জীবিকার টানে দূষিত শহরে আসছে মানুষ

* বছরে ৮০ হাজার মানুষ মারা যাচ্ছে। * বায়ুর মানের দিকে নজর নেই সরকারি সংস্থাগুলোর।

প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

প্রত্যেক বছরের মতো এবারও শুষ্ক মৌসুমে রাজধানীতে বায়ুদূষণের মাত্রা বেড়েছে। এতে মানুষের শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমাসহ শ্বাসতন্ত্রের বিভিন্ন রোগ বেড়েছে। দিনে দিনে মানুষের চিকিৎসার ব্যয় বাড়ছে। অথচ বায়ুদূষণের চিহ্নিত উৎসগুলো নিয়ন্ত্রণে কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকারি কোনো সংস্থা। ফলে দূষিত বাতাসের মধ্যে বসবাস করছে নগরের কোটি বাসিন্দা। তবে শীতের দিনে ঢাকার বাতাসে কুয়াশা আর ধুলো মিলেমিশে একাকার। কিছু স্থানে ধূলিকণায় পথচলা কঠিন হয়ে পড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, শুষ্ক মৌসুমে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশন এলাকায় সড়কের ধোঁলার জন্য গাড়িতে করে পানি ছিঁটানো হয়। কিন্তু সেই পানির গাড়ি প্রয়োজনের তুলনায় কম। এছাড়া পানি সংকটে পড়ে এসব গাড়ি। কিন্তু পরিবেশ অধিদপ্তরের ভূমিকা নিয়েও জনমণে প্রশ্ন রয়েছে। বায়ুদূষণ রোধে সংস্থাগুলো উত্তরণে কাজ করছে বললেও দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই। পরিবেশ অধিদপ্তরও অনেকটা নির্বিকার। বাতাসে দূষণ কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)।

পরিবেশবিদরা মনে করেন, বায়ুদূষণ রোধে সরকারি কোনো সংস্থার নজর নেই। তবে রাজধানীর বাসিন্দাদের কাছে কীভাবে ইউটিলিটি সার্ভিস বাবদ অর্থ আদায় করবে, সেদিকে বেশি নজর সংস্থাগুলোর। বছরের পর বছর এভাবেই চলছে সরকারি সংস্থাগুলো। কারণ, এসব সংস্থার কোনো জবাবদিহিতা নেই। সংস্থার হর্তাকর্তা ইচ্ছে করলেই- ইউটিলিটি সার্ভিসের বিল বাড়িয়ে দিচ্ছে, যা সাধারণ মানুষের ওপর চাপ তৈরি করছে। এভাবে চলতে থাকলে রাজধানীর বায়ুদূষণ কখনই নিয়ন্ত্রণে আসবে না। বায়ুদূষণ রোধে শুধু প্রকল্প নয়, উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে নজরদারিও প্রয়োজন।

জানা গেছে, দেশে বায়ুদূষণের তালিকায় ঢাকার পরের অবস্থানেই থাকছে চট্টগ্রাম। ঢাকায় যেসব কারণে সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ তা হচ্ছে- বহুতল ভবন নির্মাণ, যত্রতত্র যখন-তখন সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি, যানবাহনসহ কলকারখানার ধোঁয়া। একই অবস্থা ব্যস্ততম বন্দরনগরী চট্টগ্রামে। দূষিত শহরের তালিকায় থাকলেও জীবিকার টানে মানুষ এই দুই শহরেই আসছেন।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশের বায়ুদূষণে হুমকিতে জনস্বাস্থ্য। এই শহরের মানুষকে বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচাতে চাইলে রোডম্যাপ তৈরি করে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে সরকারকে। দীর্ঘস্থায়ী দূষিত বায়ুর প্রভাবে বয়স্কদের ফুসফুস ও শাসতন্ত্রে ক্ষতির পাশাপাশি দূষিত বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, আরপিএম (রেসপিরেবল পার্টিকুলেট ম্যাটার), এসপিএম (সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার)-এ ভাসমান কণার পরিমাণ বেশি থাকায় শিশুর সংবেদনশীল শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতির ঝুঁকি খুব বেড়ে যায়। শিশুদের ফুসফুসে সারফেকট্যান্ট নামের তরল পদার্থ থাকে দূষিত বায়ু ফুসফুসের এই তরল পদার্থ নষ্ট করে ফেলে। এ ছাড়া শিশুদের ফুসফুস নাজুক হওয়ায় এবং প্রতিরোধক্ষমতা কম থাকায় সহজেই ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াসহ বিভিন্ন জীবাণু আক্রান্ত করে। দূষিত বায়ু দীর্ঘস্থায়ী মাথাব্যথা, ফুসফুসের ক্যান্সার, চোখ, হৃদযন্ত্র, কিডনি ও প্রজনন ক্ষমতার ক্ষতি করে।

রাজধানীর চারপাশে কয়েক সপ্তাহ ঘুরে দেখা গেছে, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থেকে মুন্সীগঞ্জে নৌপথে যাওয়ার পথে মেঘনা নদীর পাড় ঘেঁষে অসংখ্য অবৈধ ইটভাটা গড়ে উঠেছে। দিনে-রাতে এসব ইটভাটার চুল্লি দিয়ে ধোঁয়া উড়ছে। শুধু মেঘনা নদীতে নয়, গাবতলী থেকে সাভার যাওয়ার পথেও মূলসড়কের পাশেই ইটভাটা গড়ে উঠেছে। মেঘনা নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা সিমেন্ট কারখানাগুলোও বায়ুদূষণের জন্য দায়ী। অন্যদিকে উত্তরা কামারপাড়া ও টঙ্গী এলাকায় গড়ে ওঠা কলকারখানাগুলোর কালো ধোঁয়া আকাশে মিশিয়ে যাচ্ছে।

মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা প্লাবন সরকার পুরানা পল্টনে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। গত শুক্রবার বাদে সপ্তাহের প্রতিদিনই মোহাম্মদপুর থেকে পল্টনে যাতাযাত করেন। গত শুক্রবার রাতে হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার। পরের দিন শনিবার ডাক্তারের কাছে যাওয়ার পর তার অ্যাজমা শনাক্ত হয়। এখন নিয়মিত দুই বেলা ওষুধ ও ইনহেলার নিতে হচ্ছে তাকে। প্লাবন সরকার বলেন, আগে অ্যাজমার লক্ষণ ছিল না, শ্বাসকষ্টও ছিল না। এখন ঢাকা শহরের প্রায় সব রাস্তার কাজ চলছে, প্রচুর ধুলা। দুটা মাস্ক পরেও ধুলা থেকে রক্ষা পাওয়া যাচ্ছে না। সেই কারণে শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। প্লাবনের মতো হাজার হাজার মানুষ রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে বসবাস করতে গিয়ে অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টে ভুগছেন। কারণ দুটি শহরেই বাতাসে সারাক্ষণ ক্ষতিকর ধূলিকণা ভাসে। এ কারণে এলাকার বাসিন্দারা মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দেখা যায়, দূষণ নিয়ন্ত্রণের জন্য কেবল জরিমানা করে দায়িত্ব শেষ করছে পরিবেশ অধিদপ্তর। অনেক প্রতিষ্ঠান একাধিকবার জরিমানা দিয়েও বারবার একই ভুলের পুনরাবৃত্তি করছে।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) চেয়ারম্যান আবু নাসের খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, কয়েক বছর ধরে পৃথিবীর দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম কিংবা দ্বিতীয় অবস্থানেই থাকছে ঢাকা। অথচ এদিকে নজর কম সরকারি সংস্থাগুলোর। ফলে ঢাকায় বায়ু আকারে দূষণের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। বায়ু দূষণের প্রধান প্রধান উৎসগুলো চিহ্নিত করে সেগুলোর উৎস কমানো বা বন্ধ করার ফলপ্রসূ উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের অ্যাজমা সেন্টারের সমন্বয়ক ডা. কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, শ্বাসতন্ত্রের রোগের সঙ্গে ধুলাবালির সরাসরি সম্পর্ক আছে। ধুলাবালির কারণে অ্যাজমা রোগীদের কষ্ট বেড়ে যায়। তাই বায়ুদূষণ কমানোর বিকল্প নেই।

পানিসম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. আইনুন নিশাত আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘নতুন সংবিধানের ১৮ (ক) ধারা অনুযায়ী প্রকৃতি, পরিবেশ, বনভূমি, জলাভূমি ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের কর্তব্য। অথচ যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন তারাই বায়ুদূষণের জন্য প্রধানত দায়ী। বায়ুদূষণ রোধে বাংলাদেশে কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাচ্ছি না।’

তিনি আরো বলেন, ‘রাজধানীসহ দেশের প্রতিটি জেলায় ইটের ভাটা রয়েছে। এসব ইটভাটার মালিক স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা। ইটভাটার কালো ধোঁয়া বায়ুদূষিত করছে। সেজন্য পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণ করতে হবে। অথচ ছোট ছোট ইটভাটার মালিকদের বাধায় পরিবেশবান্ধব ইটভাটা নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। সরকার বিশ্ব ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বড় বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে। অথচ বায়ুদূষণ রোধে কার্যকরী কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি।’

গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এক কর্মশালায় বক্তারা বলেছেন, বায়ুদূষণে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে দেশে বছরে ৮০ হাজার মানুষ মারা যায়। আর এই কারণে বছরে জিডিপির ক্ষতি হয় ৮ শতাংশ।

পরিবেশ, বন, ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ বলেন, বছরে সাড়ে ১৩ কোটি টান মাটি ইটভাটায় ব্যবহার হয়। এতে পরিবেশ ক্ষতির পাশাপাশি বর্জ্য পোড়ানোর কারণে ১৮ ভাগ এবং ইটভাটায় ১১ ভাগ এবং মেয়াদোত্তীর্ণ যানবাহনের ব্যবহারেও বায়ুদূষণ করে। বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যনবাহন পরীক্ষার জন্য বিআরটিএ’তে চারটি পরীক্ষাগার স্থান করা হয়েছে। পাশাপাশি উন্মুক্ত সোলনার কুকার স্থাপনের কাজ চলমান রয়েছে। এসব কাজ সম্পন্ন হলে অনেকাংশে বায়ুর মান উন্নীত হবে।