ময়মনসিংহ সিটি কর্পোরেশন (মসিক) নির্বাচনে ভোটগ্রহণ কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছে। এতে নারী ভোটারদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো।
গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পযর্ন্ত নগরের ৩৩টি ওয়ার্ডের ১২৮টি ভোট কেন্দ্রে এই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়।
সকালে সরেজমিন নগরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের নিউ টাউন মডেল স্কুল কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, ভোটারদের ব্যাপক উপস্থিতি। এতে নারী ভোটারদের উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। একই অবস্থা সিটি এলাকার সবগুলো ভোট কেন্দ্রের।
নগরের ৩১ নম্বর ওয়ার্ডের চর ঈশ্বরদিয়া মধ্যপাড়া এলাকার বাসিন্দা শহিদুল্লাহ বলেন, এটা স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার কারণে ভোটার উপস্থিতি বেশি। এর মধে?্য পুরুষের চেয়ে নারীদের ভোট বেশি পড়েছে।
৩১ নম্বর ওয়াডের কাউন্সিলর প্রার্থী আসাদুজ্জামান জামাল বলেন, আমি মতো অন্য সব প্রার্থীরা ভোটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট চেয়েছে। তাই ভোটারদের উপস্থিতি বেড়েছে।
একই তথ্য নিশ্চিত করেছেন নিউটাউন মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রিজাইডিং অফিসার বিপি রায়। তিনি বলেন, এই নির্বাচনে ব্যাপক উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ভোট হয়েছে শান্তিপূর্ণ।
ইভিএমে আঙুলের ছাপ মিল না পাওয়ায় ভোট দিতে বিড়ম্বনা : ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এ আঙুলের ছাপ মিল না পাওয়ার কারণে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন (মসিক) নির্বাচনে ভোট দিতে পারছেন না অনেক বয়স্ক ভোটার। এতে পুরুষের চেয়ে ভুক্তভোগী নারীদের সংখ্যা বেশি। এনিয়ে নগরের অনেক ভোট কেন্দ্রে ব?্যাপক বিড়ম্বনার সৃষ্টি হয়েছে। দিনভর নগরের বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখা গেছে এই চিত্র।
সরেজমিন দেখা যায়, বেলা ১১টার দিকে নগরের ৩১ নং মহাখালী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে ভোট দিতে আসেন থানারঘাট এলাকার বাসিন্দা বকুলি (৬৫) নামের এক বয়স্ক নারী। কিন্তু ইভিএমে এই ভোটারের হাতের আঙুলের ছাপ না মিলার কারণে তিনি ভোট দিতে পারছেন না। বকুলি বলেন, আমি তিনবার গেছি; কিন্তু আঙুলের ছাপ মিশছে না।
একই অবস্থা থানারঘাট এলাকার মোছা: শাহিদা বেগম (৭০), ছুফিয়া বেগম (৬১) ও জমেলা খাতুন (৪৫) সহ এই কেন্দ্রের আরো অনেক নারী ভোটারের। তারাও এই সমস্যার কারণে ভোট দিতে পারছে না।
জানতে চাইলে ৩১নং মহাখালী গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার মৃনাল কান্তি রায় বলেন, কিছু নারী গৃহস্থলী কাজ করা এবং বার্ধ?্যকের কারণে তাদের আঙুলের ছাপে সমস্যা হচ্ছে। তারপরও হাত ধোয়ে বা ভ্যাসলিন ব্যবহার করে ভোট করার চেষ্টা করছি। শেষ পর্যন্ত না হলে কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের ভোটার তথ্য যাচাই করে ভোট নিশ্চিত করা হবে। তিনি আরো জানান, এই কেন্দ্রের মোট ভোটার ১৫৬০ জন। এর মধে?্য বেলা ১২টা পযর্ন্ত ২১৬ ভোট কাস্ট হয়েছে।
একই অবস্থা নগরের ১১নং ওয়ার্ডের নওমহল সরকারি প্রাথমিক বিদ?্যালয় কেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে আঙুলের ছাপ না মিলায় ভোট দিতে না পেরে অনেক ভোটারকে ফিরে যেতে দেখা গেছে।
এই কেন্দ্রের ভোটার ও মসিকের ১০, ১১ ও ১২ নং ওয়ার্ডের সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর প্রার্থী রোকসানা শিরিন এই তথ্য নিশ্চিত করে জানান, আমার বাবা-মাসহ অনেক বয়স্ক ভোটার ইভিএমে আঙুলের ছাপ না মিলার কারণে ভোট দিতে পারছে না। সেই সঙ্গে সার্ভারের সমস্যা হচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন।
নগরের ১নং ওয়ার্ডের খাগডহর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের কেন্দ্রেও একই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। সেখানেও অনেক ভোটার ভোট দিতে না পেরে বাড়িতে চলে যাচ্ছে অনেকেই।
এবিষয়ে জানতে চাইলে মসিকের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা মো: সফিকুল ইসলাম বলেন, বয়স্কদের আঙুলের রেখা মুছে যাওয়ার কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। তবে একাধিকবার চেষ্টাল পর অনেকের ভোট হয়েছে। তারপরও নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী বয়স্ক ভোটারদের ভোট নিশ্চিতের চেষ্টা করছি।
নিজ নিজ কেন্দ্রে ভোট প্রদান করে যা বললেন প্রার্থীরা : সকাল ৯টায় নগরের প্রিমিয়ার আইডিয়াল স্কুল কেন্দ্রে নিজের ভোট প্রয়োগ শেষে তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন মেয়র প্রার্থী ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: ইকরামুল হক টিটু।
তিনি বলেন, ভোটের পরিবেশ ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি সন্তোষজনক। ভোট কেন্দ্রগুলোতে ভোটার উপস্থিতিও বেশ ভালো। আমি দীর্ঘদিন মানুষের জন্য কাজ করেছি এবং প্রচারণায় মানুষের সাড়া দেখে আমি আশা করছি- এবার টেবিল ঘড়ি প্রতীক বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হবে।
এ সময় ইভিএমে ভোটগ্রহণে ধীরগতি নিয়ে টেবিল ঘড়ি প্রতীকের এই প্রার্থী বলেন, অনেক ভোটারের আঙুলের ছাপ না মেলায় তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে আসতে হচ্ছে। একজন ভোটার ২ থেকে ৩ বার যদি এই বিড়ম্বনায় পড়ে। এতে ভোটার উপস্থিতিতে প্রভাব পড়তে পারে। বিষয়টির ব্যাপারে নির্বাচন সংশ্লিষ্টরা পদক্ষেপ নিবেন বলে আশা করছি।
এদিকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঘোড়া প্রতীকের মেয়র প্রার্থী এহতেশামুল আলম বলেছেন, নির্বাচনে টাকার খেলা হচ্ছে এবং ভোটারদের নানাভাবে প্রভাবিত করা হচ্ছে। আমি চাই শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হোক। ভোটে যদি কোনো প্রভাব না পড়ে, তাহলে ঘোড়া প্রতীকের জয় সুনিশ্চিত। মানুষ পরিবর্তন চায়।
এ সময় ইভিএমএ জটিলতার করণে অনেক ভোটার ভোট দিতে না পেরে ফিরে যাচ্ছেন উল্লেখ করে এই মেয়র প্রার্থী আরো বলেন, বিশেষ করে যারা অশিক্ষিত তাদের ক্ষেত্রে সমস্যা বেশি হচ্ছে। এছাড়া ধীরগতিতে হচ্ছে ভোটগ্রহণ যার কারণে সাধারণ ভোটাররা বিরক্ত হচ্ছে। আমি আগে থেকেই ইভিএম জটিলতা হবে, সে বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে অবহিত করলেও তারা খুব একটা পদক্ষেপ নেয়নি। তারা যদি ভোটারদের কিছুটা হলেও দক্ষ করে তুলতে তাহলে আজকে এই সমস্যা হতো না।
রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ময়মনসিংহের আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন চৌধুরী জানান, শান্তিপূর্ণভাবে ভোটগ্রহণ হয়েছে। এতে নগরীর ৩৩ ওয়ার্ডের ১২৮টি ভোটকেন্দ্রের ৯৯০ বুথে দেড় হাজার ইভিএমে ভোটগ্রহণ হয়েছে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে চারজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রগুলোতে পাঁচজন পুলিশ ও ১২ জন আনসার সদস্য দায়িত্ব পালন করছেন। সেই সঙ্গে স্ট্রাইকিং ফোর্সের পাশাপাশি সাত প্লাটুন বিজিবি, ১১ প্লাটুন পুলিশ, আর্মড পুলিশ এবং আনসার সদস্য, ১৭ টিম র্যাব ছাড়াও ৩৩ জন নির্বাহী হাকিম (ম্যাজিস্ট্রেট) এবং ১১ জন বিচারিক হাকিম (জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট) দায়িত্ব পালন করছেন।
সূত্রমতে, এই নির্বাচনে পাঁচজন মেয়র প্রার্থী ছাড়াও নগরের ৩৩টি ওয়ার্ডে ১৪৯ জন সাধারণ কাউন্সিলর এবং ১১টি আসনে মোট ৬৯ জন সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে লড়াই করেছেন।
প্রসঙ্গত, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের এই দ্বিতীয় নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন পাঁচজন প্রার্থী। তারা হলেন- ঘড়ি প্রতীক নিয়ে মসিকের সদ্য সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো: ইকরামুল হক টিটু, ঘোড়া প্রতীকে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, হাতি প্রতীকে জেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য মো: সাদেকুল হক খান মিল্কি (টজু), হরিণ প্রতীকে কৃষকলীগ নেতা মো: রেজাউল করিম চৌধুরী এবং জাতীয় পার্টির মনোনীত নাঙ্গল প্রতীকে মো: শহীদুল ইসলাম (স্বপন মন্ডল)।
সূত্রমতে, এই নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যার মধ্যে ১ লাখ ৬৩ হাজার ৮৩২ পুরুষ, ১ লাখ ৭২ হাজার ৬৫৫ নারী ভোটার রয়েছে। এছাড়াও তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ৯ জন। এতে মেয়র পদে পাঁচজন প্রার্থী ছাড়াও নগরের ৩৩টি ওয়ার্ডে সাধারণ কাউন্সিলর পদে প্রার্থী ১৪৯ এবং ১১টি সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে প্রার্থী রয়েছে ৬৯ জন। তবে নগরীর ১১ নম্বর ওয়ার্ডে ফরহাদ আলম বিনা-প্রতিদ্বন্দ্বিতায় কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ায় কাউন্সিলর পদে মোট ৩২টি ওয়ার্ডে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে।