ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আন্দোলনে ব্যর্থ হতাশ বিএনপি

অস্তিত্ব সংকটের আশঙ্কা
আন্দোলনে ব্যর্থ হতাশ বিএনপি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষে নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছে। আজ থেকে মন্ত্রীরা আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের দাপ্তরিক কাজ কর্ম শুরু করবেন। আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনা করতে পারবে এমন সুযোগ বাংলাদেশে সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না বলে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল। তবে নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা করার পর থেকে মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ করা পর্যন্ত কোনো পর্যায়ে বিএনপি বাধাদান করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের বক্তব্য হচ্ছে, সীমিত পরিসরে কয়েকটি আগুন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে মানুষের মধ্যে ভীতি সৃষ্টি করতে গিয়েও বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচন বর্জন করে নির্বাচন প্রতিহত করার জন্য বিএনপি কম চেষ্টা করেনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর থেকে বিএনপি নির্বাচন বানচালের জন্য শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের পাশপাশি অগ্নি সন্ত্রাসের পথ বেছে নেয়। তারা বাস, ট্রাক ও ট্রেনে আগুন দেয়। হরতাল-অবরোধ ডাকে। নির্বাচন প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে তারা গণসংযোগ করে। তবে বিএনপির কোনো আন্দোলনই নির্বাচন প্রক্রিয়া ব্যাহত করতে পারেনি।

পশ্চিমা দেশগুলো বিএনপির দাবির প্রতি একাত্মাতা প্রকাশ করে বাংলাদেশে নির্বাচন বন্ধ করে দেবে এমন চিন্তা চেতনাও অবশেষে নস্যাৎ হয়ে গেল। বিএনপির ধারণা ছিল নির্বাচন হবে না, নির্বাচন হলেও সরকার গঠন করা সম্ভব হবে না। আর সরকার গঠন করা হলেও নতুন সরকার দায়িত্ব পালন করতে পারবে না। বিদেশি শক্তি বাংলাদেশকে সেই সুযোগ দেবে না। বাস্তবে তার কোনোটার প্রতিফলন দেখা যায়নি।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করে, বিএনপির বিদেশ নির্ভরতাই দলটিকে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। বিএনপির হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে মানুষের কোনো সাড়া ছিল না। ভোটও বর্জন করার পর যে কোনো মূল্যে দ্বাদশ নির্বাচন প্রতিহতের ঘোষণা দিয়েছিল দলটি। সেই লক্ষ্যে আন্দোলনের বিভিন্ন কর্মসূচিও ঘোষণা করে। তাদের সেইসব আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে যাওয়ায় দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মাঝে চরম হতাশা বিরাজ করছে।

বিএনপির কয়েকজন মধ্যম সারির নেতা জানান, আমরা দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে আছি। সরকার পতনের আন্দোলন করে কাঙ্ক্ষিত সফলতা না আসায় হতাশ না হওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই। আমাদের সবার বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। আমরা ঘরে থাকতে পারি না। আমাদের অধিকাংশের ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে আবারও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা চতুর্থ দফার সরকার ক্ষমতায় আসল। কাজেই হতাশ প্রকাশ করা ছাড়া আর কোনো পথ নেই। তবে, আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে দলে বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। তবে তারা বলেন, আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এসেছে সেটা বড় কথা নয়, যতদিন এই সরকারের বিদায় না হবে ততদিন আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে। সফল হয়েই আমরা ঘরে ফিরব। ৭ জানুয়ারির নির্বাচন দেশের জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে এমন মন্তব্য করে বিএনপির নেতারা নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এই দাবির পক্ষে বিএনপি এরইমধ্যে দুই দিনের গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেছে।

দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের পর বিএনপি এখনো নতুন কোনো কর্মসূচি দেয়নি। আবার বিদেশি কোনো হস্তক্ষেপ নেই এমন পরিস্থিতিতে দলটির অনেক নেতাকর্মীই হতাশা ব্যক্ত করেছে। কেউ কেউ বলছে, এতো সহজে সরকার পার পেয়ে যাবে চিন্তাও করিনি। সার্বিক প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এই সরকারকে বিদায় করা কঠিন হবে। তবে, জনগণ ভোট বর্জন করেছে এটাই বিএনপির সফলতা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, রাজনীতিতে সফলতা ও ব্যর্থতা থাকবে এটাই স্বাভাবিক। জনগণকে উপেক্ষা করে যারা জোর করে ক্ষমতায় থাকে তাদের পতন অনিবার্য। তবে, বর্তমান প্রেক্ষাপটে দলের অনেকেই হতাশ। কারণ- দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে একাধিক মামলা। অনেকে ঘর ছাড়া। এমন পরিস্থিতিতে অনেকে নিঃস্ব হয়ে গেছে। এমতাবস্থায় আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় আসায় অনেকে হতাশ। ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশ প- হয়ে যাওয়ায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। একদিকে আন্দোলনের হার্ডলাইনে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রোষানলে পড়েছে দলটি। অপরদিকে ২৮ তারিখের আগে সর্বস্তরের বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে যে মনোবল তৈরি হয়েছিল তা অনেকাংশেই ভেঙে গেছে। বিচ্ছিন্নভাবে বিএনপি নেতাকর্মীরা রাস্তায় নামলেও তাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়। প্রায় এক বছর দেশব্যাপী শান্তিপূর্ণ আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয় বিএনপি। এ পরিস্থিতিতে ২৮ অক্টোবর রাজধানীতে সারা দেশ থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ও সমর্থক জড়ো করে মহাসমাবেশ সফল করে আন্দোলনকে শেষ ধাপে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েছিল তারা। ওইদিনই রাজধানীতে রাজনৈতিক শক্তির মহড়া দিয়ে কঠোর লাগাতার কর্মসূচি ঘোষণা করার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কর্মসূচি শুরুর এক ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ায় তাদের মহাসমাবেশ পণ্ড হয়ে যায়। ২৮ অক্টোবর দলের কিছু নেতাকর্মীর আচরণ ছিল বিএনপির শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালনের বিপরীতমুখী। দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জোরালো চেষ্টা করা হয়নি। তাই ২৮ অক্টোবর থেকেই বিএনপির আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। এ কারণে মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পরদিন ২৯ অক্টোবর দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালন করে বিএনপি। এরপর থেকে হরতাল-অবরোধসহ নানা কর্মসূচি পালন করতে থাকে দলটি। সবশেষ নির্বাচনের পর দুই দিনের গণসংযোগ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মঈন খান বলেছেন, দেশের মানুষ এ সরকারের পরিবর্তন চায়। সুতরাং জনগণের কাছে জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত বিএনপি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে যাবে। আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকারকে জবাবদিহির আওতায় আনতে চায় বিএনপি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির নেতৃত্বাধীন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক গণতন্ত্র মঞ্চের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা বলেন, ‘আমরা বিএনপিকে মহাসমাবেশ নিয়ে সতর্ক করেছিলাম। বলেছিলাম, সরকার কর্মসূচি পণ্ড করে দিয়ে একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। কিন্তু তাদের কেউ কেউ বলেছেন, জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশ পণ্ড করে দিয়ে সেটি বিএনপির দিকে ঠেলে দিতে পারে। তবে হয়েছে তার উল্টো।’ অবশ্য বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, ‘বিএনপি শুরু থেকেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছে। আর সরকার শুরু থেকেই আমাদের ওপর হামলা, মামলা, সহিংসতা করে আসছে। মহাসমাবেশ পণ্ড ও সিনিয়র নেতাদের গ্রেপ্তার করে তারা নিজেরা নিজেরা একটা নির্বাচন করেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির এক নেতা বলেন, সরকার যে একটা ফাঁদ তৈরি করেছিল, সেদিকে লক্ষ্য রাখেনি বিএনপি। না বুঝে বিএনপি সরকারের সে ফাঁদে পা দিয়েছে। শুধু বিদেশনির্ভরতা না করে আরও বিকল্প উপায় রাখা উচিত ছিল কি না সেটা নিয়েও ভাবতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে অবশ্যই বিএনপিকে ঘুরে দাঁড়াতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বড় ধরনের সংকটে পড়বে। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ভোট বর্জন করে বিএনপি। ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশ নিলেও ভোটে কারচুপির অভিযোগ তোলে দলটি। ২০১৪ সালের মতো ২০২৪ সালের ভোটও বর্জন করেছে বিএনপি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত