আবার সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে পড়ছে জাপার

প্রকাশ : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

জাতীয় সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টির (জাপা) সাংগঠনিক কাঠামো আবারও ভেঙে পড়েছে। রওশন এরশাদপ্রন্থিদের আগামী ৯ মার্চ সম্মেলনের তারিখ ঘোষণার পর থেকে পার্টির মধ্যে উত্তেজনা শুরু হয়েছে। একের পর এক নেতা গ্রুপিং করে জাপা থেকে বেরিয়ে আসায় হুমকির মুখে পড়েছে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত এই দলটি।

জাপা সূত্র জানায়, গত রোববার রওশন এরশাদের সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত হন দলটির দুই প্রভাবশালী নেতা কাজী ফিরোজ রশীদ ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। তাদের পাশে নিয়ে রওশন জানিয়েছেন, ৯ মার্চ দলের সম্মেলন হবে। ধারণা করা হচ্ছে, এই সম্মেলনের মাধ্যমে রওশনের নেতৃত্বে নতুন কমিটি হলে জাপা আবারও ভাঙবে।

জাপা নেতারা জানান, গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে ভরাডুবির পর চলমান অস্থিরতার মধ্যে রওশন এরশাদের পক্ষে কাজী ফিরোজ রশীদ ও আবু হোসেন বাবলার প্রকাশ্য অবস্থান নেওয়ার ঘটনাটি জাপায় বেশ নাড়া দিয়েছে। এত দিন কৌশলী অবস্থান নিলেও গত রোববার এ দুই নেতা অবস্থান স্পষ্ট করলেন। রওশনের পক্ষে প্রকাশ্যে আসায় আবু হোসেন বাবলাকে কো-চেয়ারম্যান পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন দলের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। এর আগে জিএম কাদেরের বিরোধিতা করায় সম্প্রতি কাজী ফিরোজ রশীদও কো-চেয়ারম্যান পদ হারান। গত এক মাসে আরো বেশ কয়েকজন নেতাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগরীর কয়েকশ’ নেতা পদত্যাগও করেছেন। রওশনের সংবাদ সম্মেলনের পর বনানী কার্যালয়ে সাংবাদিকদের জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, কেউ যদি জাতীয় পার্টি নামে আরেকটি দল করতে চান, করতেই পারেন। বাধা দিতে পারি না।

এ ঘোষণাকে গুরুত্ব না দেওয়ার কথা বললেও পক্ষ বদলকারী আবু হোসেন বাবলাকে সব পদ থেকে অব্যাহতি দিয়েছেন জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের। জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু রওশনের সম্মেলনকে ‘অন্য দল’ গঠন বলে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, কেউ যদি জাতীয় পার্টি নামে আরেকটা দল করতে চান, করতেই পারেন। বাধা দিতে পারি না। দলের বাইরে কেউ ১০টি কমিটি ঘোষণা করলেও তাতে কিছু যায় আসে না।

১৯৮৬ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠার পর অন্তত ছয়বার ভেঙেছে জাপা। বর্তমানে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশ ছাড়াও জেপি (মঞ্জু), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন) নামে আরও তিনটি নিবন্ধিত দল রয়েছে। জাপা (জাফর) নামে আরেকটি অনিবন্ধিত দলও সক্রিয়। ৯ মার্চ সম্মেলনের মাধ্যমে রওশনের নেতৃত্বে আরেকটি জাতীয় পার্টির জন্ম হতে যাচ্ছে।

যদিও গুলশানের বাসভবনে সংবাদ সম্মেলনে রওশন দাবি করেছেন, তিনি দল ভাঙছেন না। জাতীয় পার্টি বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। দলকে ফের সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে আগামী ৯ মার্চ জাতীয় সম্মেলন ডেকেছেন।

জানা যায়, গত ২৮ জানুয়ারি নিজেকে জাপা চেয়ারম্যান ঘোষণা করে জিএম কাদের এবং মুজিবুল হক চুন্নুকে ‘অব্যাহতি দেন’ রওশন এরশাদ। চুন্নু বারবার বলেছেন, রওশন এরশাদের এসব ঘোষণাকে পাত্তা দিচ্ছেন না।

সংবাদ সম্মেলনে রওশন বলেন, নেতাকর্মীর দাবির মুখে দলের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নিয়েছি। কাজী ফিরোজ রশীদ, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাসহ দলের প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা এবং এরশাদভক্ত সর্বস্তরের অগণিত নেতাকর্মী পাশে দাঁড়িয়েছেন। সবাই মিলে সুন্দর একটি সম্মেলন উপহার দিয়ে জাতীয় পার্টিতে আবার প্রাণশক্তি ফেরাতে চাই।

এরশাদের জীবদ্দশা থেকেই দ্বন্দ্ব চলছে রওশন এরশাদ এবং জিএম কাদেরের। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে তা চরমে পৌঁছে। নেতৃত্বের লড়াইয়ে টিকতে না পেরে নির্বাচনে অংশ নেননি গত দুই সংসদের বিরোধীদলের নেতা রওশন। তার অনুসারীদের কাউকেই মনোনয়ন দেয়নি জাপা।

জাপা সূত্র জানায়, জিএম কাদের বিরোধীদলের নেতা হতে পারলেও ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে মাত্র ১১ আসন পেয়েছে জাপা। ভোটের আগে থেকেই লাঙ্গলের প্রার্থীরা অভিযোগ তোলেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে জিএম কাদের সরকারের কাছ থেকে টাকা পেলেও অন্যদের দেননি। তিনি স্ত্রী শেরীফা কাদেরের জন্য আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় পেতে দলের অন্য নেতাদের বলি দিয়েছেন। জিএম কাদের আওয়ামী লীগকে স্বতন্ত্র প্রার্থী সরাতে রাজি করাতে না পারায় ছাড়ের ২৬ আসনের ১৫টিতে হেরেছেন লাঙ্গলের প্রার্থীরা। ছাড়ের বাইরে যে তিন-চারটি আসনে লাঙ্গলের প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিলেন, তারা বারবার চেয়েও জিএম কাদেরের সহায়তা পাননি।

এসব অভিযোগ তোলায় কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদসহ কয়েক সিনিয়র নেতাকে অব্যাহতি দেন জিএম কাদের। এর পর জিএম কাদের ও মুজিবুল হক চুন্নুর বিরুদ্ধে ‘স্বেচ্ছাচারিতার’ অভিযোগ এনে ৬৭১ নেতাকর্মী পদত্যাগের ঘোষণা দেন।

মহিলা এমপি না পাওয়ার পর পক্ষ বদল : রওশন সম্মেলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক করেন কাজী ফিরোজকে। সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা কো-আহ্বায়ক, গোলাম সরোয়ার মিলন যুগ্ম আহ্বায়ক, শফিকুল ইসলাম সদস্য সচিব ও জিয়াউল হক মৃধা কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করবেন।

আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় না পেয়ে ঢাকা-৬ আসনের দুবারের এমপি ফিরোজ রশীদ এবার নির্বাচনে অংশ নেননি। ঢাকা-৪ আসনের দুবারের এমপি আবু হোসেন বাবলা হয়েছেন তৃতীয়। আসন ছাড় না পাওয়ায় এ দুই নেতা নীরব থাকলেও ভোটের পর থেকে জিএম কাদেরের সমালোচকদের সমর্থন করছিলেন। বাবলা তার স্ত্রী সালমা হোসেনের জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসনে মনোনয়ন চেয়েছিলেন। না পেয়ে গতকাল আনুষ্ঠানিকভাবে জিএম কাদেরের পক্ষ ছাড়েন। তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাপারও সভাপতি ছিলেন। তিনি এবং মহানগর উত্তর জাপার অব্যাহতি পাওয়া সভাপতি শফিকুল ইসলাম জাপার কর্মসূচিতে নেতাকর্মী আনতেন।

জিএম কাদেরের সমালোচনা করে কাজী ফিরোজ বলেন, শুনেছি ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়। আর এবার নির্বাচনে কী দেখলাম? দেশের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে নিজে বড়, আর নিজের চাইতে স্ত্রী বড়। এভাবে কোনো দল চলতে পারে না।

জাপা এমপিদের সমালোচনা করে ফিরোজ রশীদ বলেন, বাজার পরিস্থিতিসহ নানা বিপর্যয় নিয়ে সংসদে যারা আছেন, তারা কথা বলেন না, একতারা বাজিয়ে গান গাইছেন। জাতীয় পার্টির ৯ মার্চের কাউন্সিল অতীতের সব কাউন্সিলের চেয়ে সুসংগঠিত হবে। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে পচা মাংস ফেলে দিয়ে নতুন জাতীয় পার্টি তৈরি হবে বলে দাবি করেছেন আবু হোসেন বাবলা।

এদিকে ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাপার বর্তমান কমিটির মেয়াদ ফুরিয়েছে। কবে সম্মেলন হবে এ প্রশ্নে জাপা মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, সম্মেলন নিয়ে সাংবাদিকরা এত উতলা কেন? বলেছি তো, সময় হলেই সম্মেলন করব। এই বছরের মধ্যেই করব।

চুন্নু বলেছেন, আমরা কোনো কাউন্সিল ডাকিনি। বাইরে কে কাউন্সিল ডাকল বা না ডাকল, এরসঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নেই।