একই সঙ্গে তিনটি উৎসব উদযাপন করল বাঙালিরা। বারাবরই উৎসব প্রিয় এ দেশের জনগণ। গতকাল বসন্ত বরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিসব ও সরস্বতী পূজা উদযাপনে প্রাণবন্ত ছিল দেশের মানুষজন। এবার বসন্তে রঙিন হয়ে উঠেছে বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের মাঠে মোট ৭২টি মণ্ডপে উৎসবমুখর পরিবেশে উদযাপিত হয় বিদ্যাদেবী সরস্বতী পূজা।
তিন উৎসবকে কেন্দ্র করে বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় ও শাহবাগসহ ঢাকার আশপাশের বিনোদন কেন্দ্রে মানুষের ঢল নামে। অনেকেই ঘুরতে এসেছেন প্রিয়জনের সঙ্গে। শিশু-কিশোররা এসেছে বাবা-মায়ের সঙ্গে। জুটি বেঁধে এসেছে তরুণ-তরুণীরাও। নানান সাজে নিজেদের রাঙিয়ে তুলেন সবাই। কেউ কেউ পরেছেন বাসন্তী রংয়ের শাড়ি-পাঞ্জাবি। কেউ সেজেছেন ভালোবাসার লাল রঙে। আবার কেউ কেউ পরেছেন সরস্বতী পূজার সাজ সাদা জমিন আর লাল পাড়ের শাড়ি। কেউ স্মৃতি ধরে রাখতে ব্যস্ত ক্যামেরায়, শিশুরা দুলছে নাগোর দোলায়। আবার কেউ কেউ মেতেছেন খোশগল্পে। নারী-পুরুষ, ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বয়সভেদে সবাই মেতেছেন উৎসবে। নানা ফুল, টিপ-চুড়ি ও খাবারের দোকানেও ভিড় ছিল। এ সব দোকানে ব্যবসাও ভালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন দোকানিরা। গিফটের দোকানেও ছিল তরুণ-তরুণীদের সমাগম।
বরাবরের ন্যায় ‘জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ’ এবারও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের বকুলতলা মাতিয়ে তুলেন সকাল থেকে সব বয়সি নারী-পুরুষ ভিড়তে থাকেন সেখানে। এসেছিলেন বিদেশিরাও। আবির খেলায়ও মাতেন কেউ কেউ। প্রতি বছরের মতো এবারও উৎসবের সূচনা হয় যন্ত্রসংগীতে। সেতারে ‘বসন্ত মুখারী’ রাগ বাজিয়ে শোনান শিল্পী জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়।
‘উদযাপন পরিষদ’ এর সভাপতি সফিউদ্দিন আহমদ বলেন, বসন্ত উৎসব মূলত মিলনের উৎসব। বসন্ত আমাদের জনজীবনে পালন হয়ে আসছে; অনেক বছর ধরে। আমরা এটিকে একটা আনুষ্ঠানিক রূপ দিয়েছি কেবল। এবার ভালোবাসা দিবসও একই দিনে এসে মিলেছে। দুটি একই রকমের উৎসব। ফলে এ দুই উৎসবের মধ্যে দিয়ে আমরা বসন্তবরণ করছি।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট তার বক্তব্যে কবি শামসুর রাহমান, শিল্পী ওয়াহিদুল হক, অভিনেতা আলী যাকের, আবৃত্তিশিল্পী কাজী আরিফসহ প্রয়াত শিল্পীদের স্মরণ করেন। তিনি বলেন, এই আবাহনের মধ্য দিয়ে আমরা মূলত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে বাংলাদেশ আমরা চেয়েছিলাম, সব মানুষের বাংলাদেশ। ধর্ম-গোত্রের ঊর্ধ্বে গিয়ে সমতার এক বাংলাদেশ, সাম্যের বাংলাদেশ গড়ব। এটাই আমরা প্রত্যাশা করি। বসন্তের এই বর্ণিল দ্যুতি সবার মাঝে ছড়িয়ে যাক।
প্রকৃতির বসন্তকে এই উৎসবের মধ্যদিয়ে নগরজীবনে তুলে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান ‘উদযাপন পরিষদ’ এর সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ। তিনি বলেন, এই উৎসব জেলা থেকে শুরু করে সব জায়গায় ছড়িয়ে যাক। উৎসবে বিভিন্ন পরিবেশনায় অংশ নেন ভাবনা, ধৃতি, নৃত্যম, বহ্নিশিখা, নৃত্যাক্ষ্য, স্পন্দন, কত্থক নৃত্য সম্প্রদায়সহ বিভিন্ন নাচের দলের শিল্পীরা। একক সংগীত পরিবেশন করেন অনিমা মুক্তি গোমেজ, বিমান চন্দ্র বিশ্বাস, বুলবুল ইসলামসহ অনেকে। আয়োজনে ছিল সাঁওতাল ও চাকমা নাচ।
বসন্ত আবাহন করেন ভাস্বর বন্দ্যেপাধ্যায়, আবৃত্তি পরিবেশন করেন নায়লা তারান্নুম চৌধুরী কাকলী। সমবেত সংগীত পরিবেশন করেছে সত্যেনসেন শিল্পী গোষ্ঠী ও সুরের ধারা। সকালের অনুষ্ঠান শেষ হয় বসন্ত আনন্দ শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে। চারুকলা থেকে বের হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ঘুরে শোভাযাত্রা চারুকলায় ফিরে শেষ হয়। শোভাযাত্রার আগে ছিল রাখী বন্ধন উৎসব।
আয়োজকরা জানান, বসন্ত বরণের বিকেলের পর্ব শুরু হবে বিকাল সাড়ে ৩টায় বেঙ্গল পরম্পরার যন্ত্রসংগীত পরিবেশনের মধ্যদিয়ে। পরে গান, নাচসহ নানা পরিবেশনায় অংশ নেবেন শিল্পীরা। প্রতিবছরের মতো এবারও একযোগে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক ও উত্তরা দিয়াবাড়ীর লেক সংলগ্ন মাঠে ‘বসন্ত উৎসব-১৪৩০’ এর অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়।