মেডিক্যাল শিক্ষকের হাতে অবৈধ পিস্তল

ক্লাসে শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা কোথায়!

প্রকাশ : ০৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  শেখ কুতুব আলী

অনেকে হয়তো শুনেছেন, আগের দিনে পিতা-মাতারা তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করার পর শিক্ষকদের বলে আসতেন ‘মাস্টার সাব আমার ছেলেটাকে রেখে গেলাম। চামড়াটা আপনার আর হাড়গুলো আমার’। এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে অনেক বার্তা দেয়া হতো। প্রথমত সন্তানটিকে লেখাপড়া শেখানোর গুরু দায়িত্ব শিক্ষকের ওপর অর্পণ করা হতো। আর সেজন্য যা যা করার দরকার শিক্ষকগণ তাই তাই করতেন। এজন্য ‘বেত্রাঘাত করতে করতে পিঠের চামড়া তুলে নেয়ার অধিকার’ একজন অভিভাবক শিক্ষকদের দিতেন। শিক্ষকরাও নিজের সন্তান মনে করে ছাত্রদের লেখাপড়াসহ নানা বিষয়ে উপদেশ কিংবা পরামর্শ দিতেন। শিক্ষকদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সন্তানটি যেন লেখাপড়া শিখে মানুষ হয়। আগের দিনে সন্তানদের লেখপড়ার প্রতি অভিভাবকদের যতটা আগ্রহ ছিল তার চেয়ে বেশি ব্যাকুল থাকতেন শিক্ষকরা। সে কারণে শিক্ষকরা শিক্ষকতাকে মহান ব্রত হিসেবে গ্রহণ করে ছাত্রদের শাসন করতেন। বছরের শুরুতে প্রধান শিক্ষক দপ্তরির মাধ্যমে হাটবাজার থেকে বেত কিনে তা ছোট টুকরো করে মসৃণ করাতেন। যাতে বেত্রাঘাত করলে হয়তো ব্যথা পাবে তবে রক্তক্ষরণ হবে না। তবে বেত্রাঘাত না করে বেত নাড়াচাড়া করে ছাত্রদের ভয় দেখানোই ছিল শিক্ষকদের মূখ্য উদ্দেশ্য। একদম পড়ালেখা না করলে কিংবা ক্ষমার অযোগ্য কোনো অন্যায় করলে অন্য ছাত্ররা যাতে সতর্ক হয় সেজন্য দুই-চারটা বেত্রাঘাত শিক্ষকরা করতেন। তবে শিক্ষকদের মারমূখি হুঙ্কারে ছাত্ররা ভয় পেয়ে পড়ালেখা করত এবং সে সময় ছাত্ররা যা কিছু শিখত সেটা ছিল আসল শিক্ষা। একটা ছাত্র যে পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে সে সেই পর্যন্ত শিক্ষা ভালোভাবেই অর্জন করতে পারত। আজকাল কেন যেন শিক্ষার মান কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে ধরে রাখা যাচ্ছে না। তবে এখন শিক্ষকরা কোনো ছাত্রকে বেত্রাঘাত করেন না। ক্লাসের পড়া না পারলে দুই আঙ্গুলের মধ্যে পিন্সিল ঢুকিয়ে শাস্তি দেন না। এমন কি বকাঝকাও করেন না। ছাত্ররা পড়া শিখুক কিংবা না-ই শিখুক ছাত্রদের বেত্রাঘাত করা যাবে না। ধমক দেয়া যাবে না। ভর্ৎসনা করাও যাবে না। আত্মসম্মানের জন্য হানিকর এমন কোনো কথাও বলা যাবে না। তবে মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফ ছাত্রকে লক্ষ্য করে ক্লাসরুমে নিজের পিস্তল দিয়ে গুলি করবেন এটা কেউ কোনো দিন ভাবতেও পারেনি। মেডিকেল কলেজের শিক্ষক হয়ে নিজের কাছে অস্ত্র রাখবেন এটা কি আধুনিক যুগের নতুন সংযোজন কি না তা নিয়েও ভাবতে হবে।

অভিযোগ রয়েছে ওই শিক্ষক কেবল ক্লাশরুমেই নয়, অন্যত্র চলাফেরা করার সময়ও নাকি অস্ত্র বহন করেন। রাজধানী ঢাকায় এক সময় কয়েকজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম মানুষের মুখে মুখে ছিল। তারা নিজেরা অস্ত্র বহন করত। তাদের সহযোগী বা বডিগার্ডরাও অস্ত্র বহন করত। সন্ত্রাসী হিসেবে মাস্তানি করে কোটি কোটি টাকার মালিক ছিল তারা। সে কারণে তাদের প্রতিপক্ষ দাঁড়িয়ে যায়। এজন্য তারা যেখানে যেত সেখানে অস্ত্র নিয়ে বের হতো এবং দেহরক্ষী রাখত। এখনো অনেকে অস্ত্র নিয়ে চলাফেরা করেন। তবে তাদের সেই অস্ত্র হতে হবে বৈধ। তবে ছাত্রকে লক্ষ্য করে গুলি করা সিরাজগঞ্জের শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজের শিক্ষক রায়হান শরীফের অস্ত্রটি ছিল অবৈধ। তিনি নাকি অস্ত্রের ব্যবসাও করেন।

জীবনের নিরাপত্তার কারণে আমাদের দেশে যে কোনো ব্যক্তি অস্ত্র বহন করতে পারেন। তবে ওই শিক্ষক কেন পিস্তল বহন করতেন তা জানা যায়নি। শিক্ষকতার বাইরে তিনি কোনো অন্যায় অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন কি না তাও জানা যায়নি। তদন্তে হয়তো বেরিয়ে আসবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একবার ছাত্রলীগের কোনো এক অনুষ্ঠানে ছাত্রলীগের কর্মীদের হাতে কলম তুলে দিয়ে বলেছিলেন, অস্ত্র নয়, হাতে থাকবে কলম। অথচ বিজ্ঞানের একজন মেধাবী ছাত্র হয়ে রায়হান শরীফ মেডিকেল শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অথচ তিনি একজন অবৈধ অস্ত্রধারী। যে ব্যক্তি অস্ত্র ধারণ, সংরক্ষণ কিংবা অস্ত্র ব্যবহারবিধি জানেন না তিনি তো অন্যের জীবনের জন্য হুমকি। যিনি ক্লাসে ছাত্রকে লক্ষ্য করে গুলি করতে পারেন তার হাত থেকে অন্য কেউ রক্ষা পেতে পারেন সেই কল্পনা মানুষ এখন হয়তো করতে শুরু করবেন। কেননা এটাই বোধহয় দেশের ইতিহাসে প্রথম এ ধরনের ঘটনা। একজন শিক্ষক নিয়োগ করার আগে তার মনমানসিকতা অনুধাবন না করে তাকে যারা নিয়োগ দিলেন তাদের দোষ দিয়ে লাভ হবে না। কেননা একজন শিক্ষক অস্ত্রবাজ হবেন সেটা কি করে সম্ভব, তা কল্পনাকেও তো হার মানায়। ক্লাসে যেখানে বেত নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ সেখানে অস্ত্র নিয়ে ক্লাশ করার বৈধতা তাকে কে দিল সেটাও বোধগম্য নয়। ক্লাসে অস্ত্রবাজি করে বাংলাদেশে প্রথম দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেন শিক্ষক রায়হান শরীফ। তৃতীয় বর্ষের এক শিক্ষার্থীকে গুলি করা সেই শিক্ষকের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ আরাফাত আমিন তমালের দেহে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। গুলিবিদ্ধ আরাফাত ও তার সহপাঠীরা জানান, শিক্ষক রায়হান শরীফ ক্লাস রুটিনে ক্লাস না থাকা সত্ত্বেও সময়-অসময়ে শিক্ষার্থীদের ডেকে এনে তার ক্লাশ করতে বলতেন।

গত রোববার বিকালে হঠাৎ আরাফাতসহ আরও কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মোবাইল ফোনে কল করে ক্লাসে আসতে বলেন। কিন্তু আরাফাতসহ শিক্ষার্থীদের কেউই ক্লাসে আসেননি। গত সোমবার বিকাল ৩টার দিকে ফরেনসিকের ভাইবা ক্লাস চলার সময় তিনি আগের দিনের প্রসঙ্গ তুলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা করতে করতে একপর্যায়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করে গুলি করেন। গুলিটি আরাফাতের ডান পায়ের ঊরুতে লাগে। তার চিৎকারে সবাই এগিয়ে এসে তাকে আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি করায়। পরে শিক্ষার্থীরা ওই শিক্ষককে তালাবদ্ধ করে রাখে। খবর পেয়ে পুলিশ এসে তাকে ওই পিস্তলসহ তাদের হেফাজতে নিয়ে যায়। ওই মেডিকেল কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুস সাকিব উচ্ছ্বাস দাবি করেন, ওই শিক্ষক অসময়ে ক্লাস নিতে চাইলে শিক্ষার্থীরা তাতে রাজি ছিল না। তিনি সবাইকে জোর করে ক্লাসে বসান। এরপর তার পিস্তলটি বের করে এক ছাত্রীর কানের পাশে নিয়ে আরাফাতের দিকে গুলি করেন। গুলি আরাফাতের পায়ে লাগে। মূলত তিনি অস্ত্রের প্রদর্শন করার জন্যই গুলিটি করেন। ছাত্রলীগের এই নেতা আরও দাবি করেন, তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পাস প্রাঙ্গণে এর আগেও গুলি করার অভিযোগ আছে।

তিনি শিক্ষার্থীদের হলে গিয়েও অস্ত্র প্রদর্শন করেন। শিক্ষার্থীদের নেশা করার প্রলোভনসহ অনেক কথা বলেন। ছাত্রীদের নিয়ে রাতে কলেজে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য করতেন। এসব বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে এর আগে জানানো হলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এ ঘটনায় অভিযুক্ত শিক্ষকের বিচার চেয়ে বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। অভিযুক্ত ডা. রায়হান শরীফ কলেজের কমিউনিটি মেডিসিন বিভাগের শিক্ষক। আহত আরাফাত বগুড়া পৌর শহরের নাটাই পাড়া ধানসিঁড়ি মহল্লার আবদুল্লা আলামিনের ছেলে। আরাফাতের অনেক সহপাঠী জানান, ওই শিক্ষক শিক্ষকদের সঙ্গেও রূঢ় আচরণ করেন। তিনি সবসময় ব্যাগে অস্ত্র ও ছোরা নিয়ে ক্লাসে এসে অস্ত্র টেবিলের ওপর রেখে ক্লাসে লেকচার দিতেন। ছাত্রছাত্রীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ক্লাসে না আসতে বললে তিনি তাদের ভয়ভীতি ও গুলি করে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিতেন বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ বলছে, অস্ত্রের প্রতি বিশেষ আকর্ষণ ছিল রায়হান শরীফের। একটি বিদেশি পিস্তল কিনেছিলেন লাখ টাকায়।

রায়হান শরীফের হেফাজত থেকে সেভেন পয়েন্ট ফাইভ সিক্স বোরের অত্যাধুনিক দুটি বিদেশি পিস্তল, ৮১টি গুলি, চারটি ম্যাগাজিন ও ১২টি বিদেশি চাকু উদ্ধার করা হয়েছে। ওসি আরও জানান, গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমাল বগুড়া শহরের নাটাইপাড়া ধানসিঁড়ি এলাকার আবদুল্লাহ আল আমিনের ছেলে। তার করা মামলায় শিক্ষক রায়হান শরীফকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। তাকে গ্রেপ্তারের পর তার ফোন ঘেঁটে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা অত্যাধুনিক বিদেশি পিস্তলের বহু ছবি পাওয়া গেছে। রায়হান শরীফ অস্ত্র কেনাবেচার ব্যবসাও করতেন। রায়হান শরীফের বিরুদ্ধে থানায় দুটি মামলা হয়েছে। তার মধ্যে একটি মামলার বাদী গুলিবিদ্ধ শিক্ষার্থী আরাফাত আমিনের বাবা আবদুল্লাহ আল আমিনের করা। এ মামলায় তিনি তার ছেলেকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ এনেছেন। এছাড়া সিরাজগঞ্জ ডিবির উপ-পরিদর্শক (এসআই) আবদুল ওয়াদুদ বাদী হয়ে অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ আইনে আরেকটি মামলা করেছেন।

এ ঘটনায় এরইমধ্যে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। কমিটিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. বায়জীদ খুরশীদ রিয়াজকে আহ্বায়ক করা হয়েছে। তদন্ত কমিটিকে আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। গতকাল বেলা ১১টার দিকে কলেজে এসে পৌঁছায় তদন্ত কমিটির সদস্যরা। এরপর সেই ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন তারা। এরপর তারা যান কলেজ হোস্টেলে। সেখানে গিয়ে প্রথমে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। এরপর কথা বলেন তাদের হোস্টেলের শিক্ষার্থী ও সহপাঠীদের সঙ্গে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কোনো শিক্ষক যদি ক্লাসে অস্ত্র নিয়ে যান এবং তার ছাত্রদের ওপর ব্যবহার করেন তাহলে আমাদের সন্তানদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে যাবে।