জাপার কাকরাইল কার্যালয় নিয়েও রওশন-কাদের লড়াই

প্রকাশ : ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

জাতীয় পার্টি (জাপা) কার্যালয় নিয়ে এবার ভাবি রওশন এরশাদ ও দেবর জি এম কাদেরের মধ্যে নতুন করে দ্বন্দ্ব চরম পর্যায়ে পৌছেছে। ইতোমধ্যে নানা ইস্যুতে তাদের মধ্যেকার দ্বন্দ্বে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হয়েছেন। তারা কার পক্ষ অবলম্বন করবেন, তা নিয়ে তাদের মধ্যে সংশয় দেখা দেয়। দলীয় পদ-পদবি ও নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে তাদের মধ্যে যে মতানৈক্য ছিল তার নিরসন হতে না হতে এই দুইজনের মধ্যে অফিস দখল নিয়ে শক্তি প্রদর্শন করা হয়েছে। তাদের নিজ নিজ অনুসারিরা দলীয় কার্যালয়ে পাল্টাপাল্টি দখল নিয়ে তালা ঝুলিয়ে নিজেদের শক্তির জানান দিতে চেয়েছে। এখন জনমনে প্রশ্ন- কার দখলে কাকরাইলের জাতীয় পার্টির প্রধান কার্যালয়।

সূত্র জানায়, গত শক্রবার জাতীয় পার্টির কাকরাইলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন রওশনপন্থি নেতারা। জাতীয় পার্টির অন্তর্বর্তীকালীন মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে তারা কার্যালয়ে প্রবেশ করেন। এরপর তারা কিছু সময় দলীয় কার্যালয়ের অভ্যন্তরে অবস্থান করেন। এ সময় কাজী মামুনুর রশীদ বলেন, জাতীয় পার্টিতে জি এম কাদের ও মো. মুজিবুল হক চুন্নুর কোনো প্রয়োজন নেই।

কাজী মামুন বলেন, বেগম রওশন এরশাদ পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দলে প্রাণ ফিরে এসেছে। আমরা পল্লিমাতাকে সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছি। তিনি বলেন, কাদের-চুন্নুর জন্য দলের আজ বেহালদশা। তাদের নেতৃত্বের প্রতি পার্টির নেতাকর্মীদের আস্থা নেই। প্রয়োজনে পার্টিতে তাদের অন্য কোনো দায়িত্ব দেওয়া হবে।

জানা যায়, রওশনের ঘোষিত অন্তর্বর্তীকালীন মহাসচিব কাজী মামুনুর রশীদের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী গত শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় দলীয় কার্যালয়ে যান। তারা অফিসে ঢোকার আগে দলের প্রতিষ্ঠাতা এইচএম এরশাদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং মোনাজাতে অংশ নেন।

দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুনীল শুভরায়, শফিকুল ইসলাম সেন্টু, ভাইস চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আলম পাঠান, কেন্দ্রীয় নেতা খন্দকার মনিরুজ্জামান টিটু, ফখরুল আহসান শাহজাদা, খোরশেদ আলম খোশু, শাহীন আরা সুলতানা রিমা, শেখ রুনা, জাতীয় ওলামা পার্টির মাওলানা সোহরাব হোসেন এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

জাপা সূত্র জানায়, জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব নিয়ে এরশাদের স্ত্রী রওশন এবং ভাই জিএম কাদেরের পুরোনো দ্বন্দ্ব গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। দেবর জিএম কাদেরের সঙ্গে মতবিরোধে গত সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ নিজে এবার নির্বাচনে অংশ নেননি। তার অনুসারীদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি।

নির্বাচনের পর পার্টি থেকে প্রেসিডিয়াম সদস্যসহ কয়েকজনকে অব্যাহতি দেয়া হয়, যারা রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত। এরপর গত বৃহস্পতিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের ও মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ এনে ৬৭১ জন নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

সেই পদত্যাগী এবং বহিষ্কৃতরা গত ২৮ জানুয়ারি জড়ো হন পার্টির ‘প্রধান পৃষ্ঠপোষক’ রওশনের গুলশানের বাসায়। সেখানে জিএম কাদের ও মহাসচিব মজিবুল হক চুন্নুকে ‘অব্যাহতি’ দিয়ে নিজেই দলের হাল ধরার ঘোষণা দেন এরশাদের স্ত্রী। মামুনুর রশীদকে তিনি দেন অন্তবর্তীকালীন মহাসচিবের দায়িত্ব।

সেদিনই জাতীয় পার্টিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল এবং জিএম কাদেরকে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে স্বীকৃতি দেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী।

এদিকে জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির যুগ্ম দপ্তর সম্পাদক মাহমুদ আলমের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জাতীয় পার্টি জি এম কাদেরের নেতৃত্বে এক ও ঐক্যবদ্ধ আছে, কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল হয়েছে এটা সত্য নয়। বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, বিভিন্ন গণমাধ্যমে জাতীয় পার্টির কাকরাইল কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখল হয়েছে সংবাদটি সঠিক নয়। দলীয় শৃঙ্খলাবিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে ইতিপূর্বে জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত কয়েকজন এবং কিছু ভাড়াটে লোক শুক্রবার বন্ধের দিন সকাল ৮টায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে পার্টির প্রতিষ্ঠাতা পল্লিবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের প্রতিকৃতিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে কার্যালয়ের নিচতলায় অবস্থিত ঢাকা মহানগর দক্ষিণের রুমে ১০ থেকে ১২ মিনিট অবস্থান করেন। পরে অফিসের বাইরে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলে তারা চলে যান। জাতীয় পার্টি সারা দেশে জি এম কাদেরের নেতৃত্বে এক ও ঐক্যবদ্ধ আছে। কাকরাইল কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখলের বিভ্রান্তিমূলক সংবাদে জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের বিভ্রান্ত না হওয়ার অনুরোধ করা হয়। রাজধানীর বিজয়নগরে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় ঘণ্টা দেড়েকের জন্য দখলে নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করেছেন রওশন এরশাদের অনুসারী নেতারা। জি এম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক চুন্নু জানান, গণমাধ্যমে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয় দখলের খবর এসেছে, এটি সত্য নয়।

এদিকে জাপার চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, জাতীয় পার্টির বিষয়ে মানুষের ধারণা ভালো নয়। তিনি বলেছেন, অনেকে বলেছে আমাদের দল ভাগ হয়ে যাবে। দল ভাগ হওয়ার সম্ভাবনা আমি এই মুহূর্তে, এই প্রেক্ষিতে দেখছি না। এরশাদ সাহেবের নাম ও আদর্শ দিয়ে আরো ১০টি দল যে কেউ গঠন করতে পারে। কিন্তু আমাদের দল থেকে ভেঙে নিয়ে আরেকটি দল গঠন করার পরিবেশ পরিস্থিতি এই মুহূর্তে দেখছি না। তবে একটা জিনিস আমি বলতে চাই, আমাদের দলের ব্যাপারে মানুষের উপলব্ধি কিন্তু ভালো নয়। গতকাল বনানীতে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন।

জিএম কাদের বলেন, আমরা অন্য দলের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়েছি, সেটা আংশিক সত্য। আমরা সেখান থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছি। আমাদের দলের মধ্যে ব্যাপকভাবে সংশোধন হওয়ার দরকার আছে। জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান বলেন, এই নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগ বিভ্রান্তিকর একটি স্টেটমেন্ট দিয়েছে। তারা বলেছে আওয়ামী লীগের ২৬টি সিট ছেড়ে দিলাম জাতীয় পার্টির ফেভারে। কিন্তু তারা সেসব ছাড়ে নাই, সব জায়গায় তাদের লোক দিয়ে রেখেছে। আমাদের অনেক প্রার্থী বিভ্রান্ত হয়েছে। অনেকে এটাকে মহাজোট বলেছেন, আবার অনেকে এটাকে সিট ভাগাভাগির কথা বলেছেন। আমি প্রথম দিন থেকে বলেছি, এটা মহাজোট হয়নি। সিট ভাগাভাগিও হয়নি। এটা বিভ্রান্তিকর, আওয়ামী লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে। এটি না হলে আমাদের ফলাফল এর চেয়ে আরো ভালো হতো। তিনি দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, দলকে টেকাতে হলে সবাইকে একলাইনে থাকতে হবে। আমরা যদি ব্যর্থ হই তবে দল মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। আমরা ভাঙন নিয়ে চিন্তিত নই। কিন্তু আমাদের নিজেদের মধ্যে যে ত্রুটি আছে সেগুলো সারিয়ে তুলতে হবে। অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য দেন জাতীয় পার্টির মহাসচিব বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মুজিবুল হক চুন্নু। উপস্থিত ছিলেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেরীফা কাদের, ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. তৈয়বুর রহমান, সদস্য সচিব মো. সুলতান আহমেদ সেলিম।