দফায় দফায় বাড়ছে মাংসের দাম

রোজায় দাম বেঁধে দেয়ার পর সুযোগ নেবে ব্যবসায়ীরা

প্রকাশ : ২৪ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

এবারও পবিত্র রমজানের আগেই মাংসের দাম নির্ধারণের পরিকল্পনা করছে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশন। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে মাংস বিক্রিতে দামের হেরফের ঠেকাতে এ সিদ্ধান্ত নেবে। তবে এরইমধ্যে মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, গরুর মাংসের কোনো নির্ধারিত দাম থাকবে না। যার ফলে মাংসের বাজারে অসামঞ্জস্যপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হতে যাচ্ছে। বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এতদিন গরুর মাংস প্রতি কেজি ৬৫০ টাকা বিক্রি করেছেন বিক্রেতারা। রমজান সামনে রেখে মাংসের দাম বাড়ানোর পাঁয়তারা করছেন তারা। কারণ তাদের কাছে রমজান হচ্ছে- বাড়তি আয়ের মোক্ষম সময়। সেজন্য কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে কিছু অসাধু মাংস ব্যবসায়ী অতি লাভবান হবেন।

অন্যদিকে মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাংস কেজিতে ৬৫০ টাকা বেচা হলেও সেখানে প্রতি কেজি গরুর মাংসে ৭৫০ গ্রাম মাংস, ২০০ গ্রাম হাড় ও ৫০ গ্রাম চর্বি পেতেন। এখন আবার নির্ধারিত দামে গরুর মাংস বিক্রি না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। দাম বেঁধে দিয়ে মাংস বিক্রি করতে গেলে অনেকের লোকসান হচ্ছে বলে দাবি তাদের।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় বাজার কারওয়ান বাজার, মালিবাগ, রামপুরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গরু ও মুরগির মাংসের দাম কোনোটিই এখনো স্বাভাবিক পর্যায়ে আসেনি, আসন্ন রমজানে মাংসের দাম আরও বাড়লে সাধারণ ক্রেতার জন্য তা স্বস্তিকর হবে না। গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ করতে ব্যবসায়ীরা সভা করেছেন। এ বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি গোলাম মুর্তজা বলেন, এখন থেকে গরুর মাংসের কোনো নির্ধারিত দাম থাকবে না। নির্ধারিত দামে মাংস বিক্রি করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের লোকসান হচ্ছে। বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে মাংসের দাম নির্ধারিত হবে। তবে ঢাকা দুই সিটি কর্পোরেশনের সূত্রে জানা গেছে, ব্যবসায়ীরা হঠাৎ করেই মাংসের দাম বাড়াবে, যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। মাংসের বাড়তি দামের লাগাম টানতে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। উল্টো দফায় দফায় দাম বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৭০০ টাকায়। মাংস ব্যবসায়ীরা বলছেন, কয়েক দিনের মধ্যে দাম আরও বাড়তে পারে। খাসির মাংস ও ব্রয়লার মুরগির দামও বেড়েছে। লাগামহীনভাবে এই মূল্য বৃদ্ধি হলেও নজরদারি করার যেন কেউ নেই।

রাজধানীর বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য দেখভালের দায়িত্ব ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের। শিগগিরই মাংসের মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে দুটি সংস্থা। গরুর মাংসের পাশাপাশি বাজারে খাসির মাংসের দাম বেড়ে প্রতি কেজি ১ হাজার থেকে ১ হাজার ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। মূলত গরুর মাংসের দাম কমার ফলে বাজারে খাসিসহ অন্যান্য মাংসের দামে এর প্রভাব ছিল। দাম কম ছিল ব্রয়লার মুরগিরও। তবে বাজারে এখন প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২১০ টাকায়। কোথাও কোথাও ২২০ টাকাও চাইছেন মুরগি ব্যবসায়ীরা। এক মাসের ব্যবধানে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চার দাম প্রায় ১০ টাকা বেড়েছে। ফলে ব্রয়লার মুরগির দাম কেজিতে ৪০ টাকার মতো বেড়েছে। বেড়েছে সোনালি মুরগির দামও। প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৩১০ থেকে ৩৩০ টাকায়। মাসখানেক আগে সোনালি মুরগি প্রতি কেজি ৩০০ টাকার কাছাকাছি বিক্রি হয়েছে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সুমন হাওলাদার বলেন, মুরগির খাবার হিসেবে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধিতে অনেক প্রান্তিক খামারি উৎপাদন থেকে সরে যাচ্ছেন। এতে বাজারে মুরগি সরবরাহে সংকট হচ্ছে। এরই সুযোগ নিচ্ছে একটি চক্র। এরা দাম কমানোর সময়ে সক্রিয় থাকে, আবার মূল্যবৃদ্ধির পেছনে কলকাঠি নাড়ে। রমজানে বাজার স্থিতিশীল রাখতে কঠোর তদারকির প্রয়োজন। মাংস ব্যবসায়ী সমিতি অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির বিষয়ে বলছে, বর্তমানে ভারতীয় গরু সরবরাহ কমায় মাংসের দাম বাড়ছে। সীমান্তে কড়াকড়ির কারণে ভারত থেকে গরু আমদানি অস্বাভাবিকভাবে কমেছে। যে কোনো নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেই বিপাকে পড়েন সাধারণ ক্রেতারা। মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা নয়ন মুরাদ বলছেন, মাংসের লাগামহীন মূল্য বৃদ্ধিতে ক্ষুব্ধ। যে যেভাবে পারছে দাম বাড়াচ্ছে, সবাই তাতেই কিনতে বাধ্য হচ্ছি। বাজারে এলে মনে হয় ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের কেউ নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাসের আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, রমজান উপলক্ষ্যে নিত্যপণ্যের মতো মাংসের দাম নির্ধারণ করা যায় না। কারণ মাংস নিত্যপণ্যের মধ্যে পড়ে না, এটি বিলাসি খাবার। এরপরও প্রতি বছর সিটি কর্পোরেশন মাংসের দাম নির্ধারণ করে দিচ্ছে, সুতরাং আসন্ন রমজানে বাজারে মাংসের দাম কত হতে পারে, তা নির্ধারণ করে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে শিগগিরই সিটি কর্পোরেশন মিটিং করবে। অন্যদিকে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান জনসংযোগ কর্মকর্তা মকবুল হোসেন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, সামনে রমজান মাস, এ মাসের সুযোগ নিয়ে যারা নিত্যপণ্যের দাম বাড়নোর ষড়যন্ত্র করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সিটি কর্পোরেশন শিগগিরই গরুর মাংসের দাম নির্ধারণ নিয়ে মিটিং করবে। ওই মিটিংয়ে গরু, খাসি ও মুরগির মাংসের দাম নির্ধারিত হবে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে রাজধানী দেশের বিভিন্ন এলাকায় গরুর মাংস প্রতি কেজি সাড়ে ৬০০ টাকা বিক্রি করা হয়েছে, যা জানুয়ারি পর্যন্ত চলেছে। কিন্তু হঠাৎ মাংস ব্যবসায়ীরা বাজারে গরুর মাংসের দাম এক দফা বাড়িয়েছেন। এখন অধিকাংশ জায়গায় গরুর মাংস প্রতি কেজি ৭০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কোথাও কোথাও ৬৫০ টাকায় পাওয়া গেলেও, তাতে মাংসের মানের ক্ষেত্রে ছাড় দিতে হচ্ছে। সামনে আসছে রমজান। সাধারণত এ সময়ে বাজারে মাংসের দাম একটু বাড়তির দিকে থাকে। ঠিক এ সময়ে ব্যবসায়ীরা গরুর মাংসের নির্ধারিত দর থেকে সরে এলেন। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত এক মাসে গরুর মাংসের দাম বেড়েছে ৩ দশমিক ৮৫ শতাংশ। একটানা ৯ বছর বৃদ্ধির পাওয়ার পর দেশে প্রথমবারের মতো মাংসের উৎপাদনও কমেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) ৫ লাখ ৫৫ হাজার মেট্রিক টন মাংস কম উৎপাদিত হয়েছে। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩-১৪ অর্থবছর থেকে দেশে প্রতিবছর মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। গত অর্থবছরই প্রথম উৎপাদন কমেছে। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে মাংসের উৎপাদন ছিল ৯২ লাখ ৬৫ হাজার মেট্রিক টন। গত বছর তা কমে দাঁড়ায় ৮৭ লাখ ১০ হাজার মেট্রিক টনে। গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগিসহ সব ধরনের মাংসের উৎপাদনই কিছুটা কমেছে।