত্রিত এসব বিদেশি পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনের পরিবেশের প্রশংসা করেছেন। এছাড়া দেশীয় পর্যবেক্ষক সংস্থা প্রশংসা করেছে।

ভোটের পর গত বুধবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় লাভের পর প্রধামন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২৯৮ জন প্রার্থীর শপথগ্রহণের মধ্যে দিয়ে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের যাত্রা শুরু হয়।

গত বুধবার সকাল ১০টা শপথ অনুষ্ঠানের শুরুতেই স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী নিজে শপথ নেন। পরে আওয়ামী লীগের ২২২ জন সংসদ সদস্যকে শপথবাক্য পাঠ করান তিনি। বেলা ১১টায় শপথ পড়ান ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যকে। পরে জাপার ১১ জন সদস্যকে।

অন্যদিকে সংসদ নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী আওয়ামী লীগ সরকারের নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ নিয়েছেন গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায়। নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ মোট ৩৭ সদস্যের মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সকল প্রক্রিয়া সফলভাবে শেষ হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগে থেকে নতুন সরকারে নিয়োগ পাওয়া মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীদের গাড়ি প্রবেশ করতে দেখা যায় বঙ্গভবনে। নিয়ম অনুযায়ী প্রথমে প্রধানমন্ত্রী, পরে পর্যায়ক্রমে মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীরা শপথ নেন। এই শপথ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে বঙ্গভবনে প্রায় ১ হাজার ৪০০ অতিথিকে দাওয়াত করা হয়। এদিন প্রধানমন্ত্রীসহ ২৫ জন পূর্ণ মন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী শপথ নেন।

মন্ত্রীরা যেসব দপ্তর পেয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়)।

আ ক ম মোজাম্মেল হক (গাজীপুর-১) মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়; ওবায়দুল কাদের (নোয়াখালী-৫) সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়; আবুল হাসান মাহমুদ আলী (দিনাজপুর-৪) অর্থ মন্ত্রণালয়; আনিসুল হক (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪) আইন মন্ত্রণালয়। নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন (নরসিংদী-৪) শিল্প মন্ত্রণালয়; আসাদুজ্জামান খান কামাল (ঢাকা-১২) স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; মো. তাজুল ইসলাম (কুমিল্লা-৯), স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়; মুহাম্মদ ফারুক খান (গোপালগঞ্জ-১) বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়; মোহাম্মদ হাছান মাহমুদ (চট্টগ্রাম-৭) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়; ডা. দীপু মনি (চাঁদপুর-৩) সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়। সাধন চন্দ্র মজুমদার (নওগাঁ-১) খাদ্য মন্ত্রণালয়; আব্দুস সালাম (ময়মনসিংহ-৯) পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়; মো. ফরিদুল হক খান (জামালপুর-২) ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয়; র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী (ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩), গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়; নারায়ণ চন্দ্র চন্দ (খুলনা-৫), ভূমি মন্ত্রণালয়; জাহাঙ্গীর কবির নানক (ঢাকা-১৩), বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়; মো. আব্দুর রহমান (ফরিদপুর-১), মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়; মো. আব্দুস শহীদ (মৌলভীবাজার-৪) কৃষি মন্ত্রণালয়; স্থপতি ইয়াফেস ওসমান (টেকনোক্র্যাট) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়; ডা. সামন্ত লাল সেন (টেকনোক্র্যাট) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়; মো. জিল্লুল হাকিম (রাজবাড়ী-২) রেলপথ মন্ত্রণালয়; ফরহাদ হোসেন (মেহেরপুর-১) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়; নাজমুল হাসান পাপন (কিশোরগঞ্জ-৬) যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়; সাবের হোসেন চৌধুরী (ঢাকা-৯) পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়; মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (চট্টগ্রাম-৯) শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

প্রতিমন্ত্রীরা হলেন : বেগম সিমিন হোমেন রিমি (গাজীপুর-৪) মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়; নসরুল হামিদ (ঢাকা-৩) বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী; জুনাইদ আহমেদ পলক (নাটোর-৩) ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ; মোহাম্মদ আলী আরাফাত (ঢাকা-১৭) তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়; মো. মহিববুর রহমান (পটুয়াখালী-৪) দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়; খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (দিনাজপুর-২) নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়; জাহিদ ফারুক (বরিশাল-৫) পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়; কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা (খাগড়াছড়ি) পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়; বেগম রুমানা আলী (গাজীপুর-৩) প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়; শফিকুর রহমান চৌধুরী (সিলেট-২) প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়; আহসানুল ইসলাম টিটু (টাঙ্গাইল-৬) বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। মন্ত্রিসভা গঠনের পর আগামীকাল প্রথম কর্মদিবস শুরু হচ্ছে। নতুন মন্ত্রীদের পদচারণায় সরব হয়ে উঠবে সচিবালয়। নতুন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের মধ্য দিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের সফল সমাপ্তি টানার মধ্যদিয়ে ইসির প্রতি দেশের মানুষের আস্থা আরো বাড়বে।