ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পাল্টাপাল্টি জয়ের দাবি

পাকিস্তানে সেনা শাসনের পদধ্বনি!

পাকিস্তানে সেনা শাসনের পদধ্বনি!

পাকিস্তানের জনগণের দুর্দশা বেড়েই চলেছে। দেশটির পার্লামেন্ট নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে নির্বাচনি ফলাফল মানতে নারাজ বড় দুই রাজনৈতিক দল- পিটিআই ও পিএমএলএন। এ নিয়ে দেশটির ভেতরে বড় ধরনের সহিংসতার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। আর সেই আশঙ্কা থেকেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় শাসন ক্ষমতায় সেনাবাহিনী হাতে চলে যেতে পারে।

পাকিস্তানের গণমাধ্যম ডন জানিয়েছে, পাকিস্তানে ২৬৪টি আসনের মধ্যে তেহরিক-ই ইনসাফ (পিটিআই) ৯২টি, মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন) ৭১টি, পিপলস পার্টি (পিপিপি) ৫৪টি, জেইউআই-এফ তিনটি এবং অন্যান্য দল ৩৩টি আসনে জয়লাভ করেছে। পাকিস্তানের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার দুই দিন পেরিয়ে গেলেও পূর্ণাঙ্গ ফল প্রকাশ করতে পারেনি দেশটির নির্বাচন কমিশন (ইসিপি)।

নির্বাচনি ফলাফল ঘোষণার আগেই গতকাল পাকিস্তানিদের সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির বলেছেন, পাকিস্তানকে ‘অরাজকতা এবং মেরুকরণের’ রাজনীতি থেকে সরে আসতে হবে। সামরিক বাহিনীর এক বিবৃতিতে জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনির বলেছেন, ২৫ কোটি মানুষের একটি প্রগতিশীল দেশের নৈরাজ্য ও মেরুকরণের রাজনীতি উপযুক্ত নয়। এর থেকে বের হয়ে আসতে জাতির একটি দৃঢ় হাত এবং উত্তোরণের প্রয়াস দরকার।

বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, নির্বাচন জয়-পরাজয়ের একটি শূন্য-সমষ্টির প্রতিযোগিতা নয় বরং এটি ভোটদানের মাধ্যমে জনগণের আগ্রহ জানার একটি অনুশীলন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং তাদের কর্মীদের স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে জনগণের শাসন ও সেবা করার প্রচেষ্টাকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। এটিই গণতন্ত্রকে কার্যকরী এবং উদ্দেশ্যমূলক করার একমাত্র উপায়। জিও নিউজের খবর অনুসারে, দেশটির কারাবন্দি সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা বেশি জয় করেছে বলে দাবি করেছে দলটি। এই স্বতন্ত্র প্রার্থীদের নিয়ে পিটিআই সরকার গঠনের পরিকল্পনা করছে বলে গতকাল দলটির চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার গোহর খান ঘোষণা দিয়েছেন। একই সঙ্গে নির্বাচনের চূড়ান্ত ফল শনিবার মাঝরাতে ঘোষণা না করলে পিটিআই দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভণ্ডপ্রতিবাদ করবে। অন্যদিকে নওয়াজ শরিফের পিএমএলএন দাবি করছে, তাদের সমর্থিত প্রার্থীরাই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসনে জয়ী হয়েছে। নওয়াজ শরিফ দাবি করছেন, একক বৃহত্তম দল পিএমএলএন। এমন পরিস্থিতিতে কারা সরকার গঠন করবে এখনও স্পষ্ট হয়নি।

আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, পাকিস্তান পার্লামেন্টে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ থেকে কখনই বের হতে পারেনি। এবারের নির্বাচনে পুরো বিষয়ে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। দেশটির ভেতরে ও বাইরে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন জনগণ। নির্বাচনের রাজনৈতিক অস্থিরতা আর দমন-পীড়নের ঘটনাগুলো আগামীতে সহিংসতার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। অথ্যাৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়, এটি পাকিস্তানের নির্বাচনে আবারও প্রমাণ হয়েছে। সুতরাং, রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমতের ভিত্তিতে এমনটি একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের দরকার ছিল, যেখানে সামরিক শাসনের আশঙ্কা নেই।

জানা গেছে, পাকিস্তানে সরকার গঠনের জন্য ২৬৪টি আসনের মধ্যে ২৩৪টিতে জয়লাভ করতে হয়। ফলে কোনো দলই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারেনি। কয়েকটি আসনের ফল ঘোষণা এখনো বাকি থাকলেও সেগুলোতে জয়ী হয়েও কোনো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে না। নির্বাচনে একক বৃহত্তম দল ও জয়ের দাবি করে সমর্থকদের উদ্দেশে ‘বিজয় ভাষণ’ দিয়েছেন পাকিস্তানের তিনবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা পিএমএলএন নেতা নওয়াজ শরিফ। ভোটের পর পিএমএল-এন দেশের একক বৃহত্তম দল। দেশকে সংকট থেকে উত্তরণের দায়িত্ব তার দলের। আমাদের একমাত্র এজেন্ডা সমৃদ্ধ পাকিস্তান। সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী স্বীকার করেছেন যে তার দল পিএমএল-এন এককভাবে সরকার গঠনে প্রয়োজনীয় আসনে জয়ী হতে পারেনি। জোট সরকার গঠনে অপর দলগুলোকে তিনি আমন্ত্রণ জানাবেন। তিনি চান পাকিস্তানকে পাল্টে দিতে অপর দলগুলোর সঙ্গে সম্প্রীতির আলোকে বসতে। নওয়াজের এমন দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন ইমরান খানের পিটিআই দলের নেতারা। দলটির নেতা আসাদ কায়সার বলেছেন, কেন্দ্রে সর্বোচ্চ আসন পেয়েছেন পিটিআই সমর্থিতরা। পিএমএলএন নেতার বিজয় ভাষণ দেয়ার কোনো অধিকার নেই। জাতীয় পরিষদের সাবেক এই স্পিকার বলেছেন, পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন প্রকাশিত ফলাফল অনুসারে পিটিআই হলো বৃহত্তম দল। জনগণ পিএমএলএনকে প্রত্যাখ্যান করেছে এবং ইমরান খানকে বেছে নিয়েছে। কারচুপির নির্বাচনে ফলাফল পাল্টে দেয়া হয়েছে। রাষ্ট্র যন্ত্রকে তাদের বিরুদ্ধে কাজে লাগানো পরও তারা শীর্ষে রয়েছেন। আসাদ কায়সার বলেছেন, তার দল সরকার গঠনের জন্য বিভিন্ন বিকল্পের কথা বিবেচনা করছে এবং আজ একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে। কেন্দ্র এবং পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখোয়াতে আমাদের সরকার গঠনের চেষ্টা করছি। আমাদের বৈঠক আছে এবং ইমরান খানের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টা করছি। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেব।

তিনি আরো বলেছেন, আমরা দলের ভেতরে নির্বাচনের কথাও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছি। আদালতের কাছেও যাওয়া হবে। দেখা যাক আমাদের জন্য উপযুক্ত কী হয়। দলটির মুখপাত্র রাউফ হাসান বলেছেন, সরকার থেকে তাদের দলকে দূরে রাখতে রাজনৈতিক কারসাজির পরও পিটিআই কারচুপির নির্বাচনেও নৈতিক জয় নিশ্চিত করতে পেরেছে। তিনি বলেন, আমরা নির্বাচন জিতে গেছি। তারা ছলাকলার মাধ্যমের আমাদের কাছ থেকে তা কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু আমরা নৈতিক জয় নিশ্চিত করেছি। ভোটে কারচুপির বিষয় নিয়ে ট্রাইব্যুনাল আদালত ও ঊর্ধ্বতন আদালতে যাওয়ার কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি।

ডন’র খবরে বলা হয়েছে, ভোটে পিটিআইয়ের সাফল্যের পরও বেশ কিছু প্রতিকূলতা রয়েছে দলটির। নির্বাচন কমিশন কর্তৃক দলটির প্রতীক কেড়ে নেয়া এবং শীর্ষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন স্তরের নেতাদের কারাগারে পাঠানো ও মামলা রয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে সর্বোচ্চসংখ্যক আসন পেলেও তারা হয়তো সরকার গঠন করতে পারবে না। কারণ, স্বতন্ত্র হিসেবে তারা সংখ্যালঘুদের আসনের ভাগ পাবে না। এই বিষয়ে পাকিস্তানি সাংবাদিক উসাতুল্লাহ খান বলেছেন, এর আগে জেনারেল জিয়াউল হকের সময়ে পুরো পার্লামেন্ট তৈরি হয়েছিল স্বতন্ত্রদের দিয়ে। ১৯৮৫ সালে নির্দলীয় নির্বাচন ছিল। কোনও দল নির্বাচনে তাদের প্রার্থীদের অংশ নিতে দেয়নি। ভোট হয়েছিল স্বতন্ত্রভাবে। যদিও সবার প্রতি কোনো না কোনও দলের সমর্থন ছিল, কিন্তু কাগজে কলমে তারা ছিলেন স্বতন্ত্র। তিনি বলেন, জয়ীরা পার্লামেন্টে এসে দলের নাম দেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ, যা এখন পিএমএল-এন ও পিএমএল-কিউ নামে পরিচিত। এর আগে ছাত্তা লিগ বলেও পরিচিত ছিল।

এ বিষয়ে সাংবাদিক জারার খুরো বলেছেন, ইমরান খান ও তার দলের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক পদক্ষেপের বিচারে আমি মনে করি না খুব দ্রুত পিটিআই কোনো অলৌকিক স্বস্তি পাবে। আইনে যা-ই থাকুক না কেন। তবে কিছুটা আশাবাদী আইনজীবী আবদুল মইজ জাফেরি। তিনি বলেছেন, ইসিপি নির্বাচনি প্রতীক কেড়ে নিলেও পিটিআইয়ের নিবন্ধন বাতিল করেনি। আইনত পিটিআই একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে বিদ্যমান রয়েছে। সব আসনে এক প্রতীকে দলটির প্রার্থীরা লড়াই করতে না পারলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে অস্তিত্ব প্রভাবিত হয়নি। দলটি বিলুপ্ত হয়নি। সাংবাদিক জারার খুরো বলছেন, অনেকেই তাদের সঙ্গে আসতে চাইবে। সব স্বতন্ত্রদের নিয়ে আমি ঢালাও মন্তব্য করতে চাইছি না। অঞ্চল ভেদে পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। খাইবার পাখতুনখোয়াতে পক্ষত্যাগকারীরা জনগণের খুব কঠোর প্রতিক্রিয়ার মুখে পড়বেন। পাঞ্জাবের দক্ষিণে হয়তো পরিস্থিতি অন্যরকম হবে। এখানে হয়তো কয়েকজন স্বতন্ত্র বিজয়ীদের সমর্থন পেয়ে যেতে পারে পিএমএলএন। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা পাকিস্তানের আগামী সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যের ফাটল ধরেছে। এই সুযোগে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পাকিস্তানের ইতিহাস বলেছে, দেশ বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এক বছরের মাথায় দেশটির প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ মারা যান। তখনকার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের গুলিতে নিহত হওয়া। এই দুই মৃত্যু পাকিস্তানের রাজনীতিতে নেতৃত্বের শূন্যতা তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে কাশ্মীর নিয়ে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ দেশটিতে নিরাপত্তা সংকটও তৈরি করে। দেশটির সেনাবাহিনী নিরাপত্তা এবং বিদেশ নীতিতে ভূমিকা রাখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে। কারণ, তারা রাজনৈতিক নেতৃত্বের গৃহীত পদক্ষেপে সন্তুষ্ট ছিল না। দেশটির রাজনৈতিক নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ নিজেও শুরু থেকেই গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে না নিয়ে এক ধরনের কর্তৃত্ববাদী শাসনের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। যেটা পরে দেশে অনৈক্য তৈরি করে। এই সব কিছু মিলেই পাকিস্তানে এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, যেটা দেশটির সেনাবাহিনীকে রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের সুযোগ তৈরি করে দেয়।

লন্ডনের কিংস কলেজের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি ও সামরিক বিষয়ের গবেষক ড. আয়েশা সিদ্দিকা বলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুরুর দিকেই যখন রাজনৈতিক নেতৃত্বে দুর্বলতা এবং অনৈক্য স্পষ্ট হচ্ছিল, তখন এর বিপরীতে প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশটির সামরিক বাহিনী ছিল এককভাবে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। এমনটা হলে সামরিক শক্তির ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি হয়। পাকিস্তানেও সেটা হয়েছিল।

তিনি আরো বলেন, পাকিস্তানে রাষ্ট্র কাঠামোয় সেনাশক্তি প্রথম আসে ১৯৫৪ সালে। তখন দেশটির প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বানানো হয়েছিল, সেনাপ্রধান আইয়ুব খানকে। এই আইয়ুব খানই ১৯৫৮ সালে দেশটির ক্ষমতা দখল করে নেন। সেখান থেকেই এটার শুরু হয়েছে।

প্রসঙ্গত, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিভিন্ন সময় অন্তত তিন দশক সরাসরি সেনা শাসনের মধ্যে কাটিয়েছে, বাকি সময়টাও পর্দার অন্তরালে থেকে সেনাবাহিনীই রাজনীতি নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রেখেছে। এবারের নির্বাচনে ইমরান খানকে নিয়ে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর একটা আশঙ্কা হচ্ছে, যদি তিনি ক্ষমতায় ফিরে আসেন, তাহলে সেনাবাহিনীর কর্পোরেট স্বার্থ হুমকির মুখে পড়বে। কারণ, ইমরান খান যে বিষয়টা ব্যাপকভাবে জনগণের মধ্যে এস্টাবলিশ করতে পেরেছেন, সেটা হচ্ছে সেনাবাহিনীর ক্ষমতার প্রশ্নটা মীমাংসা করা। এটা নিয়ে আসলে আমার কাছে মনে হয় প্রতিষ্ঠান হিসেবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী অনেক বেশি উদ্বিগ্ন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত