তদন্ত কমিটির সুপারিশের বাস্তবায়ন নেই

রাজধানীর বহুতল ভবন হয়ে উঠছে মৃত্যুকূপ

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর তদন্ত কমিটি গঠন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন সংস্থা। তদন্ত কমিটিগুলোর পক্ষ থেকে দেয়া হয় নানা সুপারিশ। কিন্তু সুপারিশগুলো শুধু কাগজে-কলমেই রয়ে যায়, মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়ন হয় না। ফলে রাজধানীর বহুতল ভবনগুলো হয়ে উঠছে এক একটি মৃত্যুকূপ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যেক বছরে ঢাকায় বহুতল ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বহু মানুষ মারা যাচ্ছে। ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পরপরই নড়েচড়ে বসে ফায়ার সার্ভিস, রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা। খুঁজতে থাকে ভবনের ত্রুটি। ত্রুটিপূর্ণ ভবন নির্মাণের দায়ে মালিকের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তেমনি পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর ১৭ দফা সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির ১৭ দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। প্রতি বছরই একটা না একটা বড় ধরনের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

জানা গেছে, ‘অগ্নিপ্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন ২০০৩’ ও ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ নিশ্চিত করা, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক বা বিস্ফোরক দ্রব্যের মজুদ বা বিপণনের বিরুদ্ধে জনমত গঠন, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক দ্রব্য বা বিস্ফোরক জাতীয় পদার্থ মজুদকরণ বা বিপণন কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা, ঘরবাড়িতে ব্যবহৃত বৈদ্যুতিক তারের গুণগত মান নিশ্চিত করা, রাস্তায় স্থাপিত খোলা তারের ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন, সম্ভাব্য দুর্ঘটনা পরিহার করতে প্রতি মাসে অন্তত একবার বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার সরেজমিন গিয়ে পরীক্ষা করা, দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের জন্য স্থানীয়ভাবে পৃথক পানির লাইনসহ হাইড্রেন্ট পয়েন্ট স্থাপন করা, দুর্ঘটনা মোকাবিলায় জাতীয় পর্যায়ে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন, রাসায়নিক ও রাসায়নিকজাতীয় দাহ্য বস্তুর আলাদা দফতরের পরিবর্তে সব দফতরের মধ্যে সমন্বয় সাধন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের অবকাঠামো, জনবল, প্রশিক্ষণ ও সরঞ্জামের আধুনিকায়ন, জনসচেতনতা বাড়ানো, অগ্নিকাণ্ডের সময় যেন উৎসুক জনতা উদ্ধারকাজে বিঘ্ন ঘটাতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা বাড়ানো, পাঠ্যসূচীতে অগ্নিকাণ্ড, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসার বিষয়গুলো বাধ্যতামূলক করা, ৬২ হাজার কমিউনিটি স্বেচ্ছাসেবক তৈরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা, কমিউনিটি সেন্টারগুলোকে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার আওতায় আনা এবং বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে ডেকোরেটরের উপকরণের সঙ্গে প্রয়োজনীয়সংখ্যক অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র রাখা প্রভৃতি। তবে এসব সুপারিশ কাগজে-কলমে থাকছে ভবনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না।

রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে ত্রুটিপূর্ণ উঁচু ভবনের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। বিল্ডিং কোড মানছেন না ভবনের মালিকরা। অদক্ষ কারিগর দিয়ে দায়সারা মেরামত করিয়ে নেন অনেকেই। এ কারণে প্রায়ই অগ্নিকাণ্ডের কবলে পড়তে হচ্ছে। সর্বশেষ রাজধানীর বেইলি রোডে কাচ্চি ভাই রেস্তোরায় অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। আর নীমতলী, চুড়িহাট্টা ও বনানীর এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২২১ জনের মৃত্যু হয়েছে। প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডে ভয়াবহ ক্ষতির পর নড়েচড়ে বসে সরকার। আশ্বাস দেয়, দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার। কিন্তু দৃশ্যপটে খুব একটা পরিবর্তন দেখা যায় না।

ফায়ার সার্ভিসের গত ৯ বছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে ১৭ হাজার ৪৮৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এরমধ্যে গত বছরই দেশে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ১০২ জনের প্রাণহানি ঘটেছে। ২০১৬ সালের ১৬ হাজার ৮৫৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ২৪৭ জন আহত ও ৫২ জন নিহত হয়। এতে ২৪০ কোটি ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ৮২২ টাকার ক্ষতি হয়। ২০১৭ সালের ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নিকাণ্ডে ২৬৯ জন আহত ও ৪৫ জন নিহত হয়। এতে ক্ষতি হয়েছে ২৫৭ কোটি ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮৬ টাকার। ২০১৮ সালে ১৯ হাজার ৬৪২টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৬৬৪ জন আহত ও ১৩০ জন নিহত হয়েছে। এতে ৩৮৫ কোটি ৭৭ লাখ ৩৫ হাজার ৮৯৫ টাকার ক্ষতি হয়। ২০১৯ সালে ২৪ হাজার ৭৪টি অগ্নিকাণ্ডে ৫৬০ জন আহত ও ১৮৪ জন নিহত হয়। এতে ক্ষতি হয়েছে ৩৩০ কোটি ৪১ লাখ ২৮ হাজার ৭৪৪ টাকার। ২০২০ সালে ২১ হাজার ৭৩টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩৮৬ জন আহত ও ১৫৪ জন নিহত হয়। এতে ২৪৬ কোটি ৬৫ লাখ ৯৫ হাজার ৪৪ টাকার ক্ষতি হয়েছে। ২০২১ সালে ২১ হাজার ৬০১টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে ৫৭৬ জন আহত ও ২১৯ জন নিহত হয়। এ সময় ক্ষতি হয়েছে ২১৮ কোটি ৩১ লাখ ৯৭ হাজার ৪০৩ টাকার। ২০২২ সালে ২৪ হাজার ১০২টি অগ্নিকাণ্ডে আহত হয় ৪০৭ জন, নিহত হন ৯৭ জন। সে বছর আগুনে ক্ষয়ক্ষতি হয় ৩৪২ কোটি ৫৮ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৯ টাকার। ২০২৩ সালে দেশে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ডে সারা দেশে ২৮১ জন আহত ও ১০২ জন নিহত হয়। এই অগ্নিকাণ্ডে ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়। ২০২৩ সালে গড়ে প্রতিদিন ৭৭টি করে বছরে ২৭ হাজার ৬২৪টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। মোট সম্পদের ক্ষতি হয় ৭৯২ কোটি ৩৬ লাখ ৮২ হাজার ১৪ টাকার। আর এ বছর শুরু হতে না হতেই যোগ হলো আরও ৪৬ নাম। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অগ্নিকাণ্ডের উৎস বিড়ি-সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো, বৈদ্যুতিক গোলযোগ, গ্যাসের লাইন ও চুলা।

২০১০ সালের ৩ জুন রাত ৯টায় রাজধানীর চানখারপুলের নিমতলীতে একটি বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরণ ঘটে। আগুন ধরে যায় পাশের কেমিক্যালের গোডাউনে। মুহূর্তেই দাহ্য পদার্থ ও কেমিক্যালে ঠাসা ওই এলাকার বেশ কয়েকটি ভবনে ছড়িয়ে পড়ে আগুন। যখন ভয়ংকর সেই আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যান ১২৪ জন। আহত হন প্রায় অর্ধশতাধিক। পুড়ে যায় ২৩টি বসতবাড়ি, দোকান ও কারখানা। নিমতলী ট্র্যাজেডি আলোড়ন ফেলেছিল দেশজুড়ে। নিমতলীর ঘটনার পরেই চুড়িহাট্টা অগ্নিকাণ্ড। ২০১২ সালে আশুলিয়া তাজরিন ফ্যাশন ফ্যাক্টরিতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। সেই অগ্নিকাণ্ডে ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। আহত হয় প্রায় দুইশ’ জনের মতো। অগ্নিকাণ্ডের পরেও মৃত্যুও হয় আরও কয়েকজন শ্রমিকের।

২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় রাজধানীর চকবাজারের চুড়িহাট্টা এলাকায় হঠাৎ বিকট শব্দে সিলিন্ডারের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ওয়াহেদ ম্যানশনে থাকা কেমিক্যালের কারণে আগুন ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যা ছড়িয়ে পড়ে সড়কে যানজটে আটকে থাকা পিকআপ, প্রাইভেট কার, রিকশা, ঠেলাগাড়ি ও মোটরসাইকেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই যানজটে আটকে থাকা অর্ধশতাধিক মানুষ প্রাণ হারান। চুড়িহাট্টা মোড় হয়ে ওঠে যেন মৃত্যুকূপ। আগুন লাগার ১৪ ঘণ্টা পর নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। তার আগেই ঘটনাস্থলে মৃত্যু হয় ৬৭ জনের। পরে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭১। এতে আহত হন কয়েকশ’ মানুষ। এরপর বনানী এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ড। ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুর ১টায় লাগা আগুনে ২৭ জনের মৃত্যু এবং শতাধিক আহত হয়। ২২তলা ওই ভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছিল। ২০২১ সালের ২৭ জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে মগবাজার ওয়্যারলেস এলাকার ‘রাখি নীড়’ নামে একটি ভবনের নিচতলায় বিস্ফোরণ হয়। ওই ঘটনায় ১২ জনের মৃত্যু হয়। আহত হন দুই শতাধিক ব্যক্তি। বিস্ফোরণের ঘটনায় করা মামলার তদন্তভার পাওয়া পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট কর্মকর্তারা জানিয়েছিল, ছয়টি সরকারি সংস্থা তদন্ত করেছে। এর মধ্যে চারটি সংস্থা সিটিটিসিকে সহযোগিতা করছে না। আর ঘটনার পরপরই ভবনটির ভেতরে ত্রুটিপূর্ণ লাইন থেকে নির্গত গ্যাস থেকেই বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে বলে ওইসময় বিস্ফোরক পরিদফতরের তদন্তে উঠে এসেছিল। সর্বশেষ বেইলি রোড কাচ্ছি ভাই রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জনের মৃত্যু হয়।