জাতীয় সংসদে প্রথম ভাষণে রাষ্ট্রপতি

উন্নয়নের গতিধারা অব্যাহত রাখতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে ফের আনুষ্ঠানিক যাত্রা করল বাংলাদেশ। সরকার ও বিরোধী দলের সরব উপস্থিতির মধ্যদিয়ে গতকাল শুরু হলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন। উন্নত-সমৃদ্ধ স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে শুরু হওয়া সংসদের প্রথম অধিবেশনে ছিল উৎসবমুখর পরিবেশ। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। সংসদের সূচনাতেই স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু। আর সংসদে প্রধান হুইপ নিয়োগ পেয়েছেন নূর-ই-আলম চৌধুরী। এ নিয়ে টানা চতুর্থবারের মতো স্পিকার হওয়ার বিরল সম্মান অর্জন করলেন ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্পিকার নির্বাচনের পর সংসদের অধিবেশন ২০ মিনিটের জন্য মুলতবী করা হয়। মুলতবীর সময়ে সংসদ ভবনের সপ্তম তলায় রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে পুনর্নির্বাচিত স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীকে শপথ বাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এ সময় চিফ হুইপসহ অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। শপথ গ্রহণ শেষে ফের অধিবেশন শুরু হলে স্পিকারের আসনে বসনে ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। নবনির্বাচিত স্পিকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে বক্তব্য রাখেন, সরকারি দলের সিনিয়র সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং বিরোধী দলের নেতা জিএম কাদের। এর আগে বিকাল ৩টায় ডেপুটি স্পিকার শামসুল হক টুকুর সভাপতিত্বে পর্দা উঠে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের। অধিবেশন শুরুর আগে বেলা ১২টার পর থেকেই পুরো সংসদ ভবন নবীন-প্রবীণ সংসদ সদস্যেদের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে। ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৩ আসনে বিজয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো সরকারি দলের আসনে বসে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। আর সংসদীয় ইতিহাসে এবারই প্রথম রেকর্ড সংখ্যক ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য দ্বাদশ সংসদে বসেছে। উদ্বোধনী অধিবেশন দেখতে ভিআইপি গ্যালারিসহ দর্শনার্থী গ্যালারিও ছিল পরিপূর্ণ।

সংসদ সচিবালয় জানিয়েছে, অধিবেশন দেখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউকে, ফ্রান্স, ভারত, জার্মানি, রাশিয়া, চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূতসহ ৮০ জন কূটনীতিক উপস্থিত ছিলেন। স্পিকার নির্বাচনের পর ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে ফের সংসদ অধিবেশন শুরু হলে প্রথমেই তিনি ডেপুটি স্পিকার পদে নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করেন। ওই পদে একটিমাত্র মনোনয়ন জমা পড়ে। ফলে দ্বিতীয়বারের মতো ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন অ্যাডভোকেট শামসুল হক টুকু। তার পক্ষে প্রস্তাব করেন সরকারি দলের সদস্য ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম, সমর্থন করেন সরকারি দলের অপর সদস্য মকবুল হোসেন। এরপর স্পিকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলে কণ্ঠভোটে সর্বসম্মতিক্রমে ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন শামসুল হক টুকু। নির্বাচিত হওয়ার পর রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ে তাকে শপথবাক্য পাঠ করান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। স্পিকার তার স্বাগত বক্তব্যে চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হওয়ায় আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করে সংসদীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সবার সহযোগিতা কামনা করেন।

তিনি বলেন, ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে জনগণের ভোটে বিজয়ী হয়ে আপনারা সংসদে এসেছেন। সবকিছু উপেক্ষা করে ভোট কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দেয়ার জন্যও দেশবাসীকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি বলেন, জাতির আলোকবর্তিকা হয়ে টানা চতুর্থবারসহ মোট পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে, আরো এগিয়ে যাবে। দেশের সব অর্জনগুলো টেকসই করতে জাতীয় সংসদে আপনারা কার্যকর ভূমিকা পালন করবেন, এটাই আমার প্রত্যাশা। এ ব্যাপারে সংসদ সদস্যদের গঠনমূলক ভূমিকা পালন করতে হবে।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন : অধিবেশনের শুরুতেই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মনোনয়ন দেন স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকারের অনুপস্থিতিতে অগ্রবর্তী থাকা সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা সংসদ পরিচালনা করবেন। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যরা হলেন- ক্যাপ্টেন (অব.) এবি তাজুল ইসলাম, মো, শাহাবুদ্দিন, আফম রুহুল হক, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও উম্মে কুলসুম স্মৃতি।

যাদের নামে শোকপ্রস্তাব গ্রহণ : কুয়েতের আমির শেখ নাওয়াফ আল-আহমদ আল-জাবের আল-সাবাহসহ দেশের এক সাবেক মন্ত্রী, এক সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও একজন সাবেক সংসদ সদস্যের মৃত্যুতে সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। অন্য যাদের নামে শোক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়েছে তারা হলেন- সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, সাবেক মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা জিনাতুন নেসা তালুকদার ও নবম জাতীয় সংসদের সাবেক সংসদ সদস্য (নওগাঁ-৩ আসন) আকরাম হোসেন চৌধুরী। এছাড়া সংসদ সচিবালয়ের পরিচালক (গণসংযোগ) বেগম লাবণ্য আহমেদ, সিনিয়র সহকারী সচিব খন্দকার আবদুল মুত্তালিব, ব্যক্তিগত কর্মকর্তা মো. নজরুল ইসলাম ও কেয়ারটেকার মুনির উদ্দিন আহম্মদের মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করা হয়েছে। সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান, বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক বীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আনোয়ার, জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুল মালিক, জার্মানির কিংবদন্তি ফুটবলার ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার ও সংসদ সদস্য মোফাজ্জল হোসাইন চৌধুরীর পুত্র সাজেদুল হোসেন চৌধুরী দীপুর মৃত্যুতে মহান সংসদের পক্ষ থেকে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করা হয়। জাপান ও নেপালে ভয়াবহ ভূমিকম্প, চীনের মধ্যাঞ্চলীয় হেনান প্রদেশে কয়লা খনিতে দুর্ঘটনা, রাজধানীর গোপীবাগে ঢাকাগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ড, গাজীপুরের ভাওয়ালে ঢাকাগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ট্রেন দুর্ঘটনা, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নিসন্ত্রাস, মানিকগঞ্জের পাটুরিয়ায় ফেরিডুবি এবং দেশ-বিদেশের বিভিন্ন স্থানে দুর্ঘটনায় হতাহতদের স্মরণে মহান জাতীয় সংসদ গভীর শোক প্রকাশ, সকল বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানায়। শোক প্রস্তাবে মৃত্যুবরণকারী সবার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানানো হয়। শোক প্রস্তাবে উল্লিখিত মৃত্যুবরণকারীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১ মিনিট নীরবতা পালন ও তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। মোনাজাত পরিচালনা করেন স্বতন্ত্র সদস্য মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী।

এরপরে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ভাষণ দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে সংসদ অধিবেশনে আহ্বান করেন। বিউগল বাজানোর মধ্যদিয়ে বিকাল সাড়ে ৪টায় রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন অধিবেশন কক্ষে প্রবেশ করলে সবাই দাঁড়িয়ে তাকে সম্মান জানান। এরপর শব্দযন্ত্রের মাধ্যমে জাতীয়সংগীত পরিবেশন করা হয়। স্পিকারের পাশের আসনে বসেন রাষ্ট্রপতি। এরপর নতুন বছরের প্রথম অধিবেশনে ভাষণ দেন তিনি। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর এটাই ছিল মো. সাহাবুদ্দিনের জাতীয় সংসদে প্রথম ভাষণ।

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন তার ভাষণে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং জনগণ ও গণতন্ত্রের কল্যাণে অহিংস পন্থায় গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করার আহ্বান জানান। এ ক্ষেত্রে তিনি সরকারকেও সংযত আচরণ করারও উপদেশ দিয়ে বলেন, উন্নয়নের এ চলমান গতিধারা অব্যাহত রাখতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে।

তিনি বলেন, উন্নয়ন স্থায়ী ও টেকসই করতে হলে গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মজবুত, তৃণমূল পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ছড়িয়ে দিতে হবে।

‘নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে তাদের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করছে... আমি আশা করি, ভবিষ্যতে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সহিংসতা ও নৈরাজ্যের পথ পরিহার করে জনগণ ও গণতন্ত্রের কল্যাণে অহিংসপন্থায় গঠনমূলক কর্মসূচি পালন করবে,’ রাষ্ট্রপতি বলেন।

তিনি বলেন, কেউ যাতে আন্দোলনের নামে অরাজকতা সৃষ্টি করে মানুষের জানমাল ও জীবিকার ক্ষতিসাধন করতে না পারে, সেদিকে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন দেশের আর্থিক খাতের সংস্কার এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ও কঠোর পদক্ষেপ নিতে জোর তাগিদ দেন।

সকল গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়ে নজরদারি বৃদ্ধি করে জনগণকে সম্পৃক্ত রেখে যথাযথভাবে মোকাবিলা করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, ষড়যন্ত্র করে কেউ যাতে জনগণের অধিকার কেড়ে নিতে না পারে, সেদিকে সকলের সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, পরমতসহিষ্ণুতা, মানবাধিকার ও আইনের শাসন সুসংহতকরণ এবং জাতির অগ্রযাত্রার স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার সফল বাস্তবায়নে সরকারি দলের পাশাপাশি বিরোধীদলকেও গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার ও আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও উন্নয়নের নিষ্কণ্টক পথচলার জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলো উদার ও গঠনমূলক মনোভাব নিয়ে জনগণের পাশে দাঁড়াবে- এটাই দেশবাসীর প্রত্যাশা।

‘রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ, মত-পথের ভিন্নতা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সংসদকে গণতন্ত্র ও উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার ক্ষেত্রে কোনো মতদ্বৈততা জনগণ প্রত্যাশা করে না,’ রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করেন। জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত মহান এ প্রতিষ্ঠানটি ‘জনগণের সকল প্রত্যাশার ধারক ও বাহক’ অভিহিত করে তিনি বলেন, জনগণের চাহিদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে নাগরিকদের কল্যাণে জাতীয় সংসদ যথাযথ ও কার্যকর ভূমিকা পালন করবে- এটাই জনগণের প্রত্যাশা।

তিনি মনে করেন, ভূরাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলে এর প্রভাব আমাদের উপরও পড়বে। এজন্য আমাদের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিন বলেন, উন্নত কৃষিপ্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষিপণ্য সংরক্ষণাগার এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাত শিল্প গড়ে তুলতে হবে।

তিনি বলেন, দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির পাশাপাশি নতুন নতুন শ্রমবাজারের অনুসন্ধান করতে হবে, যাতে দক্ষ শ্রমশক্তি রপ্তানি সম্ভব হয়। ইংরেজি নববর্ষ এবং দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনের সূচনালগ্নে স্পিকার, নবগঠিত সরকারের চতুর্থসহ পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সংসদণ্ডসদস্যগণকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান রাষ্ট্রপতি।