বাসাবাড়িতে গ্যাস সংকট

মিটার ভাড়ার সঙ্গে ভ্যাটের যন্ত্রণা

প্রকাশ : ২২ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম (ঢাকা) ও তামীম রহমান (চট্টগ্রাম)

সারা দেশে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে সাধারণ মানুষ। এরই মধ্যে গ্যাসের প্রি-পেইড মিটারের ভাড়া বাড়িয়েছে গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান তিতাস। তবে প্রতিষ্ঠানটির দাবি, মিটারের ভাড়া বাড়ছে না, অন্যান্য গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে মিটার ভাড়া সমন্বয় করা হয়েছে।

জানা গেছে, নতুন বছরের শুরুতেই গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানিগুলো গ্রাহকপর্যায়ে মিটার ভাড়া বাবদ ২০০ টাকা নির্ধারণ করেছে। এসব মিটারের মেয়াদ ১০ বছর পর্যন্ত থাকবে। এ সময়ে ২৪ হাজার টাকা পর্যন্ত একটি মিটার থেকে ভাড়া তুলবে কোম্পানিগুলো। চট্টগ্রামের বিভিন্ন গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি মিটার ভাড়া ২০০ টাকা নিচ্ছে। সেখানে তিতাস গ্যাসের মিটার ভাড়া বাবদ ১০০ টাকা নেয়া হত। তবে চলতি মাস থেকে সব কোম্পানির মিটার ভাড়া একই হারে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মিটার ভাড়া এবং মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) আরোপে গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন গ্রাহকরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্যাসের বিলের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট যোগ হয়। ১ হাজার টাকা বিলে ৫০ টাকা ভ্যাট। গ্যাসের মিটার ভাড়া এবং ভ্যাটের চাপে পড়েছেন মানুষ।

কোম্পানিগুলোর গ্যাসের মিটারের ভাড়া সমন্বয়ের মধ্যেই মহেশখালীতে বঙ্গোপসাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আংশিকভাবে চালু হওয়ায় গত শনিবার বিকালে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। তবে গ্যাসের চাপ খুবই কম বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

এ বিষয়ে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) মহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) প্রকৌশলী আমিনুর রহমান বলেন, গত শুক্রবার রাতেই গ্যাসের সরবরাহ শুরু হয়েছে। গত শনিবার বিকালের মধ্যে গ্যাসের সরবরাহ পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়েছে। এর আগে গত বৃহস্পতিবার রাত ১১টার দিকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় চট্টগ্রামে। এতে রাতে বিষয়টি অনেকেই টের না পেলেও সকাল থেকে দুর্ভোগে পড়েন নগরবাসী। গত শনিবারও খাবার কিনতে বিভিন্ন এলাকার হোটেলে উপচেপড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে ফিলিং স্টেশনে গ্যাস না থাকায় নগরের রাস্তায় সিএনজিচালিত যানবাহন চলাচল কমে যায়। এ অজুহাতে নগরের গণপরিবহনগুলোতে বাড়তি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ করেছেন যাত্রীরা।

গত বৃহস্পতিবার গভীর রাত থেকে চট্টগ্রামে ভয়াবহ গ্যাস সংকটে জনদুর্ভোগ চরমে পৌঁছে। এতে শুক্রবার সকাল থেকে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। মহেশখালীর এলএনজি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ বন্ধ থাকায় চট্টগ্রামে বাসা-বাড়ির চুলাও জ্বলেনি। বাড়িতে রান্না না হওয়ায় অনেকে খাবার কিনতে হোটেল-রেস্টুরেন্টগুলোতে ভিড় করেন। নগরীর বাসাবাড়িতে গ্যাস না থাকায় চুলায় রান্না হয়নি। গ্যাস না থাকায় বিপাকে পড়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সাড়ে ৫ হাজার বন্দিও।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেলা সুপার (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ মঞ্জুর হেসেন জানান, চট্টগ্রাম কারাগারে শুক্রবার গ্যাস ছিল না। এতে ৫ হাজার কারাবন্দির খাবার রান্না নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়। গ্যাস না থাকায় বিকল্প উপায়ে লাকড়ির চুলা ব্যবহার করে রান্না করতে হয়। তবে শনিবার গ্যাস সরবরাহ হওয়ায় পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়েছে।

প্রকৌশলী আমিনুর রহমান বলেন, চট্টগ্রাম এলএনজি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। মহেশখালীর দুটি এলএনজি টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রামে গ্যাস সরবরাহ করা হয়। সিঙ্গাপুর থেকে সংস্কার হয়ে আসা একটি এলএনজি টার্মিনাল কমিশনিং করতে গিয়ে সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। গত শুক্রবার রাতে টার্মিনাল থেকে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ শুরু করা হয়। এরপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, শীতের মৌসুমে পাইপলাইনে গ্যাসের সংকট চলছে। তবে প্রি-পেইড মিটারে গ্রাহকদের সুবিধা হবে। কারণ, একজন গ্রাহক যতটুকু গ্যাস জ্বালাবেন তার ততটুকু বিল হবে মিটারে। প্রায় এক দশক আগে শুরু হলেও এখন পর্যন্ত প্রায় সাড়ে ৪ লাখ মিটার বসানো হয়েছে। গ্যাস বিতরণকারী সংস্থা তাদের প্রথাগত বিলিং ব্যবস্থার বদলে প্রি-পেইড মিটার চালু করার পর তাদের গ্যাসের জন্য খরচ ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ কমে গেছে। আর চলমান গ্যাস সংকট গরমের মৌসুমে সমাধান হবে। প্রি-পেইড মিটারবিহীন গ্রাহক মাসে গড়ে ৭০ ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, প্রি-পেইড মিটার ব্যবহারকারী গ্রাহক মাসে গড়ে মাত্র ৩০ ঘনফুট গ্যাস ব্যবহার করেন।

তিতাসের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে জানান, মিটারগুলো ১০ বছর টিকতে পারে। এখন গ্রাহকদের প্রতি মাসে এই মিটার ব্যবহারের জন্য ১০০ টাকা করে ভাড়া দিতে হচ্ছে। এই ভাড়া ২০০ টাকা করার পরিকল্পনা রয়েছে, যাতে মিটারের দাম ১০ বছরের মধ্যে তুলে আনতে পারে।

২০২৪ সালের মধ্যে সব আবাসিক গ্রাহককে প্রি-পেইড সিস্টেমের আওতায় আনার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিতাস আরও ১২ লাখ মিটার বসানোর জন্য দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।

চট্টগ্রামে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড গ্যাস সরবরাহ করছে। ৫ লাখ ৫০ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ৬০ হাজার মিটার বসিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি আরো ১ লাখ মিটার বসানোর উদ্যোগ নিয়েছে। জালালাবাদ গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম লিমিটেডও মিটার বসানোর জন্য একটি প্রকল্প চালু করেছে। বাংলাদেশ তৈল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) আওতায় রয়েছে তিন প্রতিষ্ঠান বাখরাবাদ গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড ও সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম বলেছেন, গ্রাহক চাইলে গ্যাসের মিটার কিনে বসানোর সুযোগ দেওয়া উচিত। বিইআরসি ২০১৫ সালের ট্যারিফ আইনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে গ্যাস মিটার প্রক্রিয়া চালুর নির্দেশ দেয়, কিন্তু তারা সেটি মেনে চলছেন না। এটি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শামসুল আলম আরো বলেন, গ্যাস বিতরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আইনের লঙ্ঘন করছে এবং এসব প্রতিষ্ঠানের জরিমানা হওয়া উচিত। কিন্তু বিইআরসি কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। গ্রাহকদের কীভাবে ঠকানো যায়, সেই প্রক্রিয়া চলছে।

গ্যাসের মিটার ভাড়া বাড়ানোর বিষয়ে তিতাসের প্রি-পেইড মিটারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। জানুয়ারি থেকে সব কোম্পানির গ্রাহকই মিটার ভাড়া ২০০ টাকা করে দেবে। তিনি আরো বলেন, প্রথমে প্রি-পেইড মিটার বসাতে মিটার ভাড়া ৬০ টাকা কাটা হয়েছে। এরপর ২০২৩ সালের জুনে তা বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়। সেটাই এবার সব কোম্পানির সঙ্গে মিলিয়ে সমন্বয় করা হয়েছে।

মিটার ভাড়া গ্রাহককে কতদিন দিতে হবে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, একটি মিটারের আয়ুষ্কাল ১০ বছর। প্রতি মাসে ২০০ টাকা নেওয়া হলে ১০ বছরে গ্রাহকের যাবে ২৪ হাজার টাকা।

জানা যায়, চট্টগ্রামের জালালাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানি গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রতি মাসে ২০০ টাকা আদায় করছে। এদিকে কর্ণফুলী গ্যাস বিতরণ কোম্পানি, তিতাস গ্যাস কোম্পানি আবার ১০০ টাকা করে আদায় করত। এই বৈষম্য দূর করতে জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে সবগুলো বিতরণ কোম্পানি তাদের মিটার ভাড়া ২০০ টাকায় সমন্বয় করেছে।

প্রসঙ্গত, শীতের কারণে অনেক এলাকায় গ্যাস সরবরাহ খুবই কমে গেছে। অনেকেই দিনের বেলা গ্যাস পাচ্ছেন না। রাতে গ্যাসের চাপ বাড়লেও ভোরে চলে যাচ্ছে। এ বিষয়টি সম্প্রতি বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও স্বীকার করেন। এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিমন্ত্রী চলমান সংকটে সাধারণ মানুষের কষ্টের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, এই সংকট কাটতে আরো কিছু দিন সময় প্রয়োজন হবে। মার্চের মধ্যে সংকট কেটে যাবে।

প্রতিমন্ত্রী আরো বলেন, দেশের দুটি এলএনজি টার্মিনালের মধ্যে একটি সংস্কারের জন্য দেশের বাইরে রয়েছে। এ কারণে শীতে চলমান গ্যাস সংকট আরো বেড়েছে। এলএনজি টার্মিনালটি সংস্কার শেষে দেশে না আসা পর্যন্ত গ্যাসের সরবরাহ বৃদ্ধি করা পেট্রোবাংলার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি বছর শীতে পাইপ লাইনের মধ্যে পানি জমার কারণে গ্যাসের সংকট সৃষ্টি হয়। একইভাবে তাপমাত্রা কমে যাওয়াতে গ্যাসের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এবার সেই সংকটের সঙ্গে সরবরাহের অপ্রতুলতা যোগ হওয়াতে গ্যাস সংকট বেড়েছে। শীতের সংকটের কারণে বাসাবাড়িতে চুলা জ্বলতে সমস্যা হচ্ছে। একইসঙ্গে শিল্পেও গ্যাসের সংকট দেখা দিয়েছে। এমন এক পরিস্থিতিতে মিটার ভাড়া বৃদ্ধি আসলেই গ্রাহকদের মূল ক্ষোভের কারণ।