গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা

প্রকাশ : ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

আগামী মাস থেকে শুরু হতে যাচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। রমজানে তাপমাত্রা বৃদ্ধির সঙ্গে বাড়বে বিদ্যুতের চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে সারাদেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে পরিকল্পনা করেছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। একই সঙ্গে এপ্রিলে সর্বোচ্চ ১৭ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সংস্থাটি, যা গত বছরে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার ৬৪৮ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছিল।

পিডিবির তথ্য মতে, ফেব্রুয়ারির শেষ নাগাদ গরম পরতে শুরু করায় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদা বাড়ছে। গত বৃহস্পতিবার সর্বোচ্চ ১০ হাজার ৯৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে, গত শনিবারে যা বেড়ে সর্বোচ্চ ১১ হাজার ১৫২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। দিনে দিনে গরমের সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ছে। তবে সামনে রমজান মাস, এই মাসে বিদ্যুতের চাহিদা থাকবে। রমজানে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে পিডিবি ভবনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা কয়েকটি বৈঠক করেছেন। আগামীকাল আবারও বৈঠকে বসবেন কর্মকর্তারা।

পাওয়ার সেলের তথ্য মতে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াট আর বিতরণ লাইন ৬ লাখ ৪৩ হাজার কিলোমিটার। এতে ৪৪ কোটি ৬৪ লাখ গ্রাহক বিদ্যুতের সুবিধা পাচ্ছে।

জানা গেছে, গত বছরের এপ্রিলে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪০ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উঠেছিল। এবারো আগেভাগেই তাপমাত্রার পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। সেই বার্তায় বলা হয়েছে, শীতকে বিদায় দিয়ে আসছে অসহনীয় গরম। দেশের তাপমাত্রা ৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস হতে পারে। সেই টার্গেট সামনে রেখে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহে জ্বালানি আমদানির দিকে জোর দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়। উৎপাদনশীল খাতে বিদ্যুৎ ব্যবহারে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তনের ধারা অব্যাহত রাখবে।

সূত্রে জানা গেছে, অভ্যন্তরীণসহ বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনার ওপরে বাড়তি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এরপরও যদি জ্বালানি আমদানিতে মন্দাভাব দেখা দিলে, গত বছরের মতো এবারো সহনীয় পর্যায়ে লোডশেডিং দেয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে সার্বিক বিদ্যুৎব্যবস্থা নিয়ে নতুন জটিলতা তৈরি হতে পারে। কারণ এরই মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত বিপুল পরিমাণ দেনা রয়েছে। টাকার অভাবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে বিদ্যুতের দাম যথাসময়ে দিতে পারছে না। অন্যদিকে মার্কিন ডলারের অভাবে বকেয়া রাখতে হচ্ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের বিদেশি কোম্পানিগুলোর পাওনা।

সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর তথ্য মতে, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পিডিবি কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ভারতের অন্যতম বৃহৎ কোম্পানি আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশি সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ২৭ কোটি ডলার (প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা)। আর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরন গ্যাসের দাম বাবদ পাবে ২০ কোটি ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। এর বাইরে আরও কিছু খাতে বকেয়া রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বকেয়া বাড়তে থাকলে জ্বালানি সরবরাহকারীদের আস্থা কমতে থাকে। তারা দীর্ঘমেয়াদি সরবরাহ চুক্তি করতে আগ্রহী হয় না। জ্বালানি সরবরাহে তারা গড়িমসিও করে। বকেয়া দিতে দেরি হলে চুক্তি অনুযায়ী জরিমানাও দিতে হয়। ব্যাংকগুলো নতুন আমদানির ঋণপত্র খোলার ফি বাড়িয়ে দেয়।

গরমের মৌসুমে বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হবে, আমদানি বাড়াতে হবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল। টাকার অভাব ও ডলার সংকটের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য পর্যাপ্ত জ্বালানি আমদানি করা যাবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে। জ্বালানির অভাবেই গত বছর গরমে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজন অনুযায়ী চালানো সম্ভব হয়নি। এতে ঢাকায় দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা এবং গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টাও লোডশেডিং করতে হয়েছিল।

বিদ্যুৎ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে তাপমাত্রা বৃদ্ধির বিষয়টি সামনে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদনও বাড়ছে। আগামীতে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে বেশকিছু পরিকল্পনা নিয়েছে পিডিবি। কারণ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আবাসিক ভবনসহ বাণিজ্যিক, শিল্প-কারখানা, প্রাতিষ্ঠানিক ভবনগুলোয় এসির ব্যবহার আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বৈদ্যুতিক কেতলি, পেশার কুকারসহ বিভিন্ন ধরনের বৈদ্যুতিক যন্ত্রের ব্যবহারে বিদ্যুৎ চাহিদার ওপর চাপ পড়বে মাত্রাতিরিক্তভাবে, যা সামাল দিতে হিমশিম পড়বে বিদ্যুৎ বিভাগ।

বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের আর্থিক পরিস্থিতি লেজেগোবরে অবস্থায়। সক্ষমতা বাড়িয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভাড়া দিতে দিতে পিডিবি এখন শ্বেতহস্তী হতে যাচ্ছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের (এসি) ব্যবহার বাড়ায় বিদ্যুৎ কিনতে ব্যয় বেড়েছে পিডিবির। বিদ্যুৎ খাতের সংকটকে শুধু এ খাতের সমস্যা না ভেবে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতির একটা অংশ মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। সহজ অর্থে-বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ, লোডশেডিং ব্যবস্থাপনাসহ সামগ্রিক ক্ষেত্রে দ্রুততর সময়ের মধ্যে যথার্থ ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে সংকট আরও ঘনীভূত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ঢাকায় প্রতি বছরে ২০ শতাংশ হারে শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। এতে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ার পাশাপাশি ঢাকা শহরের তাপমাত্রাও বাড়ছে এমন একটি গবেষণা প্রকাশ করেছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। পরিকল্পনাবিদ রেদওয়ানুর রহমান গবেষণাটি করেছেন। গবেষণার সারাংশ উপস্থাপন করেন আইপিডির নির্বাহী পরিচালক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান।

আইপিডি’র নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, গবেষণায় বাংলাদেশে গত ৬ বছরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বিক্রির তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে। দেশে আনুমানিক ২৮ লাখ ইউনিট শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। এই যন্ত্রগুলো গড়ে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় দৈনিক ৮ ঘণ্টা করে চালালে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় চালালে অন্তত ২৫ শতাংশ বিদ্যুতের ব্যবহার কমানো সম্ভব। এসি নগরের উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী।

আদিল মুহাম্মদ খান আরো বলেন, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুরসহ প্রত্যেকটি নগরে কার্যকর পরিকল্পনা, ইমারত বিধিমালা এবং এসি ব্যবহারের সঠিক নীতিমালা থাকলে এসির ব্যবহার কমানোর পাশাপাশি বিদ্যুতের ওপর চাপ বহুলাংশে কমানো যেত। শুধু ঢাকা শহরেই প্রতিবছর এসির ব্যবহার ২০ শতাংশ হারে বাড়ছে।