ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নৌযান চলাচলে নির্দেশনা উপেক্ষা

বাড়ছে দুর্ঘটনা মরছে মানুষ

পাটুরিয়ায় ফেরিডুবির ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন
বাড়ছে দুর্ঘটনা মরছে মানুষ

নদীপথে নৌযান চলাচলের দিকনির্দেশনা মানছে না বাল্কহেডের মালিক ও চালকরা। এতে নৌপথ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। রাতে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনাসহ বেশিরভাগ নদীতে বাল্কহেড কোনোরকম মাথা জাগিয়ে মিটমিট আলোতে চলাচল করছে। যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সন্ধ্যার পর বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু সেই নিদের্শনা উপেক্ষা করে নৌপুলিশ, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ এবং বিআইডব্লিউটিসির কিছু অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বাল্কহেড রাতের বেলা চলাচল করছে। জানা গেছে, সারা দেশে সাড়ে চার হাজারের কাছাকাছি বাল্কহেডের নিবন্ধিত দিয়েছে সরকার। কিন্তু বর্তমানে নদীতে চলছে প্রায় সাড়ে ১২ হাজারের মতো বাল্কহেড। এসব বাল্কহেড রাতে চলাচল বন্ধ থাকার নির্দেশনা দেওয়া হলেও সেটি মানছে না। উল্টো অবৈধ বালু ব্যবসায়ীরা জোরপূর্বক কিংবা আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে বাল্কহেড চালাচ্ছে। ফলে তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা, পদ্মা, যমুনাসহ বিভিন্ন নৌরুটে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। অদক্ষ চালক আর ফিটনেসবিহীন বাল্কহেডে একের পর এক ঘটছে দুর্ঘটনা মরছে মানুষ।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নদীপথে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে নৌপুলিশসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। কিন্তু কোনো সংস্থা নৌযান নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি। বিআইডব্লিউটিসি, বিআইডব্লিউটিএ, নৌপুলিশ এবং মালিকদের অবহেলায় নৌপথ এখনো নিরাপদ হয়নি। বিভিন্ন সময়ে রাতে নামেমাত্র মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। গতকাল বুধবার মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় যানবাহনসহ ৫ নম্বর ঘাটে রজনীগন্ধা ইউটিলিটি ফেরি ডুবে যায়। এ ঘটনায় একটি কাভার্ড ভ্যান ও ৩২ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে।

জানা গেছে, গত মঙ্গলবার রাজবাড়ীর দৌলতদিয়া ঘাট থেকে ফেরিটি ছেড়ে যায়। কিন্তু ঘন কুয়াশার কারণে ৫ নম্বর ঘাটের কাছাকাছি নদীতে নোঙর করা ছিল ফেরিটি। এতে ছোট-বড় ৯টি ট্রাক ছিল। ফেরিতে ৯টি ট্রাকের চালক তাদের সহকারী এবং ফেরির স্টাফ মিলিয়ে মোট যাত্রী ছিলেন ৩৩ জন। তাদের মধ্যে ২৬ জনকে স্থানীয়রা উদ্ধার করেন। অন্য ৬ জনকে ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা উদ্ধার করেন। খবরটি লেখা পর্যন্ত ফেরির দ্বিতীয় ইঞ্জিনচালক হুমায়ুন (৩৯) নিখোঁজ ছিলেন।

ফেরিতে থাকা কুষ্টিয়ার ট্রাক ড্রাইভার মো. আশিক জানান, ‘হঠাৎ করেই ফেরি কাত হয়ে গেছে। এতে সবার হৈই-হুল্লার মাঝেই আমি নদীতে ঝাঁপ দেই। কিছুদূর ভেসে যাবার পর একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা আমাকে উদ্ধার করে।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্পোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-মহাব্যবস্থাপক শাহ মো. খালেদ নেওয়াজ বলেন, রাত একটার সময় তীব্র কুয়াশায় কিছু দেখা যাচ্ছিল না। সেজন্য রজনীগন্ধা নামের ছোট ফেরিটি ৫ নম্বর ঘাটের কাছে নোঙর করে ছিল। ফেরিটিকে বালুবাহী একটি বাল্কহেড ধাক্কা দেয়। এ সময় ফেরিটি ডুবে যায়।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স সদর দপ্তরের সহকারী পরিচালক আনোয়ারুল হক বলেন, দুর্ঘটনাকবলিত ফেরি উদ্ধারে উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ও রুস্তম কাজ করেছে। অন্যদিকে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক রেহেনা আকতার জানান, ফেরি দুর্ঘটনার বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

গত বছরের জুনে চাঁদপুরের মতলব উত্তরে পদ্মা ও মেঘনা নদীতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ৫০টি বাল্কহেড জব্দ করা হয়েছিল। জব্দ নৌযানে থাকা শ্রমিকদের আটক করে নৌপুলিশ। চাঁদপুরের সেই অভিযান ছিল অবৈধ বালু ব্যবসার বিরুদ্ধে। আদালত শক্ত অবস্থান নেওয়ার পর শুরু হয়েছিল অভিযান। কিন্তু পরবর্তীতে সেই অভিযান আর বেশিদিন স্থায়ী হয়নি।

গত বছরের আগস্টে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ে বাল্কহেডের ধাক্কায় পিকনিকের যাত্রীবাহী ট্রলারডুবির ঘটনায় ৮ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছিল। এর আগে জুলাই কেরানীগঞ্জের তেলঘাট থেকে সদরঘাটের কাছে শ্যামবাজারের লালকুঠি এলাকায় বাল্কহেডের ধাক্কায় অর্ধশত যাত্রী নিয়ে বুড়িগঙ্গায় ডুবে যায় ওয়াটার বাস। এতে মারা যান ৩ জন। সর্বশেষ গত ১৬ ডিসেম্বরে মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ী উপজেলায় পদ্মার শাখা নদীতে বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী একটি ট্রলার ডুবে যায়। এ ঘটনায় দুই শিশুর লাশ উদ্ধার করে স্থানীয় লোকজন। বছরের পর বছর বাল্কহেডের ধাক্কায় যাত্রীবাহী নৌযান ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কিংবা ডুবে যাচ্ছে।

নৌপরিবহন অধিদপ্তরের সূত্র বলেছে, সারা দেশে ২০২২ সালে ৩৬টি নৌযান দুর্ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ বাল্কহেডের ধাক্কায় হয়েছে। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নামের সংগঠনের তথ্য বলছে, গত বছরে সাত মাসে প্রায় ৫০টি নৌ-দুর্ঘটনা ঘটেছে। ওই সময়ের মধ্যে ৫৮ জন নিহত হয়েছেন এবং নিখোঁজ ১২ জন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সাবেক পরিচালক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, দেশের সবচেয়ে নিরাপদ ও সাশ্রয়ী পথ হচ্ছে নৌপথ। কিন্তু সেই নৌপথে অদক্ষ চালক ও অনিবন্ধিত নৌযান আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনে দিনে দুর্ঘটনা বাড়াচ্ছে। নৌপথকে গুরুত্ব দিতে হবে এবং আইন তৈরি করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ’র জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু ছালেহ মোঃ এহতেশামুল পারেভেজ আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, নদীপথে নৌযান চলাচলে দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সেই নির্দেশনা অনুযায়ী ঘাটের পল্টুন থেকে নৌযান ছাড়ছে। তবে নদীর মাঝপথে নৌযান কীভাবে চলছে সেটি বিআইডব্লিউটিএ মনিটরিং করতে পারে না।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত