ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঢাকায় আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা

আ.লীগ সরকারই বিচার বিভাগ ও ইসির স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে

স্থায়ী আইন কমিশন গঠন ও বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করি
আ.লীগ সরকারই বিচার বিভাগ ও ইসির স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে

আওয়ামী লীগ সরকারই বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনের (ইসি) স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত দক্ষিণ এশিয়ার একবিংশ শতাব্দীর সাংবিধানিক আদালত: ভারত-বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা শীর্ষক দুই দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।

শেখ হাসিনা বলেন, আমরাই প্রথম সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ কার্যকর করে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিলাম। বিচার বিভাগের জন্য আলাদা বাজেট বরাদ্দ, আর্থিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব সুপ্রিমকোর্টের ওপর ন্যস্ত করা, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে পৃথক করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিধিমালা প্রণয়নের উদ্যোগ নেই। একটি স্থায়ী আইন কমিশন গঠন করি। এছাড়া বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুবিধাবঞ্চিত বিচার প্রার্থীদের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমরা ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন-২০০০’ প্রণয়ন করি। সে অনুযায়ী, জেলা জজের নেতৃত্বে আইন সহায়তা কমিটি গঠন, স্বতন্ত্র মেট্রোপলিটন সেশন আদালত স্থাপন এবং গ্রামীণ আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করি। ৬৪ জেলার দরিদ্র ও অসহায় বিচার প্রার্থীরা তার সুফল আজও পাচ্ছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন বিশেষ আদালত প্রতিষ্ঠা করি। ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে সুপ্রিমকোর্টের এনেক্স বিল্ডিং নির্মাণ করি। ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর দেশের প্রচলিত আইনে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার সম্পন্নকরণে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিচার বিভাগের বলিষ্ঠ ভূমিকায় জাতীয় চারনেতা হত্যাকাণ্ডের বিচার কাজও সম্পন্ন হয়েছে। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতির অবসান হয়েছে। তিনি বলেন, ২০২২ সালে ১২ তলা ‘বিজয়-৭১’ ভবন উদ্বোধন করেছি, যেখানে সুপ্রিমকোর্টের অনেকগুলো বেঞ্চের বিচার কার্যক্রম চলছে। ৬৪টি জেলায় চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন নির্মাণ করে দিচ্ছি; অর্ধেকের বেশি নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়েছে। আইনজীবীদের জন্য ১৫ তলাবিশিষ্ট বার কাউন্সিল ভবন নির্মাণ করেছি। বিচার বিভাগ ডিজিটাইজেশন ও ই-জুডিশিয়ারি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার আইন, ২০২০’ প্রণয়ন করে ভার্চুয়াল আদালত চালু করেছি। বিচার বিভাগকে ডিজিটালাইজড করতে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। সুপ্রিমকোর্টে অনলাইন কজলিস্ট এবং অধস্তন আদালতের জন্য অনলাইন বেইল কনফার্মেশন কার্যক্রম চলছে। সাধারণ বিচারপ্রার্থী জনগণ এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে আদালতের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেবা গ্রহণ করছে। সুপ্রিমকোর্টের সব রায় ও আদেশ অনলাইনে আপলোড করার কার্যক্রম চলমান আছে। তাছাড়া ওয়েবসাইটে ইংরেজি ভাষায় লিখিত রায় বিচার প্রার্থীরা এ্যাপসের মাধ্যমে বাংলায় পাঠ করার সুযোগ পাচ্ছেন। উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা বর্তমানে অনেক রায় ও আদেশ বাংলা ভাষায় প্রচার করছেন। ভাষার মাসে বিচার বিভাগের এসব কার্যক্রম সত্যিই প্রশংসনীয়। কয়েক ধরনের মামলা ই-ফাইলিংয়ের আওতায় এসেছে। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য স্মার্ট জুডিশিয়ারি প্রয়োজন। প্রধান বিচারপতির স্মার্ট জুডিশিয়ারি গঠনের এসব উদ্যোগ সত্যিই প্রশংসার দাবিদার।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানবাধিকারের কথা শুনি, ন্যায়বিচারের কথা শুনি। সেই ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার কি আমাদের ছিল না? আমি অনেকবারই হাইকোর্টে গিয়েছি, অনেক অনুষ্ঠানে গেছি। আমি যখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করি, আমি বারবার এই প্রশ্নটাই করেছি, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আমরা বিচার পাব না? আমরা যারা ১৫ আগস্ট আপনজন হারিয়েছি, আমরা বঞ্চিত থাকব। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করার পরে, অর্থাৎ আমাকেই ক্ষমতায় আসতে হলো ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আমাদের সংবিধানে তো বিচার পাওয়ার অধিকার সবারই আছে কিন্তু সেখানে আমাদের প্রশ্ন যে, আমরা কি অপরাধ করেছিলাম? ১৯৮১ সালে ছয় বছর আমাকে প্রবাসে থাকতে হয়, কারণ তখনকার মিলিটারি ডিকটেটর আমাকে আসতে দেবে না দেশে। রেহানাকেও আসতে দেবে না এবং তার পাসপোর্টটাও রিনিউ করতে দেয়নি।

তিনি বলেন, সেই অবস্থায় আমাকে যখন আওয়ামী লীগের সভাপতি আমার অবর্তমানে নির্বাচিত করা হয়, একরকম জোর করে জনগণের সমর্থন নিয়েই আমি দেশে ফিরে আসি। আমি যখন আমার বাবা-মা, ভাইয়ের হত্যার বিচারের জন্য মামলা করতে যাই, সেখানে মামলা করা যাবে না। ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স দিয়ে খুনিদের বিচারের হাত থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। এটা কেমন ধরনের কথা?

আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আজকে দেশে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই আর্থ-সামাজিক উন্নতি হচ্ছে। ২০০৯ থেকে এ পর্যন্ত যদি হিসাব করেন, আজকে দেশের যে আর্থ-সামাজিক উন্নতি হচ্ছে, সেটা গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই। একটা স্থিতিশীল পরিবেশ আছে বলেই এটা সম্ভব হয়েছে। আজকে এটা প্রমাণিত সত্য যে, মানুষের জীবনে ন্যায়বিচার প্রাপ্তি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নতি- এটা একমাত্র হতে পারে যখন মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করার সুযোগ হয়। তখন দেশ উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারে। আজ জনগণের মৌলিক অধিকার সুরক্ষিত করা হয়েছে। গণতান্ত্রিক ধারা ছাড়া কখনো কোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নতি সম্ভব নয়, উল্লেখ করে সরকারপ্রধান বলেন, ভারত-পাকিস্তান দুটি দেশ পাশাপাশি। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ যখন আত্মপ্রকাশ পেল, আমরা দেখলাম ভারতে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে। অন্যদিকে সেই পাকিস্তান আমলে হোক, আর বাংলাদেশ হওয়ার পরে হোক, আমরা মিলিটারি ডিকটেটরশিপের ওপর পড়েছি। বারবার আঘাত এসেছে গণতন্ত্রের ওপর, দেশের মানুষের মৌলিক অধিকারের ওপর। কোনো স্থিতিশীলতা ছিল না। আমরা স্বাধীনতা অর্জন করে আশা করেছিলাম, আমাদের ভূ-খণ্ডের মানুষ অন্তত একটা স্থিতিশীল জীবন পাবে, দেশের উন্নতি হবে। মানুষের উন্নতি হবে, জীবনমানের উন্নতি হবে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, আমরা যদি হিসাব করি, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতাকে হত্যার পরে সেই ৭৬ সাল থেকে ৯৬ পর্যন্ত এ দেশের মানুষ কী পেয়েছে? তাদের যে মৌলিক চাহিদাগুলো; কোনো চাহিদাই তো পূরণ হয়নি। হ্যাঁ, একের পর এক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সেই মিলিটারি ডিকটেটররা যারা এসেছে, হয়তো তারা লাভবান হয়েছে, মুষ্টিমেয় এলিট গ্রুপ তারা তৈরি করেছে কিছু মানুষকে সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করে দিয়ে। আর সাধারণ মানুষ অবহেলিত থেকে গেছে। তাদের ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার, তাদের সাংবিধানিক অধিকার অস্বীকার করা হয়েছে। তারা অবহেলিত, শোষিত, বঞ্চিতই থেকে গিয়েছিল। এরপর আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত ঠিক একই অবস্থার শিকার এ দেশের মানুষ। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, অগ্নিসংযোগ, মামলা-মোকদ্দমা এবং আমরা বিরোধীদলে থাকা অবস্থায় আমাদের অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছে। আর সাধারণ মানুষ কিন্তু সেই একই তিমিরে ছিল।

বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কিন্তু আইনের ছাত্র ছিলেন। আমাদের মাতৃভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এবং আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হন। তার কাছে প্রস্তাব গিয়েছিল, মুচলেকা দিয়ে এবং ১৫ টাকা ফাইন দিয়ে তিনি আবার ছাত্র হতে পারতেন। শেখ মুজিব তখন একজন ছাত্র। তিনি বলেছিলেন, আমি যদি মুচলেকা দেই আর যদি আমি এই অর্থ দেই, তার মানে হলো আমি আমার দোষ স্বীকার করে যাচ্ছি। আমি তো দোষ করি নাই। কাজেই আমি তা করব না। কাজেই তিনি সেই রাস্টিকেটই ছিলেন। আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাত্র কয়েক বছর আগে সেই রাস্টিকেট প্রত্যাহার করে। বঙ্গবন্ধু সব সময় স্বাধীন বিচার বিভাগে বিশ্বাস করতেন এবং তার আদর্শ নিয়েই আমাদের পথ চলা। তিনি বলেন, স্বাধীন বিচার বিভাগ, শক্তিশালী পার্লামেন্ট এবং প্রশাসন একটি দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।

ভারতীয় অতিথিরা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন ভারতের প্রধান বিচারপতি ধনঞ্জয় যশবন্ত চন্দ্রচূড় (ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়) এবং আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত