ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জোর দিচ্ছে সরকার

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জোর দিচ্ছে সরকার

বৈশিক মন্দায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি সরবরাহ চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়েছে। সেজন্য গ্রীষ্মকালে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে উচ্চমূল্যের তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে জোর দিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (ডিপিডিবি) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে সিংহভাগ জ্বালানি আমদানিনির্ভর। সেখানে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি খরচ হয়। গ্যাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন আরেকটু কম খরচ হয়। তবে তেল ও গ্যাসের তুলনায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সবচেয়ে কম খরচ। সেজন্য চলমান ডলার সংকটে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পুরোদমে চালানোর পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

জানা গেছে, বর্তমানে বাজার মূল্যে দেশের অভ্যন্তরে জ্বালানিভেদে বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ডিজেলে প্রতি ইউনিট ৩০ টাকা, ফার্নেস অয়েলে প্রতি ইউনিট ১৮ থেকে ২০ টাকা, আমদানি করা গ্যাসে প্রতি ইউনিট ১৮ টাকা, ভারতীয় কোম্পানি আদানি গ্রুপ থেকে আমদানি করা প্রতি ইউনিট ১৫-১৬ টাকা। আর আমদানি করা কয়লায় প্রতি ইউনিটে ৭ থেকে ৮ টাকা পড়ছে। এখানে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন ব্যয় অস্বাভাবিক। এর প্রভাবে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয়ও বাড়ছে। সেজন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বিদ্যুৎ বিভাগ।

জানা গেছে, গত বছর গরমের মৌসুমে ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানি কমেছিল। ফলে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সম্ভব হয়নি। যার কারণে দেশজুড়ে লোডশেডিং দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর পথ বেছে নিয়েছিল বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে এবার উচ্চমূল্যের তেল আমদানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর মধ্যে পায়রা ১২০০ মেগাওয়াট, রামপাল ১২০০ মেগাওয়াট, মাতারবাড়ি (আংশিক) ৫৭৫ মেগাওয়াট, এসএস পাওয়ার ৬০০ মেগাওয়াট এবং বরিশাল ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এছাড়াও আদানি থেকে ১৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা সম্ভব। এসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ বড় ধরনের ভূমিকা রাখবে।

পাওয়ার সেলের সর্বশেষ তথ্য মতে, কয়লাভিত্তিক পরিকল্পনাধীন ও বাস্তবায়নাধীন কয়লাভিত্তিক মেগাপ্রকল্পের তালিকায় রয়েছে- মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট রামপাল ১৩২০ মেগাওয়াট, আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট মাতারবাড়ি ১২০০ মেগাওয়াট, বিপিডিবি ও সিঙ্গাপুর জয়েন্ট ভেঞ্চারে মহেশখালী ১২০০ মেগাওয়াট, মহেশখালীতে আরেকটি ১৩২০ মেগাওয়াট, বিপিডিবি ও টিএনবি মালয়েশিয়া জয়েন্ট ভেঞ্চার মহেশখালী ১২০০ মেগাওয়াট, বিপিডিবি ও সিএইডিএইচকে চায়না জয়েন্ট ভেঞ্চার মহেশখালী ১২০০ মেগাওয়াট, বিপিডিবি ও কেপকো, কোরিয়া জয়েন্ট ভেঞ্চার মহেশখালী ১২০০ মেগাওয়াট এবং এনডব্লিওপিজিসিএল এবং সিএমসি, চায়না জয়েন্ট ভেঞ্চার পায়রা ১৩২০ মেগাওয়াট।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্য মতে, এশিয়ার অন্যান্য প্রধান অর্থনীতির দেশ ভারত ও ভিয়েতনামের পাশাপাশি বাংলাদেশও বিদ্যুতের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় তুলনামূলক সাশ্রয়ী কয়লার ব্যবহার বাড়িয়েছে, যা ২০২৩ সালে ৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাংলাদেশকে ৪ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো গড় উৎপাদন ব্যয় কমানোর পথে নিয়ে গেছে।

বিদ্যুৎ খাতে গত বছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রায় তিনগুণ বৃদ্ধি করেছে। যা এক দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ বিদ্যুতের ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে ও ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচ কমাতে সাহায্য করেছে। চলতি বছরে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ আরো বাড়বে। কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি হিসেবে কয়লা প্রাধান্য পেয়েছে। কারণ বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমায় ও দুর্বল মুদ্রার কারণে ব্যয়বহুল প্রাকৃতিক গ্যাস, ফার্নেস অয়েল এবং ডিজেল আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছিল সরকার।

জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র এক কর্মকর্তা বলেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নতুন ইউনিট চালু হওয়ায় এ বছর কয়লার অংশ আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। বিশ্ব বাজারে তরল জ্বালানি ও গ্যাসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুৎ বিভাগ সংকোচন নীতিতে এগোচ্ছে। তবে পরিবেশবিদরা বলছেন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিবেশের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে। কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে। ঠিক একই সময়ে দেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রাখার প্রবণতা বাড়ছে। কারণ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ দামে সবচেয়ে সস্তা হওয়ায় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র অধিক পরিমাণে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড, সালফার ডাই-অক্সাইড, বিষাক্ত ভারী ধাতু মারকারিসহ বিবিধ ক্ষতিকর কণা নিঃসরণের জন্য দায়ী। নাইট্রোজেন ও সালফারের অক্সাইডগুলো বায়ুমণ্ডলে গিয়ে সালফিউরিক এসিড ও নাইট্রিক এসিড তৈরি করে, যা বৃষ্টির মতো ভূপৃষ্ঠে নেমে আসে, যাকে আমরা এসিড-বৃষ্টি বলি। এই এসিড-বৃষ্টি জীবদেহে ও কৃষিক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, দেশের অর্থনীতি খাত সচল রাখতে বিদ্যুতের প্রয়োজন রয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র খুবই কম। আবার যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে, সেগুলোতে আধুনিক যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা হচ্ছে। সুতরাং খুব বেশি পরিবেশে ক্ষতি করবে না। এরপরও আমরা বলতে চাই-পরিবেশ রক্ষায় নজর রাখতে হবে।

পরিবশে বাঁচাও আন্দোলনের আবু চেয়ারম্যান নাসের খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, তাপমাত্রা বাড়ায় মানুষের বিদ্যুতের চাহিদা বেড়েছে। সেই চাহিদা মেটাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে সরকারকে বাড়তি নজর দিতে হবে। এখানে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বিপুল পরিমাণ জমির দরকার হয়। কিন্তু আমাদের দেশে খালি জমির পরিমাণ কম। আবার ডলার সংকটে পর্যাপ্ত ডিজেল ও ফার্নেস অয়েল আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে গেলে খরচ অনেক বেড়ে যাবে। সেজন্য কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ঝুঁকে পড়ছে বিদ্যুৎ বিভাগ। তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানোর প্রভাবে স্থানীয় পর্যায়ে পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও বৈশ্বিক অবস্থার বিবেচনায় পরিবেশের ওপর তেমন কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মোট সক্ষমতা ২৬ হাজার ৫০৪ মেগাওয়াট। এরমধ্যে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা প্রায় ৪৪ শতাংশ, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ২২ দশমিক ৫৯ শতাংশ। তবে গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলে শুধু গ্যাস আমদানির মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ করা যেত। তবে গ্যাস সংকটের কারণে গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বসে থাকছে। ফলে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও পুরোদমে চালাতে হচ্ছে।

বিদ্যুৎ বিভাগের সূত্র বলছে, ঋণের দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিভাগ। অর্থের অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন কোম্পানিগুলোর বকেয়া পরিশোধ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কাছে পাওনা প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। পিডিবি বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) কাছে গ্যাস বিল বকেয়া রেখেছে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। ভারতের আদানির কাছে বিদ্যুতের দাম বকেয়া পড়েছে ৫০ কোটি ডলারের মতো (প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা)। জ্বালানি তেল আমদানিকারক সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) কাছে বিদেশি সরবরাহকারীরা পাবে প্রায় ২৭ কোটি ডলার (প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা)। আর বাংলাদেশে গ্যাস উত্তোলনকারী মার্কিন কোম্পানি শেভরন গ্যাসের দাম বাবদ পাবে ২০ কোটি ডলার (প্রায় ২ হাজার ২০০ কোটি টাকা)। এর বাইরে আরো কিছু খাতে বকেয়া রয়েছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের।

গরমের মৌসুম শুরু হয়েছে। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন হবে, আমদানি বাড়াতে হবে গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল। ডলার সংকটে প্রয়োজনে তরল জ্বালানি আমদানি কমে যাবে। জ্বালানির অভাবেই গত বছর গরমে বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রয়োজন অনুযায়ী চালানো সম্ভব হয়নি। এতে ঢাকায় দিনে ২ থেকে ৩ ঘণ্টা এবং গ্রামে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টাও লোডশেডিং করতে হয়েছিল।

বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালাতে জ্বালানি তেল, কয়লা আমদানিসহ অন্যান্য প্রয়োজনে কত ডলার লাগতে পারে, তা বছর শুরুর আগেই জানিয়েছিল পিডিবি। চলতি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) গত ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রথম ছয় মাসে তাদের চাহিদা ছিল ৩৭৩ কোটি ডলার। আগামী ছয় মাসে চাহিদা আরো বেশি হবে বলে কর্মকর্তাদের প্রক্ষেপণ রয়েছে। তবে নিয়মিত ডলার পাচ্ছে না পিডিবি। এতে আমদানি করা বিদ্যুতের দাম নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না সংস্থাটি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বেসরকারি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালিক বলেন, রমজানে বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে আমাদের বার্তা দেওয়া হয়েছে। সেজন্য সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ এর মোবাইলে এসএমএস ও কল করেও কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত