কাউন্সিল ঠেকাতে প্রেসিডিয়াম সভা

সুস্থ রাজনীতির ধারায় ফিরতে পারছে না জাপা

প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আরিফুল ইসলাম

জাতীয় পার্টি (জাপা) একাংশের চেয়ারম্যান রওশন এরশাদের ৯ মার্চের কাউন্সিল ডাকার পর এখন ২ মার্চ প্রেসিডিয়াম সদস্যদের নিয়ে সভা ডেকেছে পার্টির অন্য অংশের চেয়ারম্যান জিএম কাদের। ফলে দুই গ্রুপের মধ্যে দলের নেতাকর্মীদের পক্ষ ত্যাগ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। ফলে সুস্থ রাজনৈতিক ধারায় ফিরতে পারছে না জাপা।

সূত্র জানায়, জাপা কয়েক দফা ভাঙার পর এমনিতেই দুর্বল হয়ে পড়েছে অনেক আগে। এখন আবারও দলটি দুই ভাগে বিভক্ত হচ্ছে। দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পক্ষ ত্যাগের হিড়িক পড়ে গেছে। জাপার একাংশের চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন জাপা আগামী ২ মার্চ সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ সদস্যদের নিয়ে যৌথ সভা ডেকেছে। ওই দিন বেলা ১১টায় রাজধানীর বনানীতে দলের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে এ সভা অনুষ্ঠিত হবে।

অন্যদিকে রওশন এরশাদের নেতৃত্বে তার সমর্থকরা পৃথকভাবে আগামী ৯ মার্চ দলের জাতীয় সম্মেলন করার ঘোষণা দেন। গত ৭ জানুয়ারির দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে বিরোধ তৈরি হয়। এখন দুই অংশই পৃথকভাবে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে। এভাবে দলটি ভাঙনের দিকে যাচ্ছে বলে উভয় অংশের নেতারা মনে করছেন।

রওশন এরশাদের ডাকা সম্মেলন ঘিরে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে বিভক্ত হচ্ছে জাতীয় পার্টি। এতদিন জিএম কাদেরের সঙ্গে থাকলেও বিভিন্ন জেলা, উপজেলা ও মহানগরের অনেক নেতাই এখন অন্য অংশের দিকে ঝুঁকছেন। এ অবস্থায় নেতাকর্মীদের নিজ বলয় ধরে রাখতে একরকম তড়িঘড়ি করে দলের প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যদের যৌথসভা ডেকেছেন জিএম কাদের।

জাপা সূত্র বলছে, আগামী ৯ মার্চ রওশন এরশাদের সম্মেলনে জাতীয় পার্টির অন্তত ১০ জন প্রেসিডিয়াম সদস্য যোগ দিতে পারেন। জিএম কাদেরের সঙ্গে ছেড়ে আসা এই নেতাদের মধ্যে কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্যও থাকবেন। তাদের অনুসরণ করবেন কেন্দ্রীয় ও মহানগর কমিটির বেশ কয়েকজন নেতা। সম্মেলন কেন্দ্র করে এরই মধ্যে সারা দেশে জেলা, উপজেলা ও মহানগর পর্যায়ে বিভক্তি শুরু হয়েছে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের বলেন, জাতীয় পার্টির নামে রাজনীতি করবে কিন্তু কাজ করবে অন্য দলের জন্য, তারা কী জাতীয় পার্টির অ্যাসেট হতে পারে? তারা জাতীয় পার্টির জন্য আবর্জনা। এই আবর্জনা চলে গেলে আমাদের দলের শক্তি আরও বৃদ্ধি পাবে।

জিএম কাদের বলেন, যারা আমাদের দলকে ব্যবহার করে নিজের স্বার্থের জন্য, দল এবং দেশ-জাতির স্বার্থের দিকে খেয়াল করে না এই সমস্ত লোক আমাদের দলে থাকার চেয়ে না থাকাই ভালো। তারা সুবিধাবাদী দলের পলিটিশিয়ান। তারা ব্যক্তিগত স্বার্থে রাজনীতিকে ব্যবহার করে। দেশ ও জাতির স্বার্থ তো দূরের কথা তারা দলের স্বার্থ পর্যন্ত দেখে না।

তিনি বলেন, যত লোক যাবে আমি কাউকে ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা করব না। আর কেউ নিজের ইচ্ছায় চলে যেতে চাইলে আমি অন্তর থেকে খুশি হবো। কারণ এসব লোক কখনোই আমার ছিল না। এরা টেম্পোরারিলি এসেছিল, আবার নিজের জায়গায় চলে গিয়েছে। এরা চলে গেলে দলটায় সত্যিকার অর্থেই একটা চরিত্র হবে। দল টিকে রাজনীতি থাকলে, শুধু দল থাকলেই টিকে না। আমি রাজনীতি দিতে পারলে তাহলে আমার দলে অনেক লোক আসবে, সাপোর্ট আসবে। জনগণের সেবা করলে জনগণ আমার সাথে থাকবে। কিন্তু যতই দালালি করি, জনগণ আমার সাথে থাকবে না।

সংশ্লিষ্টরা জানান, জিএম কাদেরের ডাকা বৈঠক থেকে দলের সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতাদের বেশ কিছু নির্দেশনা দেওয়া হবে। পাশাপাশি জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ভাঙন ঠেকাতে নেওয়া হবে বিশেষ উদ্যোগ। বিশেষ করে জাপার ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলের নেতাকর্মীদের ধরে রাখতে কয়েকজনকে দায়িত্ব দেবেন জিএম কাদের। একইভাবে বৃহত্তর ময়মনসিংহের একাধিক প্রেসিডিয়াম ও সংসদ সদস্যকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। দল পরিচালনায় সবার মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানাবেন জি এম কাদের।

জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আগামী ২ মার্চ যৌথ সভায় সাংগঠনিক পরিস্থিতি, জাপার কেন্দ্রীয় সম্মেলনসহ সার্বিক রাজনৈতিক বিষয়ে আলোচনা হবে।

রওশন এরশাদের ডাকা সম্মেলন নিয়ে তারা চিন্তিত নন জানিয়ে চুন্নু বলেন, ‘যে কারও দল করার স্বাধীনতা আছে। এ নিয়ে আমরা কোনো চাপ অনুভব করছি না। কেউ দল থেকে চলে গেলে পদ শূন্য থাকে না। রাজনীতিও বন্ধ থাকে না। আমাদের বিশ্বাস, পরীক্ষিত কোনো নেতাকর্মী মূল ধারার জাতীয় পার্টি ছেড়ে যাবেন না।

এদিকে রওশনপন্থি একাধিক নেতা জানান, কিছুদিনের মধ্যেই জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম (ময়মনসিংহ), সাইদুর রহমান টেপা (ঢাকা), সোলায়মান আলম শেঠ ও মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী (চট্টগ্রাম), সাইফুদ্দিন আহমেদ মিলন (পোস্টার মিলন), আবুল কাশেম (টাঙ্গাইল), আব্দুর রশিদ সরকার (গাইবান্ধা), তাজ রহমান (সিলেট), লিয়াকত হোসেন খোকা (নারায়ণগঞ্জ), শামীম হায়দার পাটোয়ারী (গাইবান্ধা), ভাইস চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম ঝন্টু (সিরাজগঞ্জ), নুরুল ইসলাম ওমরসহ (বগুড়া) অনেকেই আনুষ্ঠানিকভাবে রওশনের সঙ্গে যোগ দেবেন। তারা নিজ নিজ অনুসারীদেরও জিএম কাদেরের বলয় থেকে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ কমিটি নিয়ে স্বস্তিতে নেই জিএম কাদের। দলীয় কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের জমায়েতের ক্ষেত্রে কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা এবং মহানগর উত্তরের সভাপতি শফিকুল ইসলাম সেন্টু সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতেন। তারা দুজনেই এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়ে রওশনের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। নগরের আরও কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা তাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। সব মিলিয়ে রাজধানী ঢাকা সাংগঠনিক পরিস্থিতি নিয়ে কাদেরপন্থিরা অনেকটা বেকায়দায় পড়তে যাচ্ছেন।

রওশন অংশের নেতাদের দাবি, এরই মধ্যে ৬৪ জেলায় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ হয়েছে। সব জেলা থেকেই প্রতিনিধিরা সম্মেলনে যোগ দেবেন। ঢাকার নেতাকর্মীদের বড় অংশই কাদেরকে ছেড়ে রওশন অংশে যাবেন বলে অনেকটা নিশ্চিত।

রওশনপন্থিদের অন্যতম নেতা জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন খান বলেন, ‘সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা প্রতিদিনই আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। কেন্দ্রীয় নেতারাও জিএম কাদেরের সঙ্গে আর থাকতে চান না। সবাই চলমান স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছেন।