আগুনে মরিনি : বেঁচে থেকেও তো স্বস্তি পাচ্ছি না

প্রকাশ : ০৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শেখ কুতুব আলী

রাজধানীর বেইলি রোডে গত বৃহস্পতিবারের আগুনে এত বেশিসংখ্যক মানুষের প্রাণহানির পর কেন যেন মনে হচ্ছে আমিও প্রাণে বেঁচে আছি কি না। আমার সন্তান কিংবা নিকট কোনো আত্মীয়স্বজন মারা যায়নি। স্বাভাবিকভাবে আমার কোনো দুঃখবোধ থাকার কথা নয়। কিন্তু আমার তো আতঙ্ক কাটছে না। আমি হয়তো বেইলি রোডের আগুন থেকে রক্ষা পেয়েছি। কিন্তু আগামী দিনে আর কোনো বেইলি রোড কি আমার ও আমার সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছে না? আগুনে আমি নিজে কিংবা আমার সন্তান কিংবা পরিবার পরিজন কেউ মারা যায়নি। যেতেও তো পারত। আমার আপন কেউ মারা গেলে আমার মনের অবস্থা কেমন হতো সেই চিন্তা-ভাবনা করতে করতে আমার মনে হয়েছে আসলে আমিও কি বেঁচে আছি। আমিও কি আহাজারি করছি না? বেঁচে থাকার জন্য প্রতিনিয়ত ছটফট করছি না? গণমাধ্যমে বেইলি রোডের আগুনের খবর পড়ে কিংবা টেলিভিশনে খবর দেখে ভয়ার্ত হয়ে উঠছি। যারা খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছে তারা এই প্রিয় দুনিয়া ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় কী ভেবেছিলেন, তা তো কাউকে কিছু বলে যেতে পারেননি। তারা কি মনোবেদনা নিয়ে পৃথিবী থেকে চলে গেলেন, সেটাও আমরা কেউ জানি না। প্রিয় সন্তান স্ত্রী পরিবার পরিজন দুনিয়াতে রেখে আগুনে পুড়তে পুড়তে সবার দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়া যে কি কঠিন, তা যদি কেউ একবার ভাবেন তাহলে তিনি হয়তো বুঝতে পারবেন আগুনে মৃত্যু যন্ত্রণা কতটা ভয়াবহ। ক্ষণিক সময়ের মধ্যে কি নিদারুণ কষ্ট নিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে হলো তাদের। ভাবতেই আঁতকে উঠতে হয়। মানুষ যখন পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে, তখন সে কিছুই বুঝতে পারে না। অথচ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে চোখের সামনে আগুন মানুষকে গ্রাস করছে পুরো শরীর পুড়ে যাচ্ছে। পোড়া চামড়ার বিকট গন্ধ নাকে আসছে। দম নিতে কষ্ট হচ্ছে। একসময় শ্বাসনালী পুড়ে শেষ নিঃশ্বাসটিও বাতাসে মিলিয়ে গেল। যারা মারা গেছেন, তাদের এই কষ্টের কথা তো আমরা যারা বেঁচে আছি তারা সহজে অনুভব করতে পারব না। আগুনে মৃত্যুর ঘটনা আমাদের দেশে নতুন নয়। অনেক বড় বড় আগুনে শত শত মানুষ মারা গেছে অতীতে। মৃত্যুর পর অনেকে শোকবার্তা দিয়েছেন। আমার ব্যক্তিগত বক্তব্য হচ্ছে- শোকবার্তা দিতে গিয়ে যতক্ষণ সময় ব্যয় হয়েছে, সেই সময়টা যদি এ ধরনের ঘটনার যাতে আগামীতে আর না ঘটে, সেই কাজে ব্যয় করা হতো, তাহলে হয়তো আরো কল্যাণকর হতো। শোকবার্তায় পোড়া শরীরের ক্ষত শোকায় না। মৃত্যু যন্ত্রণা কমে না। আপনজনের কান্না থামে না। আগামীতেও হয়তো এভাবে অনেকে আগুনে মারা যাবে। এমন ক্রটিপূর্ণ ভবন আগামীতেও হয়তো নির্মাণ হবে। বর্তমানে যেসব ভবন রয়েছে সেগুলোও নিরাপদ কিনা, সেই চিন্তাভাবনাও করতে হবে। ভবন ব্যবহার করার আগে দেখতে হবে ভবনে আগুন লাগলে বাঁচার কোন পথ আছে কিনা। ভবন ধসে পড়লে ইট-পাথবেরর নিচে পড়ে মারা যাব কিনা। আমাদের জীবনের কী কোনো নিশ্চয়তা আছে, একটু ভাবলেই বোঝা যাবে। খাবার টেবিলে মারা যাওয়া, খেতে গিয়ে মারা যাওয়া, প্রিয় সন্তান নিয়ে খাবার টেবিলে মারা যাওয়ার মতো ঘটনা কীভাবে ভুলে যাবে মানুষ। অথচ একদিন বাধ্য হয়ে ভুলে যেতে হবে। কেন না, আমাদের রাষ্ট্র সেই নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। ঘরে থাকলে আগুন, গ্যাস বা অন্য কোনো কারণে বিস্ফোরণ কিংবা রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে মৃত্যু, রাস্তায় দুর্ঘটনায় মৃত্যু। আগুনে পুড়তে পুড়তে মারা যেতে কতটা সময় লাগে সেই হিসাবটা যদি কেউ দিতে পারতেন তাহলে মানুষ সেই সময়টা নিয়ে দুনিয়ায় বেঁচে থাকতে একটু কল্পনা করতে পারত। মানুষের শরীর যখন আগুনে পুড়তে থাকে, তখন কেমন আজাব হয়; সেটা কি জাহান্নামের আগুনের মতো নাকি ইটভাটার আগুনের মতো। সেই চিন্তাচেতনার পরিধি কী আমাদের মস্তিকে আছে। নিউরো সায়েন্সের বিজ্ঞানীরা কি বলতে পারবেন আগুনে পুড়ে মানুষের মারা যেতে কতটুকু সময় লাগে। তখন মানুষের শরীরে কী ধরনের যন্ত্রণা হয়। আর তখন তার মনের অবস্থাই কেমন হয়। দুনিয়াকে বিদায় জানাতে গিয়ে মানুষ শেষ কোন সংলাপটি উচ্চারণ করে, সেই খবর তো আমাদের কাছে নেই। বেইলি রোডের আগুনে হয়তো মরিনি এটা ঠিক, তবে আরো তো অনেক মৃত্যুকূপ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। সেগুলোতো তো আমাদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে- হে আদম সন্তান তুমি আসো, তোমার মৃত্যুর পরোয়ানা আমি তামিল করি। স্বাভাবিক মৃত্যুর স্বাদতো গ্রহণ করতেই হবে। জন্মিলে মরিতে হবে। তবে সেটা কীভাবে সেই প্রশ্ন থাকেই যায়। হঠাৎ করে মরে যাওয়ার মধ্যে যন্ত্রনা আর আগুনে পুড়তে পুড়তে মারা যাওয়ার যন্ত্রণার মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আছে, সেটাও আমি জানি না। আমি জানি না কোনো রেস্টুরেন্টে গিয়ে আমি খেতে খেতে মারা যাব কি না। আমি জানি না কোনো যানবাহন উল্টা দিক দিয়ে এসে আমার জীবনটা কেড়ে নেবে কি না। আমি জানি না মুত্যুর সময় আামি আমার আপনজনের মুখখানি দেখে যেতে পারব কি না। যে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যু আমাকে ভাবায়, আমাকে কাঁদায়, আমাকে ব্যথিত করে। এসব ভেবে আমি মনে মনে ভাবি আমি বেঁচে থাকলেও অপঘাতের মৃত্যু আমাকে আলিঙ্গন করা জন্য অপেক্ষা করছে।

বেইলি রোডের ভবনের মধ্যে আটকে পড়া মানুষ শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন, মোবাইল ফোনে কান্নাকাটি করেছে। নিচে নামতে গিয়ে বাধাগ্রস্ত হয়েছেন। ছোট সিঁড়ি দিয়ে বের হতে গিয়ে অনেকে নামতে পারেনি। ভবনের ছাদে গিয়েছে। ভাগ্যিস ছাদটি খোলা ছিল। ঢাকা শহরের বাড়ির মালিকদের মতো যদি ছাদের দরজা তালাবদ্ধ থাকত। তাহলে তো মানুষ ছাদের ওপর যেতে পারত না। আগুনের ধোয়া ও আগুন মানুষকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে। আটকে পড়া মানুষ কোথায় যাবে, তা নিয়ে ভবনের মধ্যে ছোটাছুটি, বাঁচাও বাঁচাও বলে চিৎকার, প্রিয়জন থেকে শেষ বিদায়। শেষ কথা, শেষ আকুতি জানিয়ে ৪৬ জন মানুষ মারা গেলেন। তারা মারা গেলেন নাকি আমাদের দেশের ভবন ব্যবস্থাপনার কারণে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে তারা পরপারে চলে গেলেন। তাদের চলে যাওয়া স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয়া বড়ই কঠিন। বড়ই বেদনার। তবে আমরা যারা প্রাণে বেঁচে আছি তারা অনেকটা মৃতপ্রায়। কেন না এতগুলো মরদেহ, এগুলো আহত মানুষের আহাজারি কীভাবে সহ্য করব- সেই চিন্তায় আচ্ছন্ন থাকতে হচ্ছে। যারা ওই ভবনের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খাবার খেতে গিয়েছিলেন, তারা কি কখনো যানতেন এটাই হবে তাদের শেষ খাবার। এটাই হবে তাদের শেষ যাত্র।