কিছুতেই থামছে না চালের দাম বস্তায় বেড়েছে ৩০০-৫০০ টাকা

প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আমিরুল ইসলাম অমর

চালের বাজারে চালবাজি কোনোভাবেই থামছে না। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চালের দাম। হঠাৎ করে দাম বাড়ার পর এখন আর কমার লক্ষণ নেই। রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশেই বেড়েছে চালের দাম। এবার গরিবের মোটা চালসহ সব ধরনের চালের দাম বেড়েছে। ফলে বিপাকে পড়েছে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষ। খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, পাইকারি বিক্রেতা ও মিল মালিকরা দাম বাড়িয়েছেন। আর পাইকারি বিক্রেতাদের দাবি মোকামে দাম বেড়েছে। মিলাররা সিন্ডিকেট করে চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন বলে অভিযোগ তাদের। বর্তমানে চালের দাম বাড়ার কোনো যৌক্তিক কারণ নেই বলেও জানান তারা। এদিকে, আড়তদাররা বলছেন, মিলাররা দাম বাড়িয়ে দিলে আড়তদারদের কিছুই করার থাকে না। মূলত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে স্থিতিশীল থাকলেও নির্বাচনের পর থেকেই চালের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। আর মিল মালিকদের দাবি, বাজারে ধানের যোগান কম। তাই বেড়েছে চালের দাম। ক্রেতাদের অভিযোগ- বাজারে চালের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে অতিরিক্ত দাম হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে, খোলাবাজারে চাল বিক্রি (ওএমএস) অব্যাহত রেখেছে খাদ্যঅধিদপ্তর। পাশাপাশি ডিলারদের মাধ্যমে নিম্ন-আয়ের মানুষের কাছে কম দামে চাল বিক্রি করছে ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এরপরও চালের দাম স্থিতিশীল থাকছে না। বেশিরভাগ মিলার চাল মজুত করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ঢাকার বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সপ্তাহের ব্যবধানে মান ও ধরন ভেদে চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৫ থেকে ৮ টাকা। বস্তাপ্রতি বেড়েছে প্রায় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। গতকাল শনিবার রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, শান্তিনগর, মালিবাগ, খিলগাঁও, রামপুরা, মিরপুর, হাতিরপুল, পলাশী বাজার, নিউমার্কেট, কারওয়ান বাজার ও সেগুনবাগিচা কাঁচাবাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এক সপ্তাহ আগে যে মোটা চালের কেজি (স্বর্ণা ও চায়না ইরি) ছিল ৫০-৫২ টাকা, তা এখন ৫৫-৫৮ টাকা। মাঝারি মানের চালের (পাইজাম ও বিআর ২৮) ছিল ৫৫-৫৮ টাকা, তা এখন ৬০-৬৫ টাকা। আর মিনিকেট ও নাজিরশাইল ছিল ৬২-৭৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬৮ থেকে ৮০ টাকা।

রাজু আহমেদ, থাকেন রাজধানীর রামপুরায়। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি বলেন, নির্বাচনের আগে চালের দাম অনেকটা স্থির ছিল। নির্বাচনের পর প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে চালের দাম। এভাবে চলতে পারে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের মত যারা সীমিত আয়ের মানুষ তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা বলছেন, বছরের শুরুতে বাজারে চালের সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছিল। তবে দাম বেশি বেড়েছে নির্বাচনের ঠিক পরপর। আমনের উৎপাদন ভালো হলেও রেকর্ড দামে ধান কিনতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতি আগে দেখা যায়নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চাল ব্যবসায়ী বলেন, মিলে ও বাজারে চালের ঘাটতি নেই। অথচ দাম বাড়ছে। উৎপাদন খরচ বাড়ছে, এটা ঠিক। তবে বর্তমান বাজারে কিছুটা অস্বাভাবিক হারে চালের দাম বাড়িয়েছেন মিলমালিকরা। বর্তমানে ধানের ভরা মৌসুম। এই সময়ে চালের দাম বাড়ানো সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করলে যারা দাম বাড়াচ্ছে, তাদের ধরা সম্ভব হবে।

ক্রেতাদের দাবি, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরকারকে দ্রুত বাজার তদারকি করতে হবে। এই তদারকি হতে হবে সরবরাহ ব্যবস্থার একেবারে গোড়া থেকে শুরু করে সব পর্যায়ে। গুদামজাত করে চালের সংকট সৃষ্টি করা সিন্ডিকেটকে ধরতে হবে। তবেই রেহাই মিলবে।

যাত্রাবাড়ী এলাকায় চাল কিনতে আসা মামুনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, বলা নেই, কওয়া নেই, হঠাৎ করেই জিনিসের দাম বেড়ে যায়। এমনিতেই সব জিনিসের দাম বেড়ে আকাশচুম্বি। তারমধ্যে আবার চালের দাম বাড়ল। এবার মানভেদে কেজিপ্রতি চালের দাম বেড়েছে ৫-৮ টাকা। এভাবে দাম বাড়তে থাকলে আমাদের না খেয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই।

মিরপুরের এক চালের দোকানে আব্দুর রাফি ইসলাম রন চাল কিনতে এসেছেন, এসে দেখেন বস্তাপ্রতি ৪০০-৫০০ টাকা বেড়েছে চালের দাম। এতে তিনি চাল না কিনেই চলে যেতে চান। কিন্তু উপায় কি? চাল না কিনলে খাবে কি? বাধ্য হয়েই বেশি দাম দিয়ে চাল কিনেন তিনি। তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, যেভাবে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে নিম্ন আয়ের মানুষের না খেয়ে থাকা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। এখনো সময় আছে সিন্ডিকেট ভেঙে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার। তা নাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে।

জানা গেছে, সম্প্রতি চালের মিলার পর্যায়ে বস্তাপ্রতি দাম বেড়েছে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকার মতো। এরপর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে মিলার পর্যায়ে অনেক আলোচনার পর বর্তমানে কমানো হয়েছে ৫০ থেকে ১০০ টাকা। তবে ভোক্তা পর্যায়ে এখনো বেশি দামেই কিনছে মানুষ। গতকাল শনিবার রাজধানীর উত্তর বাড্ডা এলাকার চালের পাইকারি আড়তে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযানে দেখা যায় এ চিত্র। পাইকারি দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পুরোনো দামে চাল কেনা থাকায় নতুন করে দাম কমলেও সেই দামে কেনা চাল তাদের হাতে এখনো আসেনি। এতে বাড়তি দামেই চাল বিক্রি করছেন তারা। দোকানিদের অভিযোগ, এভাবে মূল্যবৃদ্ধির ফলে তাদের নিজেদের ব্যবসায় ও হুমকির মুখে। এতে করে তাদের কেনাবেচাও কমেছে। রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় গতকাল বেলা ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে শুরু হওয়া অভিযানে তিনটি চালের দোকানে অভিযান চালানো হয়েছে। তবে অসঙ্গতি না থাকায় জরিমানা করা হয়নি কাউকে। এ নিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব ড. জয়নাল আবেদিন বলেন, মিলার পর্যায়ে দাম কমা শুরু হয়েছে। তবে খুচরা পর্যায়ে নতুন চাল না আসায় এখনো প্রভাব পড়েনি। আমরা মনে করছি মিলার ও খুচরা পর্যায়ে দুদিনের মাঝে প্রভাব পড়বে। আগের দামে চাল নামিয়ে আনা সম্ভব কি না জানতে চাইলে তিনি জানান, মন্ত্রণালয় থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। জেলা-উপজেলায় অভিযান পরিচালনা করছে মন্ত্রণালয়। ধানের দামও কিছুটা কমেছে। আশা করছি আমরা কমিয়ে আনতে পারব। আমরা সবার সঙ্গেই বৈঠক করছি। প্রয়োজনে আবারও বৈঠক করব। সব ধরনের পদক্ষেপ নেব। অভিযানের খবরে উত্তর বাড্ডা এলাকার অনেকগুলো দোকান বন্ধ করে দেয়। এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অভিযান দলের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তারা জানান, আমাদের অভিযান চলমান থাকবে। আগে জেনে গেছে বলে বন্ধ করেছে। তবে সামনের দিনগুলোতে না জানিয়েই অভিযান চালানো হবে।