২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই পার্লামেন্ট অধিবেশন

সরকার গঠনের স্বপ্ন পূরণে স্বেচ্ছাচারিতা

সাংবিধানিক জটিলতায় পাকিস্তানের রাজনীতি

প্রকাশ : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

পাকিস্তানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের পর থেকেই সরকার গঠনে দেশটিতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দল সংখ্যাগরিষ্ঠ বিজয় লাভ করতে পারেনি। সেজন্য জোটের ওপর ভিত্তি করে আগামীর পার্লামেন্ট গঠনের চেষ্টা চালাচ্ছে বড় দুই রাজনৈতিক দল। এতেও সাংবিধানিক জটিলতা তৈরি হয়েছে। এক ধরনের স্বেচ্ছাচারিতা দেখা দিয়েছে পাকিস্তানে।

জানা গেছে, সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতায় ২৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পাকিস্তানে পার্লামেন্টের নতুন অধিবেশন আহ্বান করতে হবে। দেশটির সংবিধান অনুযায়ী, ওইদিনের মধ্যেই নতুন অধিবেশন আহ্বান করতে বাধ্য প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। নবনির্বাচিত সদস্যদের স্বাগত জানাতে সমস্ত ব্যবস্থা নিয়েছে জাতীয় পরিষদ সচিবালয়।

সংবিধানের ৯১(২) ধারা অনুযায়ী, নির্বাচনি ফলাফলের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বা প্রজ্ঞাপন জারির পর ২১ দিনের মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করতে হবে প্রেসিডেন্টকে।

যদি এর আগে প্রেসিডেন্ট নতুন অধিবেশন আহ্বান না করেন, তাহলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার দিন থেকে পরবর্তী ২১তম দিনে অধিবেশন আহ্বানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া ১ ও ২ মার্চ যথাক্রমে নতুন স্পিকার ও প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে হবে। তাই এর আগেই বিজয়ী দলকে সরকার গঠন করেতে হবে। নির্বাচন আইন ২০১৭ (২০২৩ সালে সংশোধিত) এর ধারা ৯৮ অনুসারে, নির্বাচনের ১৪ দিনের মধ্যে ইসিপিকে আনুষ্ঠানিক ফলাফল ঘোষণা করতে হবে। ফল ঘোষণার তিন দিনের মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের কোনো একটা দলে যোগ দিতে হবে। আর চতুর্থ দিন সংরক্ষিত আসনে নারী সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

কারাবন্দি ইমরানের সমর্থকরা পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দলের সমর্থন পাওয়া স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ভোট দিয়েছেন। কিন্তু এতে দেশটির রাজনৈতিক ব্যবস্থার অনিশ্চয়তা দূর হয়নি। বেশকিছু আসনে নির্বাচনের ফলাফল চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যাচ্ছেন ইমরান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। ভোট গণনায় ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ স্বীকার করার জন্য পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের ওপরও চাপ বাড়ছে।

বেসরকারি ফল অনুসারে, ইমরান সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৯২টি আসনে জয়ী হয়েছেন। তবে কয়েকটি পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যমে এই সংখ্যা ১০১ বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) জয়ী হয়েছে ৭৭ আসনে। আর বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারির পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) পেয়েছে ৫৪টি আসন। অন্যান্য দলের মধ্যে পাকিস্তান মুসলিম লীগ (পিএমএল) ৩টি, জামিয়াত উলামা-ই-ইসলাম পাকিস্তান (জেইউআই-পি) ৪টি, ইশতেহ্কাম-ই-পাকিস্তান (আইপিপি) ও বেলুচিস্তান ন্যাশনাল পার্টি (বিএনপি) ২টি করে, মজলিশ ওয়াহ্দাত-ই-মুসলিমীন পাকিস্তান (এমডব্লিওএমপি), পাকিস্তান মুসলিম লীগ- জিয়া (পিএমএল-জেড), পাশতুনখাওায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি পাকিস্তান (পিএনএপিপি), বেলুচিস্তান আওয়ামী পার্টি (বিএপি), ন্যাশনাল পার্টি (এনপি) ও পাশতুনখাওয়া মিলি আওয়ামী পার্টি (পিএমএপি) একটি করে আসনে জয়ী হয়েছে।

৩৩৬ আসনের জাতীয় পরিষদে সরকার গঠন করতে অন্তত ১৬৯টি আসনের প্রয়োজন। পাকিস্তানের সংবিধান অনুসারে, ভোটের ২১ দিনের মধ্যে পার্লামেন্টের নেতা ও পরে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের জন্য অধিবেশন আহ্বান করতে হবে। ইমরান সমর্থিত প্রার্থীরা পর্যাপ্ত সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করায় নতুন সরকার গঠনে নানা সমীকরণ ও তোড়জোড় শুরু হয়েছে।

নওয়াজ শরিফের দল পিএমএলএন পিপিপি ও ছোট মুত্তাহিদা কওমি মুভমেন্ট (এমকিউএম)-এর সঙ্গে জোট গঠন করে সরকার গঠনের দায়িত্ব নিতে চাইছে। এমকিউএম এবার ১৭টি আসনে জয় পেয়েছে। সরকার গঠনে নওয়াজের সামনে আরেকটি পথ রয়েছে। আর তা হচ্ছে, পর্যাপ্ত সংখ্যক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে দলে ভিড়ানো, যাতে পিপিপির সঙ্গে তার দলের জোট গঠন করতে না হয়। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ পিএমএল-এন দলের আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। কিন্তু নিশ্চিত নয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারা বিপুল জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানকে বিরোধিতা করা জোটের নেতা কে হবেন।

প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফ একজন গ্রহণযোগ্য নেতা। ২০২২ সালের এপ্রিলে ইমরানকে উৎখাতের পর একই ধরনের জোটের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তিনি। সেনাবাহিনীর কাছে নওয়াজের চেয়ে শাহবাজ বেশি পছন্দের। কারণ নওয়াজ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকালে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়েছিলেন।

ইমরান সমর্থিত স্বতন্ত্র বিজয়ী প্রার্থীরাও একটি জোট সরকার গঠনের চেষ্টা করছেন। যদিও তাদের সম্ভবত সেনাবাহিনীর বিরোধিতায় পড়তে হতে পারে। মনে করা হয়, সেনাবাহিনী পিএমএলএন-পিপিপি জোট পছন্দ করে। ইমরানের দল নির্বাচনে না থাকায় তাদের প্রতি সমর্থন আছে এমন একটি দলে স্বতন্ত্র জয়ীদের যোগদান করতে হবে।

কী করবে সেনাবাহিনী : নির্বাচনে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জনগণের অবস্থান সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরের ওপর নিশ্চিতভাবে চাপ তৈরি করবে। সেনাপ্রধানকে এখন অবশ্যই সিদ্ধান্ত নিতে হবে ইমরানের সঙ্গে বিরোধ মিটিয়ে ফেলা বা দ্বিধা ছাড়া এগিয়ে যাওয়া এবং খানবিরোধী রাজনীতিকদের একটি জোট গঠনে বাধ্য করা।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, এমন জোট সরকার হবে দুর্বল এবং টেকসই হবে না। এদিকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল মুনির ঐক্য ও স্বাভাবিকতার ডাক দিয়েছেন। অনেকে তার এই বক্তব্যকে ইমরান খানের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুতির ইঙ্গিত হিসেবে ধরে নিচ্ছেন।

এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সাউথ এশিয়া ইনিশিয়েটিভের পরিচালক ফারওয়া আমের বলেছেন, সেনাপ্রধান যে পথ বেছে নেন না কেন, প্রভাবশালী সেনাবাহিনী হয়তো জনসমর্থন হারাবে। সামরিক কাঠামোর জন্য ইমরান খানকে কারাগারে রাখা কঠিন কাজ হবে। ভোটে তার রাজনৈতিক বিজয়ে তাকে জামিনে মুক্তি দিতে চাপ বাড়বে। বিশেষ করে যেসব মামলায় ভোটের আগমুহূর্তে দোষী সাব্যস্ত করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। গত শনিবার ইমরানকে বেশ কয়েকটি মামলায় জামিন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলা রয়েছে সেনাবাহিনীর স্থাপনায় তার সমর্থকদের হামলার ঘটনায়। কিন্তু এখনও অন্যান্য মামলায় দোষী সাব্যস্ত হয়ে কয়েক দশক কারাদণ্ডের মুখে রয়েছেন।

কয়েকজন বিশ্লেষক বর্তমান পরিস্থিতিকে ১৯৮৮ সালের সঙ্গে তুলনা করছেন। ওই সময় সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর বিরোধিতা মোকাবিলা করে বেনজির ভুট্টো নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন। মার্কিন চাপে অনিচ্ছায় বেনজির ভুট্টোকে সরকার গঠন করতে দেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। পররাষ্ট্রনীতি বা দেশটির পারমাণবিক অস্ত্রনীতিতে তার কথা বলার কোনো এখতিয়ার ছিল না। শেষপর্যন্ত তিনি পুরো মেয়াদ দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। ১৯৯০ সালে দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগে তার সরকার উৎখাত হয়।

পিএমএল-এনের এক বিবৃতিতে বলা হয়, পরবর্তী সরকার গঠনে একসঙ্গে কাজ করার ব্যাপারে দুই দলই প্রাথমিকভাবে সম্মত হয়েছে। যদিও বৈঠক শেষ হওয়ার পরই এমকিউএম-পি দলের আহ্বায়ক খালিদ মকবুল সিদ্দিকি বলেছেন, বৈঠকে এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। বৈঠকে নওয়াজ শরিফ পিএমএল-এনের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। আর এমকিউএম-পির প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন খালিদ মকবুল সিদ্দিকি।

গণমাধ্যমকর্মীদের এমকিউএম-পির আহ্বায়ক খালিদ মকবুল বলেন, নির্বাচনের পর চ্যালেঞ্জের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতি থেকে দেশকে বের করে আনতে সব দলকে অবশ্যই নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে। অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে গণতান্ত্রিক স্থিতিশীলতা বেশি জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

খালিদ মকবুল আরো বলেন, পরবর্তী সরকার গঠনের বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয়নি। এমকিউএম-পি ভবিষ্যৎ সরকারের অংশ হবে কি না, তা বলার সময় এখনো আসেনি বলে উল্লেখ করেন তিনি।

গত বৃহস্পতিবার পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের (ইসিপি) ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, জাতীয় পরিষদে ২৬৬ আসনের মধ্যে (একটিতে নির্বাচন স্থগিত) সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সবচেয়ে বেশি ১০১ আসনে জয় পেয়েছেন। এরপর ৭৫ আসন নিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে নওয়াজের দল পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) এবং ৫৪ আসন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি)।

রাষ্ট্রপতি-স্পিকারের পদ ছেড়ে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী হতে চান নওয়াজ শরিফের দল পিএমএল-এন বিলাওয়াল ভুট্টোর দল পিপিপি’র সঙ্গে সরকার গঠন নিয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করেছে। নিজেদের প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করতে পিপিপি ইসলামাবাদে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির বৈঠক করবে।

পাকিস্তানের প্রভাবশালী সংবাদ মাধ্যম ডন পিএমএল-এন এর বিশ্বস্ত সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে পিএমএল-এন প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করবে বিপরীতে পিপিপিকে রাষ্ট্রপতির পদ, সংসদের স্পিকারের পদ এবং সিনেট চেয়ারম্যানের পদ প্রস্তাব করা হবে। এছাড়া পিএমএল-কিউ নেতা চৌধুরী সুজাতের সঙ্গে ইসলামাবাদে বৈঠক করবে নওয়াজ শরিফ।

পিটিআই প্রধান ব্যারিস্টার গহার আলী খান বলেছেন, (নওয়াজ-বিলাওয়ালের সঙ্গে) সরকার গঠন করার চেয়ে বিরোধীদলে বসা ভালো। কিন্তু আমরা মনে করি আমাদের (সরকার গঠনের মতো) সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। জাতীয় পরিষদে যদি তাদের দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা গ্রহণ না করা হয় তবে পিটিআই একটি শক্তিশালী বিরোধী দল গঠন করবে।

নওয়াজ শিবিরে যোগ দিয়েছেন পিপি-৯৭ (চিনিওট-৪) আসন থেকে নির্বাচিত স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ সাকিব খান চাদ্দারও। এর ফলে পাঞ্জাব বিধানসভায় পিএমএল-এনের আসন আরো বেড়েছে।

পিপিপি এবং পিএমএল-এনের নেতারা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ভাগাভাগির কথা ভাবছেন। এর অংশ হিসেবে সংবিধান অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরের জন্য তারা সরকার গঠন করবেন। এই পাঁচ বছরের মধ্যে আড়াই বছর পিএমএল-এন এবং আড়াই বছর পিপিপির নেতা প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। যখন নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ হওয়া শুরু করে তখন নওয়াজ শরিফ জানান, তারা জোট গঠন করে সরকার গঠন করবেন। এরই অংশ হিসেবে পিপিপির সঙ্গে যোগাযোগ করে তারা। তবে পিপিপির কাছ থেকে শর্ত দেওয়া হয়- জোট গঠন করে ক্ষমতায় আসতে চাইলে বিলাওয়াল ভুট্টোকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে হবে। কিন্তু নওয়াজের দল এই শর্ত মেনে নেয়নি। পিপিপিকে যখন বশে আনা যাচ্ছে না তখন ক্ষমতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করছে দুই দল।