টার্গেট আসন্ন রমজান

বাজারে নৈরাজ্যরোধে এক ছাতার নিচে মন্ত্রণালয়গুলো

* পণ্যের কারসাজি ঠেকাতে বৈঠকে মন্ত্রীরা * রমজানের আগে ঘাটতি মেটাতে পণ্য আমদানির সিদ্ধান্ত * কারসাজির হোতাদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ * পণ্য আমদানিতে প্রয়োজনে ডলার সরবরাহ * অবৈধ মজুতদারদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে : ক্যাব সভাপতি

প্রকাশ : ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

আসন্ন রমজান মাস সামনে রেখে রাজধানীসহ সারাদেশে নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুতদার ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর পরই দেশব্যাপী নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতির লাগাম টানতে বাণিজ্য, কৃষি ও খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থা মাঠপর্যায়ে মনিটরিংয়ের কাজ করছে। তবে এতেও পণ্যের দামের লাগাম টানা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

জানা গেছে, পাইকারি ও খুচরা বাজারে চাল, ডাল, ডিম, পেঁয়াজসহ বিভিন্ন পণ্যের সিন্ডিকেটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ঐকমত্যে পেঁৗঁছেছে খাদ্য, কৃষি ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সেজন্য গত মঙ্গলবার খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর শহীদ ও বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করেছেন। এই সভায় মন্ত্রণালয়ের সচিব, কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তবে এর আগেও ২১ জানুয়ারি নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে জরুরি বৈঠক করেছিলেন। ওই সভায় আসন্ন রমজানে বাজার ব্যবস্থাপনা ও সমন্বিতভাবে বাজার মনিটরিংয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। নিত্যপণ্যের কোনো সংকট নেই, এলসি মীমাংসায়ও নেই কোনো জটিলতা। কাজেই বাজারে কোনো ধরনের সংকট সৃষ্টি বা অস্থির বাজার ব্যবস্থাপনা কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না বলেও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের এক জরুরি সভায় এমন সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে সভায় খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার, কৃষিমন্ত্রী আব্দুস শহীদ, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী আব্দুর রহমান, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার, এনবিআর চেয়ারম্যানসহ রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এরপর থেকে মাঠপর্যায়ে পণ্য সিন্ডিকেটকারীদের বিরুদ্ধে মোবাইল কোর্ট পরিচালনার সিদ্ধান্ত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের খোলা বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ বাড়ানোর কৌশল নির্ধারণ, মজুতদার ও সিন্ডিকেটের কারসাজি রোধ এবং প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির মাধ্যমে দ্রুত সময়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের উপায় বের করার কাজ চলছে। বিভিন্ন পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতির সঙ্গে চাহিদা বিশ্লেষণ করে ঘাটতি চিহ্নিত করা এবং রমজানের আগে ঘাটতি মেটাতে পণ্য আমদানি সহজ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এবার সমন্বিত বাজার ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে নিয়মিত নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে বৈঠক হচ্ছে। রমজানের আগেভাবে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে কঠোর মনিটরিং চলবে। বাজারে যেকোনও প্রকার নৈরাজ্য রোধ করতে দেশের সব সংশ্লিষ্ট সংস্থা কাজ করবে। দেশে কোনো ধরনের পণ্যের ঘাটতি নেই। আমদানির ক্ষেত্রে এলসি খোলার ক্ষেত্রেও কোনো জটিলতা নেই।

জানা গেছে, সারাদেশে পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি পরিস্থিতির সঙ্গে চাহিদা বিশ্লেষণ করে ঘাটতি চিহ্নিত করা এবং রমজানের আগে ঘাটতি মেটাতে পণ্য আমদানি সহজ করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। চাল, আটা, তেল, চিনি, আলু, পেঁয়াজ, গরুর মাংস, ডিম ও পোলট্রি পণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করা কারসাজির হোতাদের চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সারাদেশে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে কারসাজি হোতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণের স্বার্থে আইনানুগ ব্যবস্থার কঠোর দৃষ্টান্ত স্থাপন করা হয়েছে।

খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুত, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর আইন প্রতিরোধ) আইন-২০২৩ এর বিধি প্রণয়নের কাজ চলছে। শিগগিরই বাস্তবায়িত হবে। কৃষি মন্ত্রণালয়ও পণ্যের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণ বিষয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চার পণ্যের শুল্ক কমানো-সংক্রান্ত অর্ডার (প্রজ্ঞাপন) করবে।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সারাদেশে অবৈধ মজুত প্রতিরোধে অর্ভিযান পরিচালনা করছে। অভিযানে গত ৫ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে ৮ লাখ টাকার কাছাকাছি জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এছাড়া গত ৬ ফেব্রুয়ারি ৬ লাখ ৩৯ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করা হয়েছে। এভাবে প্রতিদিন অবৈধ মজুতদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেছেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহারে এক নম্বরে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখার কথা বলা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও মন্ত্রিসভা বৈঠকে মজুতদার ও কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের নির্দেশনা দিয়েছেন।

বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী বলেন, অর্থমন্ত্রী, কৃষিমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে একটি টিম হিসেবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের কাজ আমরা শুরু করেছি। অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আটটি নিত্যপণ্য আমদানিতে এলসি মার্জিন প্রত্যাহার করা হয়েছে। রোজার আগে এসব নিত্যপণ্য আমদানিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রয়োজনীয় ডলার সরবরাহ করা হবে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৪১ শতাংশ। ওই সময় খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। আগামী জুনে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেছেন, বাজারে নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পণ্যের দাম বেঁধে দিলেও মূল্যবৃদ্ধির প্রবণতা কমানো সম্ভব নয়। তবে যেসব কারণে পণ্যের দাম বাড়ছে সেটি রোধের উদ্যোগ নিতে হবে। অসাধু ব্যবসায়ীরা যাতে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে না পারেন এবং পণ্যের সরবরাহব্যবস্থা যেন কোনোভাবে বাধাগ্রস্ত না হয়, সরকারকে সেদিকে কঠোর নজরদারি করতে হবে।

পণ্যের কারসাজির সঙ্গে যেসব প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দ্রুততম সময়ে তদন্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তাহলেই দেশের ভোক্তারা সুফল পাবে বলে মনে করছেন ক্যাবের সভাপতি।