ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কার দোষে কে ভোগে

হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ধস

হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসায় ধস

রাজধানীসহ সারাদেশে বাণিজ্যিক ভবনে ভাড়া নিয়ে হোটেল-রেস্তোরাঁ ব্যবসা করছেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু রাজধানীর বেইলি রোডে কাচ্চি ভাই রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের পর নড়েচড়ে বসে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) সিটি করপোরেশন, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশসহ বিভিন্ন সংস্থা। এসব অভিযানে হোটেল-রেস্তোরাঁর শ্রমিক-কর্মীদের আটক করলেও মূলহোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। তবে শ্রমিকদের আটকের ইস্যুতে বিভিন্ন মহলেও সমালোচনা চলছে।

হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান পরিচালনাকারী আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, রাজউক ও সিটি করপোরেশনের কর্তৃপক্ষ বলছে, অভিযানের সময় মালিকরা পলাতক থাকায় তাদের গ্রেপ্তার করা বা আইনের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছে না। গত এক সপ্তাহে বিভিন্ন হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও ভবনে অভিযান চালিয়ে শতাধিক ব্যাক্তিকে আটক করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে- মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প, রিং রোড, তাজমহল রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় হোটেল-রেস্তোরাঁয় অনিরাপদ সিলিন্ডার ব্যবহারের কারণে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩৫ জনকে আটক করা হয়েছে। কামরাঙ্গীরচরে বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনার কারণে শ্রমিক ও ম্যানেজারসহ ২৪ জনকে আটক করেছে পুলিশ। ওয়ারী থানার র‍্যাংকিন স্ট্রিট সড়কের কাচ্চি ভাই রেস্টুরেন্ট, ফুড স্টোভ, শর্মা কিং, দি ডাইনিং লাঞ্চসহ অন্তত ২০টি হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে সেখানে কর্মরত ৪৯ জনকে আটক করে পুলিশ ও ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট।

সরকারি সংস্থাগুলোর এসব অভিযানে আটকের বাইরেও এখন পর্যন্ত কয়েক ডজন রেস্তোরাঁ সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। এতে করে অভিযান আতঙ্কে অধিকাংশ মালিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে গা ঢাকা দিয়েছেন বলে জানা গেছে। গত মঙ্গলবার রাজধানীর বিজয়নগরে সংবাদ সম্মেলন করেন রেস্তোরাঁ মালিকরা। ওই সম্মেলনে বলা হয়েছে, রাজধানীতে গত কয়েক দিনের অভিযানে প্রায় ৪০টির মতো রেস্তোরাঁ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আমরা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের অপেক্ষায় আছি। যদি সাক্ষাৎ না পাই, তাহলে সব রেস্টুরেন্টের চাবি প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠিয়ে দিয়ে অন্য কাজে চলে যাব। গ্যাসের পর্যাপ্ততা নেই। সংযোগ থাকলেও লাইনে গ্যাস নেই। বিকল্প ব্যবস্থা হলো গ্যাস সিলিন্ডার বা লাকড়ি ব্যবহার। লাকড়ি ব্যবহার করলে কিচেনসহ পুরো রেস্টুরেন্ট কালো হয়ে যায়, পরিবেশ ঠিক থাকে না। পুরো বিষয়টি নিয়ে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি টাস্কফোর্স গঠন করে ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চাচ্ছি। ভবিষ্যতের জন্য নির্দিষ্ট একটি গাইডলাইন তৈরি করতে হবে, যাতে ব্যাঙের ছাতার মতো রেস্তোরাঁ গজিয়ে উঠতে না পারে।

রাজউক এলাকায় বহুতল ভবন ৫ লাখ ১৭ হাজার, এরমধ্যে প্রায় ৩০ হাজার হোটেল-রেস্তোরাঁ রয়েছে। এসব রেস্তোরাঁয় প্রায় ৫ লাখ মানুষ কাজ করেন। রেস্তোরাঁ মালিকদের ব্যাংকঋণ রয়েছে। রাজউক, সিটি করপোরেশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে ব্যবসায় ধস নেমেছে। এতে আগামীতে রেস্তোরাঁ মালিকদের ব্যাংকঋণ পরিশোধে ভোগান্তিতে পড়বেন।

জানা গেছে, সারাদেশে প্রায় ৫ লাখ রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। রাজধানীতে যেসব রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে সেগুলো একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কারণ রাজউকের আওতাধীন এলাকায় ৬১ শতাংশ ভবন অনুমোদনহীনভাবে নির্মাণ হয়েছে। আর অনুমোদিত ৭৭ শতাংশ ভবন ব্যবহার ক্যাটাগরি মানছে না, ৯০ শতাংশ ভবনের নকশার ব্যত্যয় ঘটিয়েছে। রাজউকের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট মানছে না ভবন মালিকরা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, পুরান ঢাকার লালবাগ জনঘনত্ব বিবেচনায় বিশ্বে শীর্ষে। সেখানে বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন নিয়ে ভবন মালিকরা কোনো ধরনের ব্যবসা করছেন, সেটি মনিটরিংয়ের দায়িত্ব রাজউক, সিটি করপোরেশন, তিতাস ওয়াসা ও ফায়ার সার্ভিসের। কারণ ভবন মালিকরা অধিক মুনাফার লোভে বাণিজ্যিক ভবনে রেস্তোরাঁ ভাড়া দিচ্ছে।

জানা গেছে, ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) বিশেষ অভিযানে রেস্তারাঁ মালিক ও কর্মচারীসহ ৮৮৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। দায়ের করা হয়েছে ২০টি মামলা। গত ৩ থেকে ৫ মার্চ পর্যন্ত ঢাকার হোটেল-রেস্তোরাঁ, গ্যাস সিলিন্ডারের দোকান ও কেমিক্যাল গোডাউনে এই বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হয়। ৩ দিনে ১১০০-এর বেশি হোটেল-রেস্তোরাঁয় অভিযানে যায় পুলিশ।

অভিযানের বিষয়ে ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহাঙ্গীর আলম বলেন, কাউকে গ্রেপ্তার করা বা ভবন সিলগালা করা আমাদের অভিযানের উদ্দেশ্য নয়। মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা দূর করাই আমাদের উদ্দেশ্য। তিনি বলেন, অভিযানের সময় হোটেল-রেস্তোরাঁর যথাযথ অনুমোদন রয়েছে কি না, নিরাপদ স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হচ্ছে কি না, নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটুকু টেকসই, অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র এবং ঝুঁকির বিষয়গুলো যথাযথভাবে যাচাই করা হচ্ছে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আইনের আওতায় আনার নির্দেশ দিচ্ছি আমরা। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভবন মালিকরা অভিযানের খবর পেলেই গা ঢাকা দেন।

ঢাকা মহানগর অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, সরকারি সংস্থাগুলোর অভিযান পরিচালনার সময় সেখানে কর্মরত শ্রমিকরা তথ্য লুকানো এবং ভুল তথ্য দিচ্ছে। এ কারণে তাদের আটক করা হয়েছে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে অনিয়ম করছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের আইনের আওতায় আনা হবে।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মো. ইমরান হাসান বলেন, রাজউকের বিদ্যমান ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় রেস্তোরাঁ বলে কোনো ক্যাটাগরি নেই। এজন্য বাণিজ্যিক স্থাপনায় রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। রেস্তোরাঁগুলোয় পরিবেশ ও অগ্নিনিরাপত্তা দেখার দায়িত্ব সিটি করপোরেশন ও ফায়ার সার্ভিসের। কিন্তু তারা তা করছে না। উপরন্তু মাসে মাসে পরিদর্শকদের মাসোহারা দিতে হয়। এ ধরনের সংস্কৃতি বন্ধ করে প্রকৃতপক্ষে অগ্নিনিরাপত্তার জন্য রেস্তোরাঁ কিংবা ভবন মালিকদের কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে সেটি নিশ্চিত করা।

এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান মো. আনিছুর রহমান মিঞা বলেন, বিল্ডিং কোড ২০০৬-এর আলোকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০০৮ প্রণয়ন করা হয়েছে। বিধিমালায় সরাসরি রেস্তোরাঁ ক্যাটাগরি না থাকলেও জনসমাগমস্থল বলে একটি ক্যাটাগরি রয়েছে। ওই ক্যাটাগরিতে রেস্তোরাঁর ব্যবহার অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। এটা সবাই জানেন। তবুও তারা না মানার অজুহাত দেখাতে এসব কথা বলছেন। এরপরও ২০২০ সালের বিল্ডিং কোডে রেস্তোরাঁর বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। এর আলোকে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা সংশোধনের কাজ চলমান রয়েছে। এ বিধিমালা পাশ হলে বিদ্যমান অস্পষ্টগুলো দূর হবে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া মুখপাত্র শাহজাহান সিকদার বলেন, বহুতল ভবনে হোটেল-রেস্তোরাঁর অনুমোদনের জন্য অগ্নিনিরাপত্তার বিষয়গুলো বিশেষভাবে দেখভাল করা হয়। রেস্তোরাঁর মালিকরা শুরুর দিকে নিয়মণ্ডনীতি মেনে চললেও কিছুদিন পরে তা অবহেলা করেন। সেজন্য আইন অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময়ে অভিযান পরিচালনা করছে। অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময়ে ব্যবস্থা নিয়েছে।

উল্লেখ্য, রাজধানীর বেইলি রোডে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি রাত পৌনে ১০টার দিকে গ্রিন কোজি কটেজে আগুনের ঘটনায় নারী শিশুসহ ৪৬ জন মারা যান। তাদের মধ্যে ৪৪ জনের মরদেহ হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি দুইজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে রাখা হয়েছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার এরপর গত ৩ মার্চ রাতে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার রেস্টুরেন্টগুলোতে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করে পুলিশ। তারই ধারাবাহিকতায় রাজধানীতে অননুমোদিত রেস্টুরেন্টের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় রাজউক ও ডিএসসিসি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত