রমজানে পণ্যমূল্যে মিলছে স্বস্তি

প্রকাশ : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

আসন্ন পবিত্র রমজান মাস ঘিরে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর শুল্ক ও করে ছাড় দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রীও জানিয়েছেন আগামী সপ্তাহের মধ্যে তেল-চিনির নতুন দাম নির্ধারণ করা হবে। সবমিলিয়ে পণ্যমূল্যে ফিরছে স্বস্তি।

জানা যায়, চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। বিশেষ করে ছোলা, খেজুর, মটর ডাল, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মসলা, তাজা ও শুকনো ফল আমদানি হয়েছে গত কয়েক মাসের তুলনায় অনেক বেশি। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, রমজান ঘিরে যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে কারসাজি না হলে কোনো ভোগ্যপণ্যের সংকট হবে না। এমনকি কোনো পণ্যের দামও বাড়বে না।

এদিকে, আসন্ন পবিত্র রমজান মাস উপলক্ষ্যে চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর শুল্ক ও করে ছাড় দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পণ্যগুলোতে শুল্ক ও কর ৫ শতাংশ থেকে সর্বোচ্চ ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার এনবিআর চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমের স্বাক্ষর করা পৃথক চারটি প্রজ্ঞাপন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয় গত ৭ ফেব্রুয়ারি। প্রজ্ঞাপন সূত্রে জানা যায়, চাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও কর মিলিয়ে ৪৭.২৫ শতাংশ কমানো হয়েছে। বিদ্যমান শুল্ক ও কর ৬২.৫০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১৫.২৫ শতাংশ করা হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূরক শুল্ক কমানো হয়েছে ২০ শতাংশ, যা বয়েল ও নন-বয়েল চাল আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। তবে রেয়াতি হারে চাল আমদানির পূর্বে প্রত্যেক চালানের জন্য খাদ্য মন্ত্রণালয়ের ন্যূনতম যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা থেকে লিখিত অনুমোদন নিতে হবে। এই সুবিধা আগামী ১৫ মে পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। পরিশোধিত ও অপরিশোধিত সয়াবিন তেল ও পাম অয়েলের ওপর প্রযোজ্য কর (ভ্যাট) ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে, যা আগামী ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।

চিনির ক্ষেত্রে প্রতি মেট্রিক টনে শুল্ক দেড় হাজার টাকা থেকে কমিয়ে ১ হাজার টাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছে। এই সুবিধা ৩১ মার্চ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে।

খেজুর আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও কর ৫৮ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪৩ শতাংশ করা হয়েছে, যার মধ্যে আমদানি শুল্ক ১০ শতাংশ কমানো হয়েছে। এটি আগামী ৩০ মার্চ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে। গত ২৯ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে রমজান উপলক্ষ্যে ভোজ্যতেল, চিনি, খেজুর ও চালের ওপর শুল্ক কমানোর নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রমজানে যাতে এসব পণ্যের সরবরাহ কম না হয়। এর আগে গত ২২ জানুয়ারি চাল, ভোজ্যতেল, চিনি ও খেজুরের ওপর শুল্ক ও করে ছাড় দিতে এনবিআরে চিঠি দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।

এদিকে, শুল্ক কমায় আগামী সপ্তাহের মধ্যে ভোজ্যতেল ও চিনির নতুন দাম নির্ধারণ হবে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু। গতকাল বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে নিজ দপ্তরে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। উৎপাদনকারী ও আমদানিকারকদের উদ্দেশ্যে প্রতিমন্ত্রী বলেন, যে মালামাল ট্রানজিটে আছে সেগুলো দ্রুত খালাস করে বাজারজাত করার আহ্বান জানাচ্ছি। যাতে শুল্ক সুবিধা সাধারণ ভোক্তাপর্যায়ে যায়।

তেল-চিনির মূল্য নির্ধারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তেল এবং চিনির মূল্য আমাদের ট্যারিফ কমিশন নির্ধারণ করে। আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে আমদানিকারক এবং উৎপাদনকারীদের সঙ্গে বসে যৌক্তিক পর্যায়ে নতুন শুল্কের প্রভাব অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করব। রমজান উপলক্ষ্যে সেই দামে বিক্রি হবে। আহসানুল ইসলাম টিটু আরো বলেন, আমরা এনবিআরের সঙ্গে কথা বলব। উৎপাদক যারা আছেন, তারা কবে মাল আনছেন সে হিসাব করে আগামী সপ্তাহের মধ্যে বসে নতুন শুল্কের যে হিসাব সে অনুযায়ী মূল্য নির্ধারণ করে দেব।

রমজান ঘিরে গত কয়েক মাসের চেয়ে ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের উপপরিচালক ড. মোহাম্মদ শাহ আলম। তিনি বলেন, বিশেষ করে গত ১৫ থেকে ২০ দিনে প্রচুর ভোগ্যপণ্য আমদানি হয়েছে, যা আগের যেকোনো মাসের তুলনায় অনেক বেশি। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এসব পণ্য জাহাজ থেকে ছাড় দেওয়ার অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। বন্দর দিয়ে গত জানুয়ারি মাসে ৬৬ হাজার ৩০ টন ছোলা, ৮ হাজার ৮৭৩ টন মটর ডাল, ৪৯ হাজার ১৪২ টন মসুর ডাল, ৮১ হাজার ৮৯৯ টন সয়াবিন তেল, ৫৬৬ টন পেঁয়াজ, ১১ হাজার ২৪২ টন রসুন, ৮ হাজার ৮২ টন মসলা, ৬ হাজার ১৬৯ টন খেজুর, ২৬ হাজার ১২১ টন তাজা ফল এবং ৮৪৫ টন শুকনো ফল আমদানি হয়েছে। ছোলা, খেজুর, মটর ডাল, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মসলা, তাজা ও শুকনো ফল আমদানি বেড়েছে ছোলা, খেজুর, মটর ডাল, মসুর ডাল, সয়াবিন তেল, সরিষার তেল, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, মসলা, তাজা ও শুকনো ফল আমদানি বেড়েছে। এর আগের মাসগুলোতে এত পরিমাণ পণ্য আমদানি হয়নি উল্লেখ করে শাহ আলম আরো বলেন, ‘গত ডিসেম্বরে ৬ হাজার ৬৪০ টন ছোলা, ৪৫ হাজার ২৬৭ টন মটর ডাল, ১৯ হাজার ৬১০ টন মসুর ডাল, ১০ হাজার ৮৯৬ টন সরিষার তেল, দুই লাখ ১১ হাজার ৭৪২ টন সয়াবিন তেল, ৮৮৮ টন পেঁয়াজ, ৩ হাজার ৫৯৫ টন রসুন, ৬ হাজার ১৬ টন খেজুর, ২ হাজার ৮৫৩ টন মসলা, ২৪ হাজার ৬০ টন তাজা ফল ও ১ হাজার ১০১ টন শুকনো ফল আমদানি হয়েছে।’

চট্টগ্রাম কাস্টমস সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে চিনি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৭০৭ দশমিক ১৭ টন, যা আগের বছর একই সময়ে আমদানি হয়েছিল ৮০ হাজার ২১২ টন। রমজান ঘিরে বেশিরভাগ ভোগ্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে।

আরো বেশি পণ্য আমদানি হবে জানিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টমসের উপকমিশনার মো. বদরুজ্জামান মুন্সী বলেন, রমজান ঘিরে নিত্যপণ্যের আমদানি বেড়েছে। অনেক পণ্য জাহাজ থেকে খালাস সম্পন্ন হয়েছে। কিছু পণ্য আছে খালাসের অপেক্ষায়। সামনের দিনগুলোয় আরো বেশি পণ্য আমদানি হবে।

পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, চাকতাই-খাতুনগঞ্জে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮৫ থেকে ৯৫, দেশি মসুর ডাল ১২৫, ভারতীয় মসুর ডাল ৯৫, চিনি ১৩২ থেকে ১৩৫, সয়াবিন তেল ১৬৫, পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ ও রসুন ১৮০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। কোনো পণ্যের ঘাটতি নেই। কিছু পণ্যের দাম কমেছে। সামনে বাড়ার কোনো কারণ নেই।

রমজান ঘিরে যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে এবং হচ্ছে, তাতে কারসাজি না হলে কোনো ভোগ্যপণ্যের সংকট হবে না রমজান ঘিরে যেসব পণ্য আমদানি হয়েছে এবং হচ্ছে তাতে কারসাজি না হলে কোনো ভোগ্যপণ্যের সংকট হবে না

কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না জানিয়ে চাকতাই-খাতুনগঞ্জের আড়তদার ব্যবসায়ী কল্যাণ সমিতির সাবেক সভাপতি সোলায়মান বাদশা বলেন, ‘রমজানে যেসব পণ্য প্রয়োজনীয়, বাজারে সেগুলো পর্যাপ্ত আছে। একইভাবে সরবরাহ ঠিক আছে। ফলে রমজানে নিত্যপণ্য সংকটের আশঙ্কা নেই। তবে গত বছরের তুলনায় এবার ছোলার দাম একটু বেশি। স্বাভাবিক আছে চাল-ডাল, তেল, আলু ও চিনিসহ সব পণ্যের দাম। ফলে কোনো পণ্যের দাম বাড়বে না বলে আশা করছি।’ নগরীর বহদ্দারহাট বাজারের খুচরা ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মানভেদে প্রতি কেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১২০ টাকা। এছাড়া দেশি মসুর ডাল ১৩৫ থেকে ১৪০, ভারতীয় মসুর ডাল ১১০, চিনি ১৪০, সয়াবিন তেল ১৬৮-১৭০, পেঁয়াজ ৯০-১০০, আলু ৩৫-৪০ ও রসুন ২৪০ টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। বাজারে ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ বেড়েছে উল্লেখ করে বহদ্দারহাট বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, এখন কোনো পণ্যের সংকট নেই। দামও নাগালের মধ্যেই আছে। এভাবে থাকলে রমজানে কোনো সমস্যা হবে না। তবে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মজুত কিংবা কৃত্রিম সংকট তৈরি করলে বাজারে অস্থিরতা দেখা দেবে। সেজন্য জেলা প্রশাসনকে সবসময় বাজার মনিটরিং করার অনুরোধ জানাই।