ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ওই খসড়া প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হয়। ওয়াশিংটনের দাবি, এই প্রস্তাব গাজায় যুদ্ধ বন্ধের আলোচনাকে ঝুঁকিতে ফেলবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়েছে অনেকেই। যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে হোয়াইট হাউজ ভেটো দেওয়ায় দুঃখপ্রকাশ করেছে মার্কিন মিত্ররাও। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে ১৩টিই আলজেরিয়ার উত্থাপিত এই খসড়া প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। ভেটো দিয়েছে কেবল যুক্তরাষ্ট্র। আরেক স্থায়ী সদস্য যুক্তরাজ্য ভোটদানে বিরত ছিল।
নিরাপত্তা পরিষদে স্থায়ী সদস্য পাঁচটি। এর মধ্যে রাশিয়া, ফ্রান্স ও চীন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এককভাবে কোনো প্রস্তাবে ভেটো প্রয়োগ করে তা বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর। অর্থাৎ, যুদ্ধবিরতির লক্ষ্যে নতুন খসড়া প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটোর অর্থ হলো প্রস্তাবটি আর গৃহীত হবে না। অবশ্য ওয়াশিংটনের খসড়া প্রস্তাবে ‘যত তাড়াতাড়ি সম্ভব’ একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানানো হয়েছে। সেখানে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি ও গাজায় ত্রাণ পৌঁছানোর বাধাগুলো তুলে নেওয়ার কথা রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রস্তাবে নিরাপত্তা পরিষদ ভোট দেবে কি না তা এখনো স্পষ্ট নয়। আলজেরিয়ার যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্র ভেটো দেওয়ার পর জাতিসংঘে উত্তর আফ্রিকা দেশগুলোর প্রতিনিধি বলেছেন, এটি ফিলিস্তিনিদের কাছে একটি শক্তিশালী বার্তা পাঠাবে এবং এই সাক্ষ্য দেবে, দুর্ভাগ্যবশত নিরাপত্তা পরিষদ আবারও ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘে ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি রিয়াদ মনসুর বলেছেন, যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে মার্কিন ভেটো ছিল বেপরোয়া ও বিপজ্জনক। ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের মিত্ররাও এর সমালোচনা করেছেন। ফ্রান্সের প্রতিনিধি নিকোলাস ডি. রিভেরি গাজার এমন দুদর্শাগ্রস্ত পরিস্থিতিতে প্রস্তাবটি পাস না হওয়ায় দুঃখপ্রকাশ করেছেন। তবে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, আমরা লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমাদের ওপর এমন কোনো চাপ নেই যা আমাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করাতে পারে। ইসরায়েল নিরাপত্তা পরিষদের যেকোনো প্রস্তাব মেনে চলতে বাধ্য। কারণ এগুলো আইনত বাধ্যতামূলক। এটিই সাধারণ পরিষদ থেকে নিরাপত্তা পরিষদের মূল পার্থক্যের জায়গা। গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে আচমকা হামলা চালায় ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাস ও এর সহযোগীরা। এসময় প্রায় ১ হাজার ২০০ জন নিহত হন। জিম্মি করা হয় অন্তত ২৪০ জনকে। এরপর থেকেই অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। এতে এরই মধ্যে ২৯ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
গাজায় খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে দিল ডব্লিউএফপি : টানা সাড়ে চার মাস ধরে ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় আগ্রাসন চালাচ্ছে ইসরায়েল। এতে করে অবরুদ্ধ ওই ভূখণ্ডটিতে তীব্র মানবিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ ঘরবাড়ি হারিয়ে অস্থায়ী তাঁবুসহ আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন। তাদের জন্য জীবন রক্ষাকারী খাদ্য সরবরাহ করা জরুরি হলেও তা বন্ধ করে দিয়েছে জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি)। মূলত ভূখণ্ডটিতে ব্যাপক বিশঙ্খলার কারণে এই পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে সংস্থাটি। জাতিসংঘের এই সংস্থাটি বলেছে, ব্যাপক বিশৃঙ্খলার কারণে তাদের সহায়তা কনভয়গুলো সম্পূর্ণরূপে বিপর্যয় এবং সহিংসতার সম্মুখীন হয়েছে। সংস্থাটি আরো বলেছে, এই সিদ্ধান্তটি সহজভাবে নেওয়া হয়নি। তাদের সদস্যরা ব্যাপক ভিড়, বন্দুকযুদ্ধ এবং লুটপাটের সম্মুখীনও হয়েছেন।
এছাড়া জাতিসংঘ গত বছরের ডিসেম্বর থেকে গাজার উত্তরাঞ্চলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার কথা বলে আসছে। ডব্লিউএফপি বলেছে, সাম্প্রতিক প্রতিবেদনগুলোতে এই ভূখণ্ডে ‘ক্ষুধা ও রোগের দ্রুত ছড়িয়ে’ পড়ার প্রমাণ রয়েছে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গত বছরের অক্টোবরে স্থল আক্রমণের শুরুতে ১১ লাখ ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিককে উত্তরাঞ্চলীয় ওয়াদি গাজার সমস্ত এলাকা থেকে সরে গিয়ে দক্ষিণে আশ্রয় নেওয়ার নির্দেশ দেয়। যেসব এলাকা থেকে সেসময় সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল তার মধ্যে গাজা শহরও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এই শহরটি ছিল যুদ্ধের আগে এই অঞ্চলের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। বেশিরভাগ বাসিন্দাই সেসময় ইসরায়েলি আদেশ অনুসরণ করে, কিন্তু কয়েক লাখ ফিলিস্তিনি এই এলাকাতেই থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, যাদের অনেকেই আবার পালিয়ে যেতে সক্ষম ছিল না। পরে ইসরায়েলি সৈন্যরা এই অঞ্চলটিকে ঘেরাও করে এবং সেখানে হামাসের শক্ত ঘাঁটির নিয়ন্ত্রণ নেয়। গত মাসে ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, অন্তত ৩ লাখ মানুষ এখনো উত্তর গাজায় রয়েছেন যারা বেঁচে থাকার জন্য তাদের সহায়তার ওপর নির্ভর করছেন। মূলত তীব্র সংঘাতের কারণে গাজার উত্তরাঞ্চলে ত্রাণ বিতরণ হয়ে থাকে খুবই কম। এছাড়া অল্প পরিমাণে যে সহায়তা বিতরণ হয় সেটিও আবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর নিরাপত্তা ছাড়পত্রের ওপর নির্ভরশীল। এই সপ্তাহান্তে ডব্লিউএফপি গাজার এই অঞ্চলে সপ্তাহব্যাপী সহায়তা সরবরাহের আশা করেছিল। প্রতিদিন এখানে সহায়তা-ভর্তি ১০টি লরিও পাঠানোর পরিকল্পনা করেছিল তারা। কিন্তু রোববার সংস্থাটির একটি কনভয়কে উত্তরের ওয়াদি গাজা চেকপয়েন্টের কাছে ‘ক্ষুধার্ত বিপুল সংখ্যক মানুষ’ ঘিরে ধরে এবং লোকেরা গাড়িতে আরোহণের একাধিক প্রচেষ্টা চালায়। এরপর গাজা শহরে প্রবেশ করার সময়ও গোলাগুলির মুখোমুখি হয় কনভয়। এছাড়া, দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর খান ইউনিস এবং দেইর আল-বালাহ শহরের মধ্যবর্তী স্থানে বেশ কয়েকটি সহায়তাবাহী লরি লুট করা হয়েছে এবং একজন চালককে মারধর করা হয়েছে। ডব্লিউএফপি বলেছে, গত দুই দিনে তাদের দল গাজা উপত্যকায় ‘অভূতপূর্ব মাত্রার হতাশার সাক্ষী হয়েছে’। সংস্থাটি বলছে, ‘খাদ্য এবং নিরাপদ পানি অবিশ্বাস্যভাবে দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে এবং সেখানে বিভিন্ন রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। নারী ও শিশুদের পুষ্টি এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাস পাচ্ছে এবং এর ফলে অঞ্চলটিতে তীব্র অপুষ্টি বেড়েছে। মানুষ ইতোমধ্যেই ক্ষুধাজনিত কারণে মারা যাচ্ছে।’ গত সোমবার ডব্লিউএফপি এবং জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফের একটি যৌথ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গাজার উত্তরে পরিস্থিতি ‘বিশেষ করে খুবই খারাপ অবস্থায় রয়েছে’। ডব্লিউএফপি বলেছে, উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে পরিচালিত পরীক্ষায় দেখা গেছে, দুই বছরের কম বয়সি ১৫ শতাংশেরও বেশি শিশু তীব্রভাবে অপুষ্টিতে ভুগছে। সংস্থাটি বলেছে, তারা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ‘দায়িত্বপূর্ণ পদ্ধতিতে’ সহায়তা বিতরণ পুনরায় শুরু করার উপায় খুঁজে বের করবে এবং একই সঙ্গে উত্তর গাজায় সাহায্য বিতরণ ব্যাপকভাবে সম্প্রসারণের আহ্বানও জানিয়েছে তারা। আর এর জন্য একাধিক রুট থেকে গাজায় উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি পরিমাণে খাবার প্রবেশ করানো প্রয়োজন এবং ইসরায়েল ও উত্তর গাজার মধ্যে ক্রসিং পয়েন্টগুলো খোলার প্রয়োজন রয়েছে বলে জানানো হয়েছে। জাতিসংঘের এই সংস্থাটি গাজায় একটি কার্যকরী মানবিক ব্যবস্থা, স্থিতিশীল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক এবং সংস্থার কর্মী ও অংশীদারদের পাশাপাশি গাজাবাসীদের জন্য নিরাপত্তারও আহ্বান জানিয়েছে। সূত্র : বিবিসি।