‘ভাবিয়া করিও কাজ করিয়া ভাবিও না’

দুপুরে চিনির দাম ২০ টাকা বাড়িয়ে রাতে প্রত্যাহার

প্রকাশ : ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শেখ কুতুব আলী

‘ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না’ আমাদের দেশের তরুণ সমাজের জন্য এই প্রবাদটি হয়তো রচনা করা হয়েছে বলে মনে ধারণা করা হয়। কেন না, আমাদের দেশের তরুণ বা যুব সমাজ অল্পতেই লাফালাফি করে। হঠাৎ করেই বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের সেসব সিদ্ধান্ত অনেক সময় ভুল প্রমাণিত হয়। কেন না, আমাদের যুব সমাজের বাস্তব জ্ঞানটা ওই সময়ে পরিপক্ব তা লাভ করে না। ফলে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে তারা পারে না। সে কারণে তরুণ সমাজের সিদ্ধান্ত নিয়ে সমাজের অন্যরা অনেক সময় দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে।

মাঝেমধ্যে সরকারের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা দু-চারজন ব্যক্তির হঠাৎ সিদ্ধান্তও রাষ্ট্র ও সরকারকে বেকায়দায় ফালায়। পবিত্র শবেরবাতের তিন দিন আগে চিনির দাম কেজি প্রতি ২০ টাকা বাড়িয়ে দেয় সরকার। রোজার মাস তো সামনে পড়েই আছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে যেখানে সাধারণ মানুষের জীবন নাভিশ্বাস, সেখানে সরকার যদি একটি পণ্যের দাম প্রতি কেজি ২০ টাকা বাড়িয়ে দেয়, তাহলে সিন্ডিকেট কি করবে সেই প্রশ্ন তো থাকতেই পারে। চিনির দাম বাড়ার খবরে মানুষ রীতিমতো ভকড়ে গেছে। এটা কি করে সম্ভব। স্বয়ং সরকার কেন এই সংবেদনশীল সময়টিতে চিনির মূল্য বাড়াল। তা আবার কেজিতে ২০ টাকা। এটা তো সাংঘাটিক ব্যাপার। ২-৪ টাকা বাড়লে হয়তো মানা যেত। সহনশীল হতো। তবে সরকারকে ধন্যবাদ দিতে হয় যে, দুপুরের দিকে চিনির দাম বাড়ানোর ঘোষণাটি রাতে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে। বিক্ষুব্ধ মানুষ স্বস্তি বোধ করছে। দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের ঘোষণায় বেলা হয়, জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে চিনির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। সরকার কেন জনগণের দুর্ভোগের কথাটি আগে বুঝতে পারেনি, সেটা বোধগম্য নয়। মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর দাম বৃদ্ধির সিদ্বান্ত বাতিল করা হলো। সরকার তো আর তরুণ নয়। টানা চার মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব পালন করছে। চিনির দাম ২০ টাকা বাড়ানোর খবরে আওয়ামীবিরোধী মানুষ নানাভাবে সরকারের সমালোচনা করেছে। বাস্তবতা হচ্ছে যারা সরকার পরিচালনা করেন তারা তরুণ নয়, আর আওয়ামী লীগ তো দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল। সেই দল ক্ষমতায় আর রোজার মাসের আগে শুধু চিনির মূল্য ২০ টাকা কেজি প্রতি বাড়িয়ে দেয়ার কি অনিাবার্যতা ছিল সেটাও তো ভাবার বিষয়। হুট করে দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত আর পরক্ষণে পিছু হটা এটা কেমন আচরণ। বর্তমানে পণ্যের মূল্য নিয়ে দেশের গণমাধ্যমগুলো প্রতিদিনই প্রতিবেদন প্রচার করছে। পণ্যের মূল্যের বৃদ্ধির পেছনে কারা জড়িত, তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে তা প্রকাশ করছে। অথচ সরকারও যে দেশের মানুষকে দুর্ভোগের মধ্যে ফেলতে পারে, সেটা প্রমাণিত হলো চিনির মূল্য একলাফে ২০ টাকা বেশি বাড়িয়ে। চিনির ব্যবহার কেবল ডায়াবেটিকস আক্রান্ত মানুষের কাছে কম। অথচ শিশু থেকে উঠতি বয়সি মানুষের কাছে চিনির চাহিদা অনেক বেশি। আর লোভনীয় খাবারগুলোর অধিকাংশ মিষ্টি জাতীয়। মিষ্টি জাতীয় খাবার তৈরি করতে প্রয়োজন চিনির। অথচ চিনির দাম নির্ধারণ করে দেয়া হলো প্রতি কেজি ১৬০ টাকা। এক কেজি চিনি দিয়ে কয় কেজি খাবার তৈরি করা যায়, সেটা শুধু তারাই জানে, যারা খাবার তৈরির কাজে নিয়োজিত থাকে।

চিনির দাম বৃদ্ধি করার সিদ্ধান্ত নেয়ার পর সরকারের শুভবুদ্ধির উদয় হয়েছে। চিনির বর্ধিত মূল্য প্রত্যাহার করে গত বৃহস্পতিবার অপর এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, পবিত্র রমজান মাস ও জনগণের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে চিনির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করেছে সরকার। ফলে পূর্বের নির্ধারিত কেজি প্রতি সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৪০ টাকা বহাল রইল। এরআগে দুপুরে কেজিতে ২০ টাকা বাড়িয়ে সরকারি মিলের চিনির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৬০ টাকা নির্ধারণ করে চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি)।

বিএসএফআইসির এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, আন্তর্জাতিক ও দেশীয় চিনির বাজার মূল্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিএসএফআইসি উৎপাদিত চিনির বিক্রয়মূল্য পুননির্ধারণ করে। মূল্যবৃদ্ধি সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী করপোরেশনের ৫০ কেজি বস্তাজাত চিনির মিলগেট বিক্রয়মূল্য ১৫০ টাকা (এক কেজি) ও ডিলার পর্যায়ে বিক্রয়মূল্য ১৫৭ টাকা (এক কেজি) নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া করপোরেশনের ১ কেজি প্যাকেটজাত চিনির মিলগেট বা করপোরেট সুপারশপ বিক্রয়মূল্য ১৫৫ টাকা ও বিভিন্ন সুপারশপ, চিনি শিল্প ভবনের বেজমেন্টে ও বাজারে সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য ১৬০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। বাজারে সরকারি চিনির নামে মোড়কজাত করে চড়া দামে বিক্রি করছে কিছু প্রতিষ্ঠান। সবশেষ কেজিপ্রতি ১৪০ টাকা চিনির মূল্য নির্ধারণ করে সংস্থাটি। যে দিন চিনির দাম ২০টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আসল সেদিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জনগণকে এই বলে আশ্বস্ত করেন যে, বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে সরকার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে টাস্কফোর্সের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিদেশ থেকে বিভিন্ন ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানির সুযোগ সম্প্রসারিত করা হয়েছে। আমরা জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই, পবিত্র রমজান মাসে দ্রব্যমূল্য সহনীয় পর্যায়ে রাখতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। গতকাল গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলনেও নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে আসে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, রমজান মাসে নিত্য পণ্যের কোনো সংকট হবে না। সরবরাহ সংকট তো কোনো সংকট নয়। সংকট হচ্ছে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা। বাস্তবতা হচ্ছে চাহিদার তুলনায় মানুষ কম কিনছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ। তবে সব পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যাওয়ায় কাটছাঁট করেও হিসাব মেলানো যাচ্ছে না। সংসার চালানো দিন দিন কঠিন হয়ে উঠছে। বাজারে একবার পণ্যের দাম বেড়ে গেলে আর কমছে না। ‘পণ্যের দাম কয়েক দফায় বাড়ার পর বাজারে তদারকি শুরু হয়। তদারকির পরও বাড়তি দামেই বাজার স্থিতিশীল হয়। একেক সময় একেক পণ্যের দাম নিয়ে খেলছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। সরবরাহের দোহাই দিয়ে একেকটি পণ্যের দাম বাড়িয়ে সপ্তাহ ব্যবধানে বাজার থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে শত শত কোটি টাকা। আর ভোক্তাদের অসহায় হয়ে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। সরকারের দুর্বলতার কারণে এমনটি হচ্ছে’ বলে মনে করেন ক্রেতারা। পণ্য সরবরাহের দোহাই দিয়ে বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। তারা এতটাই শক্তিশালী যে, সরকারও অসহায়ত্ব প্রকাশ করছে। এই পরিস্থিতি থেকে লোকজনকে উদ্ধার করতে না পারলে সব উন্নয়ন ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। নিত্যপণ্যের দামের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। জীবন চালাতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের দু-একটি সংস্থা মাঠে কাজ করলেও সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। অসাধু ব্যবসায়ীদের লাগাম টানতে না পারলে ভোক্তারাই ভুক্তভোগী হবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সরকারের শক্তিশালী পদক্ষেপ এখন সময়ের দাবি বলে মনে করেন সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলেও অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে স্থানীয় বাজারে তার প্রতিফলন নেই। ফলে ভোক্তারা এর সুফল পাচ্ছেন না। আমদানির তুলনায় খুচরা বাজারে নিত্যপণ্যের দামে পার্থক্য অনেক বেশি। কৃষিপণ্যের উৎপাদন মূল্যের চেয়ে খুচরা দরেও একই পরিস্থিতি। কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাবের) পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশেও দাম বাড়ে, সে পণ্য এখানে আসুক বা না আসুক। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমলে দেশে সেই অনুপাতে দাম কমে না। এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলোও বাজার নিয়ন্ত্রণে সেভাবে ভূমিকা রাখতে পারেনি। দাম বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বাজার ব্যবস্থাপনার কাঠামোগত ও নীতিগত দুর্বলতা, যথাযথ প্রতিযোগিতার অভাব ও ক্রয়-বিক্রয়ের রেকর্ড সংরক্ষণের অভাব। নিত্যপণ্যের দাম কমানোর জন্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের জনবল বাড়িয়ে দেশব্যাপী কার্যকর তদারকি কার্যক্রম বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে বলে অনেকে মনে করেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার সিন্ডিকেটের হাতে ভোক্তা জিম্মি। পণ্যের দাম বৃদ্ধির পেছনে একটি চক্র খুব শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে ভোক্তাকে নাজেহাল করছে। সরকারের উচিত হবে একাধিক সংস্থাকে দিয়ে বাজারের নিয়ন্ত্রণ করা, যাতে করে এর সুফল ভোক্তা পান। এতে সমাজে পিছিয়ে পড়া জনগণ কিছুটা হলেও উপকৃত হবে এবং সরকারের উন্নয়ন সার্থকতা পাবে।