ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

আতঙ্ক বাড়ছে উখিয়ায় ঘুমধুম সীমান্ত শান্ত

* ঘুমধুম থেকে ১০০ বিজিপি সদস্যকে টেকনাফে স্থানান্তর * ঘুমধুম সীমান্তে অবিস্ফোরিত মর্টারশেল উদ্ধার
আতঙ্ক বাড়ছে উখিয়ায় ঘুমধুম সীমান্ত শান্ত

মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে ব্যাপক সংঘাত অব্যাহত রয়েছে। তবে, সীমান্তের বান্দরবান এলাকায় গুলির শব্দ কমে এসেছে। গত দুই দিন ধরে নাইক্ষ্যংছড়ির তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্ত ছিল শান্ত।

এতে করে কিছু আতঙ্ক কমেছে স্থানীয়দের মধ্যে। তবে কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের রহমতের বিল সীমান্তে রাতে আবারও গোলাগুলির শব্দ শোনা গেছে। গত বুধবার রাত ১১টা থেকে রাত ২টার মধ্যে এ গোলাগুলি হয়।

স্থানীয় লোকজন বলেন, গতকাল বৃহস্পতিবার গোলাগুলির শব্দের মধ্যে কয়েকটি মর্টারশেলের আওয়াজও ভেসে এসেছে। এতে নতুন করে আতঙ্ক দেখা দেয় স্থানীয়দের মধ্যে। থাইংখালীর এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, কয়েক দিন ধরে গুলির বিকট শব্দে ঘুমাতে পারি না। ঘুম থেকে উঠতে হয় চমকিয়ে চমকিয়ে। আমরা তো সীমান্ত থেকে দূরে। সীমান্ত এলাকার মানুষ এগুলো কীভাবে সহ্য করছে চিন্তা করে দেখেন। আবু বক্কর নামে এক ব্যক্তি বলেন, আমি যখন নামাজ আদায় করছিলাম, তখন গুলির বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে গিয়েছিলাম। এর আগে বুধবার (৭ ফেব্রুয়ারি) সীমান্ত পরিস্থিতি দেখতে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু ও ঘুমধুম সীমান্ত এবং তৎসংলগ্ন বিওপি পরিদর্শন করেন।

ঘুমধুম উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে সংবাদ সম্মেলনে বিজিবি প্রধান বলেন, তুমব্রু-ঘুমধুমে গোলাগুলির শব্দ কম শোনা যাচ্ছে। তুমব্রু-ঘুমধুম বিওপির বাইরে, অন্যান্য বিওপি এলাকায়ও সংঘাতের সম্ভাবনা আছে। সেখানে গোলাগুলি হয়েছেও, হচ্ছেও। তবে আমরা এখন থেকে মানুষকে আতঙ্কিত করতে চাই না। সীমান্ত এলাকার মানুষকে সরে যেতে বলছি না। যদি ঝুঁকিপূর্ণ এরকম অবস্থা হয়, তাহলে স্থানীয় প্রশাসনকে সাথে নিয়ে আমরা জনগণের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়, সেটা নিশ্চিত করব।

জানা গেছে, গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) সীমান্ত চৌকি তুমব্রু রাইট ক্যাম্প দখলকে কেন্দ্র করে বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিপির গোলাগুলি শুরু হয়।

গত রোববার এই চৌকিটি দখলে নেওয়ার পর দক্ষিণ-পশ্চিম অংশে অগ্রসর হয়ে ঢেঁকিবুনিয়া সীমান্ত চৌকি দখলে আক্রমণ শুরু করে আরাকান আর্মি। গত মঙ্গলবার সন্ধ্যা পর্যন্ত থেমে থেমে সংঘর্ষ চলে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর। সংঘর্ষে ঠিকতে না পেরে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশের সীমান্তে ঢুকে আশ্রয় নেয় সে দেশের ৩২৮ জন। যারা সে দেশের বিজিপি, সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, শুল্ক কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সংস্থার সদস্য।

স্থানীয় লোকজন বলেন, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসে। মাঝেমধ্যে কয়েকটি গুলির শব্দ শোনা গেলেও ভারী গোলাবর্ষণের আওয়াজ ছিল না। গতকাল বুধবার রাতে আবারও গুলি ও মর্টারশেলের আওয়াজ শোনা যাওয়ায় আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

পালংখালীর রহমতের বিল এলাকার গিয়াস উদ্দিন (৬৫) বলেন, ২৪ ঘণ্টার বেশি সময় মানুষ স্বস্তিতে ছিল। রাতে গুলির শব্দ শুনে অনেকের ঘুম ভেঙে গেছে। কেউ কেউ ঘর থেকে বের হয়ে এদিক-ওদিক যেতে থাকেন। তবে রাত ২টার পর আর কোনো গোলোযোগের খবর আসেনি।

স্থানীয় লোকজনের দাবি, গত বুধবার রাতের গোলাগুলি আরাকান আর্মির সঙ্গে বিজিপির হয়নি। সীমান্তের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও) ও মিয়ানমারের মংডুর বাসিন্দা স্বশস্ত্র সন্ত্রাসীগোষ্ঠী নবী হোছাইনের আরাকান রোহিঙ্গা আর্মির (এআরএ) মধ্যে হয়েছে। আরাকান আর্মির পক্ষে নেয়াকে কেন্দ্র করে আরএসও ও এআরএ নতুন করে বিবাদে জড়িয়েছে।

উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ১০-১২টা গুলির শব্দ ও ২-৩টি মর্টারশেলের আওয়াজ শোনা গেছে। এতে নতুন করে কিছুটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তবে মিয়ানমারের বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে সেদেশের বিজিপির সংঘর্ষ পালংখালী সীমান্ত অংশে থেমে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।

ঘুমধুম থেকে ১০০ বিজিপি সদস্যকে টেকনাফে স্থানান্তর

বান্দরবান ঘুমধুমে আশ্রয় নেওয়া ১০০ জন বিজিপি সদস্যকে টেকনাফের হ্নীলা উচ্চ বিদ্যালয়ে স্থানান্তর করছে বিজিবি। ওখানে বুধবার টেকনাফের উলুবনিয়া সীমান্ত দিয়ে আসা ৬৪ জন অবস্থান করছে আগে থেকেই।

গতকাল বিকালে ঘুমধুম ইউপির তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয়।

বান্দরবান পুলিশ সুপার সৈকত শাহীন বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, তুমব্রু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অবস্থানরত ১০০ জন বিজিপি সদস্যকে বিজিবি’র তত্ত্বাবধানে টেকনাফ হ্নীলাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তরের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলাম জানান, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সংঘর্ষের জেরে এখন পর্যন্ত ৩৩০ জন বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে ১০০ জনকে টেকনাফের হ্নীলাতে স্থানান্তর করা হয়েছে।

ঘুমধুম সীমান্তে অবিস্ফোরিত মর্টারশেল উদ্ধার : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্ত এলাকা থেকে একটি অবিস্ফোরিত মর্টারশেল উদ্ধার করা হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) দুপুর ১২টার দিকে ঘুমধুম ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড নোয়াপাড়া এলাকা থেকে এ মর্টারশেলটি উদ্ধার করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, দুপুরে নোয়াপাড়া এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় অবিস্ফোরিত মর্টারশেলটি দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা প্রশাসনকে খবর দেয়। পরে বিজিবির সদস্যরা এসে মর্টারশেলটি নিজেদের হেফাজতে নেয়।

ঘুমধুম ইউপি সদস্য আনোয়ার হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন। তিনি বলেছেন, ঘুমধুম নোয়াপাড়া থেকে মিয়ানমারের অবিস্ফোরিত মর্টারশেল উদ্ধারের ঘটনায় স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।

ঘুমধুম পুলিশ ফাঁড়ি তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ (আইসি) মাহফুজ ইমতিয়াজ ভুঁইয়া জানান, নোয়াপাড়া এলাকা থেকে অবিস্ফোরিত একটি মর্টারশেল উদ্ধার করেছে বিজিবি।

ঘুমধুমের আশ্রয় কেন্দ্র ছেড়েছে আশ্রিয়তরা : বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্রে কেউ নেই। গত বুধবার বিকালের মধ্যে আশ্রিত সব লোকজন আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে চলে গেছে।

গত মঙ্গলবার দুপুরে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্তঘেঁষা ঘুমধুম ইউনিয়নের ১, ২ ও ৩ নম্বর ওয়ার্ডের লোকজনকে সরিয়ে নেয় বান্দরবান জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন সরেজমিনে তুমব্রু-ঘুমধুম সীমান্ত পরিদর্শন শেষে সীমান্তঘেঁষা লোকজনকে সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।

গতকাল সকাল ১০টায় সরেজমিন দেখা যায়, উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টির অবস্থান ঘুমধুম ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডে।

বিদ্যালয়ে নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম চলছে। প্রধান শিক্ষক দীপন বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, গতকাল বুধবারের মধ্যে বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেয়া সব লোকজন চলে গেছে। বিদ্যালয়ে সীমান্তঘেঁষা এলাকার আতঙ্কিত লোকজন অবস্থান করায় গত মঙ্গলবার শ্রেণি কার্যক্রম বন্ধ ছিল।

ঘুমধুম ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) কার্যালয় সূত্র জানায়, মিয়ানমারের তুমব্রু রাইট ক্যাম্প ও ঢেঁকিবনিয়া সীমান্ত চৌকি দখলকে ঘিরে সে দেশের বিদ্রোহীগোষ্ঠী আরাকান আর্মির সঙ্গে বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) তুমুল সংঘর্ষ শুরু হয় গত শনিবার দিবাগত রাত ৩টা থেকে। এরপর থেকে ঘুমধুমের পশ্চিমকুল, উত্তরপাড়া, হিন্দুপাড়া, কোনারপাড়া, জলপাইতলী, মধ্যমপাড়া, মণ্ডলপাড়া, নয়াপাড়া এলাকার মানুষজন ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে শুরু করে। সর্বশেষ মঙ্গলবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের নির্দেশে মাইকিং করে ঝুঁকির মধ্যে থাকা লোকজনকে সরিয়ে উত্তর ঘুমধুম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘুমধুমের ইউপি সদস্য দিল মোহাম্মদ ভুট্টো বলেন, সীমান্ত এলাকার ২৭ পরিবারের ১৩৭ জন আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত হয়ে আসায় আশ্রিতরা গত বুধবার চলে যান। পশ্চিমকুলের বাসিন্দা কুলছুমা বেগম তার দুই শিশুসন্তান নিয়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছিলেন। তিনি বলেন, আশ্রয়কেন্দ্রে থাকতে ভালো লাগে না। বাচ্চারা ছোট। রাতে তীব্র শীতে তাদের অবস্থা কাহিল হয়ে গিয়েছিল। এছাড়া গত দুই দিন আমাদের এলাকায় গোলাবারুদ পড়েনি। ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ বলেন, লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র থাকতে চান না, বিশেষ করে আশ্রয় কেন্দ্রে। পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে এলে লোকজন এলাকায় চলে আসেন। অনেকে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতেও চলে যান। অনেকে খেত-খামারের কাজে লেগে যান। চেয়ারম্যান বলেন, ঘুমধুম সীমান্ত এখন শান্ত। মানুষের মাঝেও আতঙ্ক অনেকটা কমে এসেছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত