পার্লামেন্ট নির্বাচন

পাকিস্তানেও বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার

* ভোটের দিনে ৫১টি হামলা * নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি * সহিংসতায় পুলিশসহ নিহত ১২ * মোবাইল, ইন্টারনেট ও সীমান্ত বন্ধ

প্রকাশ : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

সব ধরনের জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে পাকিস্তানে গত বৃহস্পতিবার পার্লামেন্ট নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্মকাণ্ড নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা উঠেছে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে অন্তত ৪০ জন নিহতের খবর পাওয়া গেছে। এমনকি ভোটগ্রহণ বন্ধ হওয়ার ১৪ ঘণ্টা পরও গণনা শেষ করতে পারেনি। এতে দেশটির তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা।

রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে কয়েক মাস বিলম্ব শেষে দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে পার্লামেন্টের ২৬৫টি আসন ছাড়াও প্রাদেশিক পরিষদের ৫৯০টি আসনে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক প্রার্থীর মৃত্যুর কারণে ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির একটি আসন এবং তিনটি প্রাদেশিক আসনের ভোট স্থগিত করা হয়। নির্বাচনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ যে জয় পাবেন সেটি আগে থেকেই ধারণা করা হচ্ছিল। বিশ্লেষকদের ধারণা, তার পেছনে যেমন সামরিক বাহিনী আছে, তেমনি প্রভাবশালী রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রেরও হাত থাকতে পারে। নির্বাচন নিয়ে নানা অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা।

জানা গেছে, দেশটির জাতীয় নির্বাচনের জন্য সংসদ ভেঙে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু নির্বাচন কেন্দ্র করে পাকিস্তানে নানা ধরনের গোলযোগ সৃষ্টি হয়। টেলিযোগাযোগ ও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখায় বিতর্কিত হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ছাড়া এ নির্বাচন। ভোটগ্রহণ ঘিরে সারা দেশে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছে। এতে নির্বাচনের দিনে নিহত হয়েছেন অন্তত ১২ জন। গত বৃহস্পতিবার নির্বাচনে প্রায় ১৮ হাজার প্রার্থী অংশগ্রহণ করেন। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও চারটি প্রাদেশিক পরিষদে ভোটের লড়াইয়ে অংশ নেন তারা। জাতীয় পরিষদে ২৬৬ আসনে ভোটগ্রহণ করা হয়েছে। পরিষদের অতিরিক্ত ৭০টি আসন নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য নির্ধারিত। প্রাদেশিক পরিষদে মোট ৭৪৯টি আসন রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে ভোটে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভের সম্ভাবনা রয়েছে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন)। তবে এ নির্বাচনে অংশ নিতে পারেননি পাকিস্তানে তুমুল জনপ্রিয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) নেতা ইমরান খান। একাধিক মামলায় সাজা পেয়ে তিনি এখন কারাগারে। তার দলের নেতাকর্মীরাও দমন-পীড়ন ও মামলায়-হামলায় বিপর্যস্ত। নিজেদের দলীয় প্রতীক না পেয়ে তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনের মাঠে নেমেছেন। এমন পরিস্থিতিতে ভোটে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়লাভের সম্ভাবনা রয়েছে পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন)। দলটির নেতা নওয়াজ শরিফের প্রতি দেশটির প্রভাবশালী সামরিক বাহিনীর সমর্থন রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রকারান্তরে সেনা নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে পাকিস্তানের নির্বাচনকালীন সরকার। আবার অনেকে এও বলে থাকেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন আয়োজনে ব্যর্থ হলে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে নিতে পারে।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে পাকিস্তানে ভোটগ্রহণ শুরু হয় গত বৃহস্পতিবার সকাল ৮টায়, চলে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। পাকিস্তানের ২৪ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ভোটার ১২ কোটি ৮০ লাখের মতো। তবে ব্যাপক নিরাপত্তার চাদরে ঘেরা এ নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি ছিল কম। নির্বাচনে ইমরান খানের অনুপস্থিতি ভোটার উপস্থিতি কম হওয়ার একটি কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা নিয়ে দেশটির নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত দুই দিন পর্যন্ত জাতীয় নির্বাচনের ফল ঘোষণা করতে পারেনি তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

পার্লামেন্ট নির্বাচন নিয়ে গতকাল শুক্রবার পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন বলেছিল, তারা ‘তাৎক্ষণিক ফলাফল ঘোষণা নিশ্চিত করার নির্দেশনা দিয়েছেন। তবে ভোট গণনা ঠিক কখন শেষ হবে সে বিষয়ে নির্দিষ্ট কোনও আপডেট জানানো হয়নি। ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের ৯ ফেব্রুয়ারি ভোররাত ২টার মধ্যে কমিশনে ফলাফল পাঠানোর বিষয়ে বলা হলেও সেটি করা হয়নি। ভোটের ফলাফল গণনায় এত দেরি হওয়ায় কারচুটির অভিযোগ করেছেন। এরইমধ্যে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছে ইমরানের দল। দলটির মতে, ফলাফল প্রকাশে বিলম্ব হওয়া ভোট কারচুপির লক্ষণ। নির্বাচনের আগে ইমরান ও তার দলকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল দেশটির আদালত। তাই এবারের নির্বাচনে পিটিআইকে স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী দিতে হয়েছিল। পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদনটি গতকাল সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত নির্বাচনি ফলাফলে দেশটির নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে জাতীয় পরিষদের ১৪৮ আসনের ফল ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৬১টি আসনে জয়ী হয়েছেন। যার বেশির ভাগই ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক ই ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থিত প্রার্থী। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লিগ (পিএমএল-এন) পেয়েছে ৪৩ আসন। আর বিলাওয়ালের পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছে ৩৮ আসন। এর বাইরে এমকিউএম চারটি, জেইউআই (পি) একটি ও পিএমএল একটি আসনে জয় পেয়েছে।

পাকিস্তানের নির্বাচন ঘিরে গত বুধবার বেলুচিস্তান প্রদেশে প্রার্থীদের কার্যালয়ের বাইরে ভয়াবহ বোমা বিস্ফোরণে অন্তত ২৮ জন নিহত হন। আহত হন ৪০ জনের বেশি। নির্বাচন ঘিরে পাকিস্তানে ৬ লাখ ৫০ হাজারের বেশি নিরাপত্তারক্ষী মোতায়েন ছিল। এরপরও সারা দেশে সহিংসতায় অন্তত ১২ জন নিহত ও ৩৯ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির সামরিক বাহিনী। এক বিবৃতিতে তারা বলেছে, নির্বাচনের দিন সারা দেশে ৫১টি হামলা হয়েছে। হামলার বেশি ঘটনা ঘটেছে খাইবার পাখতুনখাওয়া ও বেলুচিস্তান প্রদেশে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যই বেশি।

এ নিয়ে পাকিস্তানের প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) সিকান্দার সুলতান রাজা বলেন, নিরাপদ পরিবেশে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করতে ইন্টারনেট ও মুঠোফোন সেবা বন্ধের সিদ্ধান্ত নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে ছিল। অন্যদিকে ইন্টারনেট সেবা বন্ধের মাধ্যমে ভোটের দিনের কারচুপি শুরু হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন পিপিপি সাবেক সিনেটর মুস্তফা খোখার। এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে পাকিস্তানের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনও।

অতীতে পাকিস্তানের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সব নির্বাচন নিয়ে পক্ষপাতদুষ্ট, অগণতান্ত্রিক বলে ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার আগে-পরে ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। বাধ্য হয়ে, সামরিক ও বিচার বিভাগের সম্মুখীন হয়েছে। সেনা শাসকের মনমানসিকতা নিয়ে বরাবরেই পাকিস্তান বেড়ে উঠেছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেখা গেছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিন মাসের দায়িত্ব গ্রহণ করে দুই বছর পর্যন্ত ছিল। আওয়ামী লীগ-বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করে রাজনীতিতে টালমাটাল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্তমানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনর্বহালের দাবি প্রত্যাখ্যানের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় প্রভাবক হয়ে থাকতে পারে।

বাংলাদেশে তিন মাসের জন্য ২০০৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল। সেই সরকার ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কার্যত দেশ শাসন করেছিল। রাজনৈতিক দলগুলো বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আড়ালে স্বৈরশাসনের দেখা মেলে। বর্তমানে সংবিধানস্বীকৃত নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন থাকার পরও বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতি দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করার দাবি করা মূলত ওই দেশের সংবিধানকে অমান্য করার সমতুল্য।

দেশের সংবিধানকে অমান্য করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করে বাংলাদেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব কোনোভাবেই সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত হতে পারে না। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অসাড়তার তিক্ত ইতিহাস তুলে ধরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাবেক কমিশনার ইয়ান ফিজেল বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হলে ঘটনাক্রমে তা স্বৈরশাসকের হাতে চলে যায়। ইয়ান ফিজেলের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার এমন একটি ব্যবস্থা, যা বিশ্বের আর কোথাও নেই। ২০১১ সালে বাংলাদেশের সুপ্রিমকোর্ট এ ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক বলে রায় দেন। এমতাবস্থায় বাংলাদেশের মতো একটি গণতান্ত্রিক দেশে সাংবিধানিক ভিত্তিহীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে পাকিস্তানের মতো সরকারব্যবস্থা কোনোভাবেই কাম্য নয়।