কালোবাজারে ট্রেনের টিকিট বিক্রি : ১৪ জন গ্রেপ্তার

সহজ ডট কম’র লোকজনও জড়িত

প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বিভিন্ন কারসাজি করে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করার অভিযোগে রাজধানীর কমলাপুর ও বিমানবন্দর এলাকা থেকে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৩ এর সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে অবৈধভাবে সংগ্রহ ও মজুতকৃত ১২০০-এর অধিক ট্রেনের টিকিট উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল দুপুরে কারওয়ান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন- সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা মো. সেলিম (৫০), মো. আনোয়ার হোসেন কাশেম (৬২), শ্রী অবনী সরকার সুমন (৩৫), মো. হারুন মিয়া (৬০), মো. মান্নান (৫০), মো. আনোয়ার হোসেন ডাবলু (৫০), মো. ফারুক (৬২), মো. শহীদুল ইসলাম বাবু (২২), মো. জুয়েল (২৩), মো. আব্দুর রহিমকে (৩২) গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর বিমানবন্দর রেলস্টেশন এলাকায় পৃথক অভিযান চালিয়ে উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা উত্তম চন্দ্র দাস (৩০), মো মোর্শিদ মিয়া ওরফে জাকির (৪৫), আব্দুল আলী (২২), মো. জোবায়েরকে (২৫)।

র‌্যাব জানায়, মলাপুর রেলস্টেশনে সেলিম এবং বিমানবন্দর রেলস্টেশনে উত্তমের নেতৃত্বে চক্রটি সংঘবদ্ধভাবে দীর্ঘদিন ধরে মহানগর প্রভাতি, তূর্ণা নিশিথা, চট্টলা এক্সপ্রেস, উপবন এক্সপ্রেস, মহানগর এক্সপ্রেস, পারাবত এক্সপ্রেস, উপকূল এক্সপ্রেস, জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস, কালনী এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি করে আসছিল। সেলিম এবং উত্তমের সহযোগিরা প্রথমত ট্রেনের কাউন্টারে বিভিন্ন ভ্রাম্যমাণ যাত্রী, রেলস্টেশনের কুলি, স্টেশনের আশপাশের এলাকার টোকাই, রিকশাওয়ালা ও দিনমজুরদের টাকার প্রলোভন দেখিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতেন। তাদের প্রত্যেককে ৪টি করে টিকিট সংগ্রহ করার বিনিময়ে ১০০ টাকা করে দেওয়া হতো। এছাড়া কাউন্টারে থাকা কিছু অসাধু টিকিট বুকিং কর্মচারীদের দিয়ে বিভিন্ন সাধারণ যাত্রীদের টিকিট কাটার সময় দেওয়া এনআইডি সংগ্রহ করে রেখে পরবর্তীতে সেগুলো ব্যবহার করে প্রতিটি এনআইডি দিয়ে একাধিক ট্রেনের টিকিট সংগ্রহ করত চক্রটি। এভাবে তারা প্রতিদিন প্রায় পাঁচ শতাধিক টিকিট সংগ্রহ করত। এছাড়া ঈদ, পূজা, সাপ্তাহিক ছুটিসহ বিশেষ ছুটির দিনকে উপলক্ষ্যে করে রেলস্টেশনে কর্মরত কিছু অসাধু কর্মচারী এবং অনলাইনে টিকিট ক্রয়ের জন্য ব্যবহৃত ভেন্ডর প্রতিষ্ঠান সহজ ডট কম-এর কিছু অসাধু কর্মকর্তা ও সার্ভার রুম-আইটি-এর সদস্যদের সহযোগিতায় তাদের কাছে সংরক্ষিত জনসাধারণের এনআইডি-এর তথ্য ব্যবহার করে এমনকি সার্ভার ডাউন করে তারা অনলাইনে টিকিট সংগ্রহ করত। পাশাপাশি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের দিয়ে অনলাইনে টিকিট কেটে সেগুলো তাদের কাছে থেকে সংগ্রহ করত। এছাড়া স্টেশনে থাকা তাদের সিন্ডিকেটের সদস্যদের দিয়ে কাউন্টার থেকে স্ট্যান্ডিং টিকিট সংগ্রহ করত।

এরপর সংগ্রহকৃত টিকিটগুলো নিয়ে চক্রের সদস্যরা উপযুক্ত সময় বুঝে রেলস্টেশনের ভেতরে অবস্থান করত। রেলস্টেশনে এসে টিকিট না পাওয়া সাধারণ যাত্রীদের কাছে অধিক মূল্যে এসব টিকিট বিক্রি করত তারা। ট্রেন ছাড়ার সময় যত ঘনিয়ে আসত তাদের টিকিটের দাম ততো বৃদ্ধি পেত। ঈদের ছুটিসহ বিভিন্ন বিশেষ দিনে এই মূল্য আরো ৩-৪ গুণ বেড়ে যেত। টিকিট বিক্রির এই লভ্যাংশের ৫০ শতাংশ নিতেন চক্রের সদস্যরা আর বাকিটা পেতেন কাউন্টারে থাকা বুকিং কর্মচারী-কর্মকর্তা এবং সহজ ডট কমের সদস্য ও আইটি বিশেষজ্ঞরা।

র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃত সেলিম প্রায় ৩৫ বছর যাবত টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত রয়েছে। সে কমলাপুর রেলস্টেশনে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি সেলিম সিন্ডিকেটের মূলহোতা। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় টিকিট কালোবাজারির দায়ে ৭টি মামলা রয়েছে এবং এসব মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে। সে জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় টিকিট কালোবাজারি শুরু করেন। গ্রেপ্তার মো. আনোয়ার হোসেন কাশেম প্রায় ১৫ বছর ধরে ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। এর আগে সে মাদক মামলাসহ একাধিক মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়।

এছাড়া গ্রেপ্তারকৃত অবনী সরকার ও হারুন মিয়ার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম এলাকার কাস্টমার সংগ্রহ করা। একইভাবে মান্নান এবং আনোয়ার ডাবলুর দায়িত্ব ছিল সিলেট এলাকার কাস্টমার সংগ্রহ করা। ফারুক এবং শহীদুল ইসলাম বাবুর দায়িত্ব ছিল ভৈরব ও কিশোরগঞ্জের কাস্টমার দেখাশোনা করা। জুয়েল এবং আব্দুর রহিমের দায়িত্ব ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আখাউড়ার যাত্রী সংগ্রহ করা। এদিকে গ্রেপ্তারকৃত উত্তমও প্রায় ১৫ বছর যাবত ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে জড়িত। সে বিমানবন্দর রেলস্টেশনের টিকিট কালোবাজারি চক্র উত্তম সিন্ডিকেটের মূলহোতা। তার সহযোগী গ্রেপ্তারকৃত আলী ও ফারুকসহ রাজধানীর আশকোনা এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় অবস্থান করে এসব কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। সে শারীরিক প্রতিবন্ধী এবং এই সহানুভূতিকে কাজে লাগিয়ে রেলস্টেশন এলাকায় সব সময় অবস্থান করে টিকিট কালোবাজারি চক্র গড়ে তোলে। তার বিরুদ্ধে টিকিট কালোবাজারির দায়ে ৪টি মামলা রয়েছে। ওই মামলায় সে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে বলে জানা যায়। সে জামিনে মুক্তি পেয়ে পুনরায় টিকিট কালোবাজারির কাজে লিপ্ত হয়।

র‌্যাব জানায়, অনলাইনে বা কাউন্টারে টিকিট বিক্রি শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শেষ হয়ে যায় এই রুটের ট্রেনের টিকিট। কিন্তু কালোবাজারিদের কাছে ২-৩ গুণ দামে টিকিট বিক্রি হতে দেখা যায়। চাহিদা অনুযায়ী টিকিট না পাওয়ার এবং টিকিট কালোবাজারি কর্তৃক অধিক মূল্যে টিকিট বিক্রয়ের বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ব্যাপক সমালোচিত হয়। ট্রেনের টিকিট কালোবাজারি প্রতিরোধ ও কালোবাজারিদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় গত বৃহস্পতিবার রাতে র‌্যাব-৩ এর অভিযানিক দল রাজধানীর কমলাপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে ট্রেনের এ টিকিট কালোবাজারির সদস্যদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১ হাজার ২৪৪টি আসনের টিকিট, ১৪টি মোবাইল ফোন এবং টিকিট বিক্রয়ের নগদ ২০ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা ট্রেনের টিকিট কালোবাজারির সঙ্গে তাদের সংশ্লিষ্টতা স্বীকার করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।