ঢাকা ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আবার ভাঙনের মুখে জাপা

বহিষ্কৃত ও পদত্যাগীদের নিয়ে দল গঠনের চেষ্টা

কয়েক খণ্ডে এখন এরশাদের লাঙ্গল
বহিষ্কৃত ও পদত্যাগীদের নিয়ে দল গঠনের চেষ্টা

সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টি (জাপা) প্রতিষ্ঠার পর থেকে দফায় দফায় ভেঙে এখন বেশ কয়েক টুকরায় পরিণত হয়েছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে নতুন করে আবার ভাঙন ধরেছে দলটিতে। ফলে আরো একবার ছোট হয়ে আসছে জাপা।

সূত্র জানায়, হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বেঁচে থাকতেই জাতীয় পার্টি কয়েক খণ্ড হয়। প্রথমে জাপা ভেঙে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), অতপর আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্ব জাতীয় পার্টি (জেপি), সাবেক প্রধানমন্ত্রী কাজী জাফর উল্লাহর নেতৃত্বে জাতীয় পার্টি (জাফর) এবং জাতীয় পার্টি (মতিন) প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এখন নতুন করে আরেকটি জাতীয় পার্টি সংগঠিত হতে পারে বলে গুঞ্জন রয়েছে।

জানা যায়, নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে দলটির নেতাদের মধ্যে শুরু হওয়া বিভেদ এখনো থামেনি। আর এরই মধ্যে বহিষ্কার আর পদত্যাগে খণ্ডে খণ্ডে বিভক্ত জাতীয় পার্টি ভেঙে আরও ছোট হচ্ছে। পার্টির প্রতিষ্ঠাতা ও এক সময়ের স্বৈরশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের মৃত্যুর পর পদপদবী ও নীতিগত অবস্থান নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও দলটির প্রধান পৃষ্ঠপোষক বেগম রওশন এরশাদ। ওই দ্বন্দ্বে রওশনের পক্ষাবলম্বনে দলের প্রাথমিক সদস্যসহ সব পদ হারান তৎকালীন মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা।

রওশন এরশাদ, রাঙ্গা এবং তাদের সঙ্গীরা দ্বাদশ নির্বাচনে বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জিএম কাদের) নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সঙ্গে কোনো সমঝোতায় না যেতে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেন। অবশ্য নানা রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে ওই অনুরোধ রক্ষা হয়নি। সেই যাত্রায়ও জিতে যান জিএম কাদের ও তার অনুসারীরা। কিন্তু জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে কি না সেই প্রশ্নে দলটির নীতিনির্ধারণী ফোরামের অধিকাংশ নেতিবাচক ভূমিকায় থাকার পরও জিএম কাদেরের একক সিদ্ধান্তে নির্বাচনে যাওয়ায় শুরু হয় বিরোধ। যা এখন ভাঙনে রূপ নিয়েছে।

জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দেয়ায় দলটির কেন্দ্রীয় একাধিক নেতা প্রকাশ্যেই অভিযোগ করেন সরকারের কাছ থেকে সুবিধা নেয়ার, একইসঙ্গে পার্টি চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের স্ত্রী শেরিফা কাদেরের আসন সমঝোতায় (তার নির্বাচনি আসন থেকে নৌকার প্রার্থীর প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়) দলটি নির্বাচনে যেতে সম্মত হয়। বিএনপি-জামায়াতে ইসলামী এবং অন্য বিরোধীদলগুলো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন বর্জনের প্রেক্ষাপটে জাতীয় পার্টি ভোটে গেলেও ভালো ফল আসবে না এমন ধারণা থেকে দলটির অধিকাংশ নেতাই ভোটে না যাওয়ার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু শেষ দিকে এসে নীতিনির্ধারণী ফোরামের অধিকাংশের মত উপেক্ষা করে ভোটে যাওয়া হয়েছে বলে দলটির নেতারা প্রকাশ্যে বক্তৃতা দিয়ে অভিযোগ করেন। দলের মনোনয়ন দেয়ার ক্ষেত্রে মনোনীতদের কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ আসে প্রকাশ্যে। দলের মনোনয়ন না পেয়ে ফেসবুকে লাইভ করে অভিযোগ করেন ভোলা জেলা জাতীয় পার্টির সেক্রেটারি। এমন আরও অনেকেই অভিযোগ করেন। এমনকি পার্টি অফিস ঘেরাও করে প্রকাশ্যে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে অর্থগ্রহণের মাধ্যমে মনোনয়ন দেয়ার অভিযোগে। তাছাড়া ২৬৫ আসনে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়ে মাত্র ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করায় ফুঁসে ওঠেন দলটির প্রার্থীরা। যাদের আসনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি তারা দলের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ক্ষোভ ও অসন্তোষের অংশ হিসেবে প্রথমেই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে আসেন পার্টির প্রবীণ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী কাজী ফিরোজ রশিদ। তিনি সমঝোতা ছাড়া নৌকার প্রার্থীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে রাজি হননি।

এরপর থেকে একে একে শতাধিক প্রার্থী নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। এদের মধ্যে কেউ কেউ প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে অথবা সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন বর্জন করেন। আবার কেউ কেউ নীরবে নির্বাচনি মাঠ থেকে চুপসে যান। নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো প্রার্থীরা দিনের পর দিন ফোন করে এবং সরাসরি এসেও পার্টির চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারা, আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়াসহ পার্টির শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ তোলেন নির্বাচনে অংশ নেয়া নেতারা।

কাজী ফিরোজ রশিদ, মশিউর রহমান রাঙ্গা, সৈয়দ আবুল হোসেন বাবলাদের মতো নেতারা এখন আর জাতীয় পার্টিতে নেই। পার্টি প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী রওশন এরশাদ কাগজে কলমে পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেও কার্যত তিনি পার্টিতে কর্মহীন ও গুরুত্বহীন। পার্টির কোনো কাজেই তিনি সক্রিয় নন, তাকে কোনো সাংগঠনিক কাজেই দেখা যাচ্ছে না। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে পার্টি থেকে আর কোনো খোঁজ না নেয়ার অভিযোগে সংবাদ সম্মেলন করে পদত্যাগের ঘোষণা দেন অনেকে। গত বৃহস্পতিবারও ঢাকার ছয়শতাধিক নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দেন জাতীয় পার্টি থেকে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ এনে ঢাকা মহানগর উত্তরের ১০টি থানার ৬৭১ নেতাকর্মী পদত্যাগ করেছেন।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক দিন পর গত ৮ জানুয়ারি গাজীপুর-৩ (শ্রীপুর ও গাজীপুরের আংশিক) আসনের জাতীয় পার্টির (জাপা) মনোনীত লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থীর সহকারী অধ্যাপক এফএম সাইফুল ইসলাম তার একান্ত অনুসারী চার নেতাসহ দল থেকে পদত্যাগ করেন। স্থানীয় ও কেন্দ্রীয়ভাবে দলীয় অসহযোগিতার কারণে তারা দল থেকে পদত্যাগ করেন বলে জানান। এভাবে দেশের বিভিন্ন জেলায় দলটির নেতাকর্মীদের পদত্যাগ অব্যাহত রয়েছে।

দলের নেতাকর্মীদের পদত্যাগের খবরে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেছেন, ‘আমাদের পার্টি ঠিক আছে। পার্টি নিয়ে অনেকে অনেক ডিস্টার্ব করতে চাচ্ছে। এগুলো আমরা জানি। তবু কিছুই করতে পারবে না। তবে চেষ্টা করবে।

দলত্যাগীদের নিয়ে জানতে চাইলে জিএম কাদের বলেন, ‘জাতীয় পার্টি যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। এটার হওয়ার কিছু নেই। সংবাদমাধ্যম থেকে এটাকে এইভাবে প্রোপাগান্ডা প্রচার করছে কেন এটা আমার কাছে রহস্য মনে হয়।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত