সব অধিদপ্তরের অর্গানোগ্রাম ‘বাক্সবন্দি’

ক্যাডার পদোন্নতিতে বৈষম্য বাড়ছে

প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পদোন্নতির দিকে বরাবরই নজর রাখছে প্রশাসন। তবে সেই পদোন্নতিতে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের ভাগ্য বদলালেও প্রকৌশলীদের কপাল পুড়ছে। কারণ একসঙ্গে চাকরিতে যোগদানে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা দ্রুতই পদোন্নতি পেয়ে উপসচিব, যুগ্মসচিব ও অতিরিক্ত সচিব হচ্ছেন। অন্যদিকে প্রকৌশলীদের অনেকেই থাকছেন নির্বাহী ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী। পদোন্নতিতে বৈষম্য বাড়ায় ক্ষুব্ধ প্রকৌশলীরা। যে কোনো সময়ে প্রকৌশলীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে মাঠপর্যায়ে আন্দোলনে নামতে পারে বলে জানিয়েছে প্রকৌশলীদের সবচেয়ে বড় সংগঠন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদশ (আইইবি)।

জানা গেছে, সরকারি ভবন নির্মাণে যুগের পর যুগ গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা গণপূর্ত অধিদপ্তর। এই অধিদপ্তরের অধিকাংশ প্রকৌশলী দেশের শীর্ষস্থানীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় বুয়েট, চুয়েট কিংবা রুয়েট থেকে এসেছেন। দক্ষতার সঙ্গে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করছেন এসব প্রকৌশলী। এতে গণপূর্তে কাজের পরিধি বাড়লেও মান্ধাতার আমলের অর্গানোগ্রাম দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। ফলে নির্বাহী প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কিংবা অতিরিক্ত প্রকৌশলীর পদোন্নতিতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। শূন্য পদ ছাড়া পদোন্নতি মিলছে না।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৌশলীদের পদোন্নতির জটিলতা গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাশাপাশি সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, রেলওয়ে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ, সেতু কর্তৃপক্ষ, বন্দর কর্তৃপক্ষ, সিটি করপোরেশন, পৌরসভা, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডে রয়েছে। এসব সংস্থার প্রকৌশলীরা কর্মকমিশনের (পিএসসি) মাধ্যমে নিয়োগ পেলেও তাদের পদোন্নতির সুযোগ ক্যাডারদের তুলনায় কম।

জানা গেছে, প্রশাসনে অতিরিক্ত সচিবের পদ ২১২টি, প্রেষণ পদ ১২৫টি। সর্বমোট ৩৩৭টি পদের বিপরীতে কর্মরত অতিরিক্ত সচিবের সংখ্যা ৪২৬। এছাড়া শিগগিরই বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের ১৮ ব্যাচকে বিবেচনায় নিয়ে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতির প্রক্রিয়া চলছে। যুগ্ম সচিবের অনুমোদিত ৫০২টি পদের বিপরীতে বর্তমানে কর্মরত আছেন ৯৪৬ জন। অনুমোদিত পদের চেয়ে ৪৪৪ জন কর্মকর্তা বেশি পদোন্নতি পেয়েছেন। উপসচিবের অনুমোদিত ১ হাজার ৪২৮টি পদের বিপরীতে ১ হাজার ৭০২ জন কর্মকর্তা উপসচিব হিসাবে কর্মরত আছেন।

প্রকৌশলীরা বলছেন, পদোন্নতি, বাড়ি-গাড়ি ও সম্মানের দিকবিবেচনায় নিয়ে সরকারের ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা প্রশাসন, পুলিশ ও পররাষ্ট্র ক্যাডারের চাকরির দিকে ঝুঁকছেন প্রকৌশলী ও চিকিৎসকরা। গত কয়েকটি বিসিএস পরীক্ষার ফল পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রায় ২ হাজার কর্মকর্তার মধ্যে ৩৮৭ জন প্রকৌশলী ও চিকিৎসক। আগের বিসিএসগুলোতে এই প্রবণতা কম ছিল। নির্ধারিত ক্যাডারে পদোন্নতিতে ধীরগতি ও সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় পেশা বদল করেন সংশ্লিষ্টরা। প্রশাসন, পুলিশ, পররাষ্ট্র, কর ও শুল্ক ক্যাডারে মেধা তালিকার প্রথম দিকে যারা ছিলেন তাদের বেশির ভাগেই বুয়েট, কুয়েট এবং চুয়েট থেকে পাস করা।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রশাসনকে আকর্ষণীয় ক্যাডার হিসেবে দেখছেন অন্যান্য ক্যাডারের কর্মকর্তারা। সেজন্য নিজের ক্যাডার বদলে প্রশাসন ক্যাডারে আসছেন অনেকে। প্রশাসন ক্যাডারে দ্রুত পদোন্নতি, গাড়ির সুবিধা, অতিরিক্ত ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ বেশি থাকায় আগ্রহ বাড়ছে বিশেষায়িত ডিগ্রিধারীদের। প্রকৌশলী বা চিকিৎসকদের প্রশাসন, পুলিশ বা পররাষ্ট্রের মতো আকর্ষণীয় ক্যাডারে আসা বন্ধের আইনি কোনো ভিত্তি নেই। তারা মেধার পরিচয় দিয়েই এসব ক্যাডারে আসছেন। তারা যেহেতু গণিত বা বিজ্ঞানে ভালো, তাই অন্য বিভাগ থেকে পাস করাদের থেকে এগিয়ে যাচ্ছেন। এটা বন্ধ করা যাবে না। তবে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে একধরনের কোটা চালু করা যেতে পারে।

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে সব মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পদই প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে। এখানে পেশাগত বিশেষ দক্ষতা থাকার পরও পেশাভিত্তিক অন্য ক্যাডাররা শীর্ষ পদে যেতে পারেন না। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন, কর্মকমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে প্রশাসন ক্যাডারের একক নিয়ন্ত্রণ। বিসিএসে প্রকৌশল, কৃষি ও চিকিৎসা ক্যাডারের সঙ্গে প্রশাসন ক্যাডারদের বৈষম্য দীর্ঘদিনের। এ নিয়ে আন্তঃক্যাডারদের মধ্যেও ক্ষোভ রয়েছে।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের কয়েকজন নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের কাছে আর্থিক, গাড়ি-বাড়ির সুযোগ-সুবিধার চেয়েও মর্যাদার ইস্যু হচ্ছে পদোন্নতি। কারণ প্রশাসন ক্যাডারের একজন জুনিয়র কর্মকর্তা দ্রুত পদোন্নতি পেয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হয়ে যান। কিন্তু প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের পদোন্নতি পেতে বছরের পর বছর অপেক্ষা করতে হয়। এতে মর্যাদার সংকটে ভোগেন প্রকৌশলী ও চিকিৎসকরা।

গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, রেলওয়ে, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরসহ সব প্রকৌশলী সংস্থার অর্গানোগ্রাম সংস্কারে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কিন্তু মন্ত্রণালয়গুলো অর্গানোগ্রাম সংস্কারে নজর দেয়নি। ফলে বছরের পর বছর অর্গানোগ্রাম ঝুলিয়ে আছে। একইসঙ্গে প্রকৌশলীরা পদোন্নতিও বঞ্ছিত হচ্ছেন বলে জানিয়েছেন ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) সাধারণ সম্পাদক এসএম মনজুরুল হক মঞ্জু। তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে আরো বলেছেন, সরকারি সংস্থা হিসেবে অধিদপ্তরগুলোতে জনবল বেড়েছে, কাজের পরিধিও বেড়েছে। কিন্তু আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে প্রকৌশলীদের পদোন্নতি বাড়েনি। এতে প্রশাসন ক্যাডারের দ্রুত পদোন্নতি দেওয়া জুনিয়র কর্মকর্তাদের অধীনে সিনিয়র প্রকৌশলীরা কাজ করছেন। যার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ছেন প্রকৌশলীরা। কাজের প্রতি আগ্রহ কমছে এবং কর্মপরিবেশ নষ্ট হচ্ছে।

অর্গানোগ্রামের দোহাই দিয়ে প্রকৌশলীদের পদোন্নতি আটকে রাখা হয়েছে এমন মন্তব্য করে আইইবি’র সাধারণ সম্পাদক আরো বলেন, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা সচিবালয়ে প্রশাসন ক্যাডারের উপ-সচিব, যুগ্ম-সচিব ও অতিরিক্ত সচিবের শূন্যপদ ছাড়াই কয়েকগুণ বেশি কর্মকর্তা পদোন্নতি পেয়েছেন। অথচ প্রকৌশলীদের পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। প্রকৌশলীদের পদোন্নতি ও ন্যায্য দাবি আদায়ে জোরালো ভূমিকা রাখছে আইইবি।

পদসংখ্যা বিবেচনায় গণপূর্ত সবচেয়ে বড় প্রকৌশল ক্যাডার। সংস্থাটিতে মোট ক্যাডার পদসংখ্যা ৯৩১টি। এরমধ্যে প্রধান প্রকৌশলী পদ ১টি, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ১৬টি, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী ৪৬টি, নির্বাহী প্রকৌশলী ১৬১টি, উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী ২৮৭টি, সহকারী প্রকৌশলী ৪২০টি। কাজের পরিধি বাড়ায় নতুন পদ সৃষ্টি তো দূরে থাক উল্টো আদালতের রায়েও গ্রেড উন্নীত হয়নি গণপূর্ত অধিদপ্তরে। সংস্থাটির প্রধান প্রকৌশলীর গ্রেড-১ পদ। তবে বর্তমান প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার তৃতীয় গ্রেডে রয়েছেন। তিনি ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা। গণপূর্তে গ্রেড-২ পদ নেই। অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলীর পদ গ্রেড-৩। তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীরা গ্রেড-৪। এ গ্রেডের ৪৬টি পদে রয়েছেন ১৮ থেকে ২০ ব্যাচের কর্মকর্তারা। প্রশাসনের ১৮ ব্যাচ গ্রেড-২ পাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। গণপূর্তের ১৮ ব্যাচের গ্রেড-৩ পেতে লাগবে আরো কয়েক বছর। একজন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বলেন, একসঙ্গে চাকরি শুরু করেও প্রশাসনের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে হয়, জুনিয়রদের অধীনে চাকরি করতে হয়। তাই প্রকৌশলীরা পেশা বদল করছেন। আরেকজন নগর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ছিলেন, তিনিও পেশা বদল করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে উপসচিব হিসেবে যোগ দিয়েছেন।

গণপূর্তের মামলায় হাইকোর্ট দুই মাসের মধ্যে গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী পদ গ্রেড-১, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী পদ গ্রেড-২ এবং তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী পদ গ্রেড-৩-এ উন্নীত করার আদেশ দিয়েছিলেন। ২০২১ সালের ২২ ডিসেম্বর প্রকাশিত সুপ্রিম কোর্টের রিভিউর রায়ে তা বহাল রয়েছে। তবে ২ বছর হতে চললেও রায় বাস্তবায়ন হয়নি। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চিঠিতে বলা হয়, গ্রেড উন্নীত করতে অর্থ বিভাগের সম্মতি, প্রশাসনিক উন্নয়ন সচিব কমিটির অনুমোদন লাগবে। এভাবেই আটকে আছে গণপূর্তের গ্রেড উন্নীত করার আদেশ।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেছেন, সরকারি চাকরিজীবীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে বৈষম্য থাকা উচিত নয়। অথচ প্রশাসন ক্যাডার ও প্রকৌশলীদের পদোন্নতিতে বৈষম্য করা হয়েছে। কারণ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা প্রশাসন ক্যাডারদের পদ খালি না থাকা শর্তেও পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। আর যারা ক্ষমতার বাইরে তাদের পদোন্নতিতে নজর নেই সরকারের। সেজন্য বুয়েট ও মেডিকেলের পাস করা শিক্ষার্থীরা বিসিএস দিয়ে প্রশাসনের দিকে ঝুঁকছে। এভাবে চলতে থাকলে কর্মস্পৃহা হারাবে প্রকৌশলীরা।

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার মনে করেন, পদ ছাড়া কারও পদোন্নতি হওয়া উচিত নয়। বর্তমানে পদ ছাড়া পদোন্নতি দেয়াতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হচ্ছে। সব ক্ষেত্রেই দায়িত্ব ও কার্যপরিধির নিরীখে পদের সংখ্যা নির্ধারিত থাকা উচিত এবং সেই পদের সংখ্যা অনুযায়ীই পদোন্নতি হওয়া উচিত।

প্রসঙ্গত, বিসিএসের ২৬ ক্যাডারের ১৪টি সাধারণ ও ১২টি কারিগরি। প্রকৌশলীরা নিয়োগ পান স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, রেল, গণপূর্তসহ বেশ কয়েকটি অধিদপ্তরে। তথ্য এবং খাদ্য ক্যাডারে কিছু প্রকৌশলী নিয়োগ পান। সংস্থাগুলোর শূন্যপদ ছাড়া প্রকৌশলীদের পদোন্নতি মিলছে না। আবার কিছু সংস্থায় গ্রেড-১ পদ থাকলেও চলতি দায়িত্ব থেকেই অবসরে যান প্রকৌশলীরা।