ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কোস্ট গার্ড দিবসে প্রধানমন্ত্রী

মিয়ানমার-ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি

আমরা সমুদ্রসীমার অধিকার নিশ্চিত করেছি। সেখানকার সম্পদ এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
মিয়ানমার-ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব রেখেই সমুদ্রসীমা অর্জন করেছি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বিশাল সমুদ্রের সম্পদ আহরণ করা আমাদের দায়িত্ব। এজন্য সুনীল অর্থনীতি ঘোষণা করা হয়েছে। আরো গবেষণা দরকার। আমরা সমুদ্রসীমার অধিকার নিশ্চিত করেছি। সেখানকার সম্পদ এখন দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেই সমুদ্রসীমার অধিকার অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

গতকাল সকালে রাজধানীর আগারগাঁওস্থ শেরেবাংলা নগরে কোস্ট গার্ড সদর দপ্তরে কোস্ট গার্ডের ‘২৯তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী এবং কোস্ট গার্ড দিবস ২০২৪’ উপলক্ষ্যে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব একথা বলেন। এ সময় কোস্টগার্ড সদর দপ্তরে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো ও বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের সহায়তায় বাহিনীতে সংযোজিত ভি-স্যাটনেট যোগাযোগব্যবস্থা উদ্বোধনও করেন তিনি। বীরত্ব ও সাহসিকতাপূর্ণ কাজের জন্য কোস্টগার্ডের কর্মকর্তা, নাবিক ও অসামরিক ব্যক্তিদের হাতে পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত ১৫ বছরে কোস্ট গার্ডের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে। একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডকে (বিসিজি) অতি আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি, জাহাজ ও হেলিকপ্টার দিয়ে সজ্জিত করে একটি আধুনিক ও ত্রিমাত্রিক বাহিনীতে রূপান্তরিত করছে। বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে খুব শিগগিরই এ বাহিনীতে যুক্ত হতে যাচ্ছে উন্নত প্রযুক্তির জাহাজ, মেরিটাইম সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম, হোভারক্রাফট ও দ্রুতগতিসম্পন্ন বোট। পাশাপাশি সমুদ্র নির্ভর পেশায় নিয়োজিত জনসাধারণের ও নৌপথের নিরাপত্তায় কোস্ট গার্ডের গভীর সমুদ্রে টহল উপযোগী আরো চারটি ওপিভি, দুটি মেরিটাইম ভার্সন হেলিকপ্টার সংগ্রহের অনুমোদন প্রদান করা হয়েছে।

তিনি বলেন, ভি-স্যাটনেট কমিউনিকেশন সিস্টেমের অন্তর্ভুক্তি যা কোস্ট গার্ডকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এর সাথে সংযুক্ত করবে এবং যোগাযোগ ও অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। এরই মধ্যে আমি দুটি হেলিকপ্টার উইংয়সহ এভিয়েশন উইং গঠনের নীতিগত অনুমোদন প্রদান করেছি। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডে ৪টি অফশোর প্যাট্রল ভেসেলসহ বিভিন্ন আকারের ১৬টি জাহাজ ও ১৩৮টি বোট কোস্ট গার্ড বহরে সংযোজিত হয়েছে। গভীর সমুদ্রে কোস্ট গার্ডের যোগাযোগ ব্যবস্থায় যুগান্তকারী পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ এর সাথে সংযোগ স্থাপনের জন্য আজ কোস্ট গার্ডের নতুন সংযোজিত ভিস্যাটনেট সিস্টেম ও ঢাকা জোন, পূর্ব জোন এবং দক্ষিণ জোনের বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণকাজ উদ্বোধন করা হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জন্য ৯টি প্রতিস্থাপক জাহাজ নির্মাণের লক্ষ্যে একটি নতুন প্রকল্প অনুমোদন করা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন সরকারপ্রধান।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড ১৯৯৫ সালে স্বল্প পরিসরে যাত্রা শুরু করে দীর্ঘ ২৯ বছরে আজ একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী বাহিনী হিসেবে গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ কোস্টগার্ড দেশের সমুদ্র ও উপকূলীয় অঞ্চলের মৎস্যসম্পদ রক্ষা, বনজসম্পদ রক্ষা, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, পরিবেশ রক্ষাসহ নানা কাজ করে যাচ্ছে। ১৯৯৪ সালে জাতীয় সংসদের তৎকালীন বিরোধীদল আওয়ামী লীগের আনীত বিলের কারণেই ‘বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড’ একটি আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এরপর ১৯৯৬ সালে গঠিত আওয়ামী লীগ সরকার কোস্ট গার্ডের বিভিন্ন জোনের জন্য ভূমি বরাদ্দ, অবকাঠামো নির্মাণ এবং নতুন নতুন জলযান সংযোজনের মাধ্যমে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের অগ্রযাত্রায় বিশেষ অবদান রাখে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ব্যাপক উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের উপকূলীয় এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে কোস্ট গার্ডের স্টেশন ও আউটপোস্টসমূহে কোস্টাল ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট সেন্টারসহ বিভিন্ন ধরনের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। বিভিন্ন আকারের জলযান নির্মাণ করা হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় কোস্ট গার্ডের জোনসমূহে কর্মরত সদস্যগণের বাসস্থান, ব্যারাক ও প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পটুয়াখালী অঞ্চলে নিজস্ব প্রশিক্ষণ বেইস তৈরির মাধ্যমে কোস্ট গার্ডের জনবলের প্রশিক্ষণ সক্ষমতাও বৃদ্ধি করা হয়েছে, যা পরবর্তীতে তিনি নিজেই ‘বিসিজি বেইস অগ্রযাত্রা’ নামে কমিশন করেছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের জন্য ইনশোর প্যাট্রল ভেসেল, ফ্লোটিং ক্রেন, টাগ বোট এবং বিভিন্ন ধরনের হাইস্পিড বোট তৈরি করা হয়েছে। এ বাহিনীর মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য মুন্সীগঞ্জ জেলার গজারিয়ায় একটি ডকইয়ার্ড নির্মাণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সুনীল অর্থনীতি ও সমুদ্রে নিরাপত্তা প্রদানের জন্য এ বাহিনীর আধুনিকায়নে রূপকল্প ২০৩০ ও ২০৪১ অনুযায়ী বর্তমান জনবল ধাপে ধাপে বৃদ্ধি করে ১৫ হাজার জন করার পরিকল্পনাও সরকারের রয়েছে। স্বাধীনতার পর সব প্রতিষ্ঠান গড়ে দিয়েছিলেন জাতির পিতা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালে ‘দি টেরিটেরিয়াল ওয়াটার্স অ্যান্ড মেরিটাইম জোন অ্যাক্ট’ প্রণয়ন করেন। যদিও জাতিসংঘ এই আইন প্রণয়ন করে ১৯৮২ সালে।

তবে, ’৭৫ পরবর্তী জিয়া, এরশাদ এবং খালেদা জিয়ার সরকারগুলো এই আইন বাস্তবায়নের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করেনি। ’৯৬ সালে দীর্ঘ ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ আবার এ নিয়ে কাজ শুরু করে এবং সমুদ্রে আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধুর রেখে যাওয়া পররাষ্ট রীতির পথ অনুসরণ করেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে প্রতিবেশী ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আইনি লড়াইয়ে জয়ী হয়ে বিশাল সমুদ্র এলাকায় দেশের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। স্থলভাগে সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় আমাদের দৃষ্টিও এখন দেশের সমুদ্র অঞ্চলের দিকে। সমুদ্রপথে আমাদের ৯০ শতাংশ আন্তর্জাতিক বাণিজ্য পরিচালিত হচ্ছে এবং সুনীল অর্থনীতির বিশাল ভান্ডার মজুত রয়েছে এই বঙ্গোপসাগরে। এই সম্পদের অন্বেষণ, আহরণ এবং সংরক্ষণ আমাদের দায়িত্ব।

তিনি বলেন, এই সমুদ্রসীমায় আমাদের যে বিশাল সম্পদ রয়েছে, সেই সমুদ্রসম্পদ যাতে আমাদের অর্থনীতিতে কাজে লাগে; সেজন্য ‘ব্লু ইকোনমি’ নীতি বাস্তবায়ন করছে সরকার। তাছাড়া সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটও আমরা প্রতিষ্ঠা করেছি। কারণ, গবেষণাটা একান্তভাবে দরকার। মৎস্য গবেষণায় তার সরকার জাহাজের ব্যবস্থা করেছে কিন্তু সার্বিক সমুদ্র গবেষণার জন্য জাহাজ সংগ্রহের পদক্ষেপও সরকার নিচ্ছে এবং পর্যটন শিল্পকেও গড়ে তুলছে।

তিনি বলেন, দীর্ঘ ৮০ মাইল বালুকাময় সমুদ্রসৈকত আমাদের রয়েছে, যা অন্য কারো নেই। কাজেই সেটাকে ব্যাপকভাবে কাজে লাগিয়ে পর্যটন শিল্পকে আরো উন্নত ও আকর্ষণীয় করাই তার সরকারের লক্ষ্য। বাংলাদেশের ভৌগলিক অবস্থানটা এমন যেখানে আমরা প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের একটি সেতুবন্ধন রচনা করতে পারি। সেভাবেই আমাদের দেশকে আমরা গড়ে তুলতে চাই। সে ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করাটা আমাদের একান্তভাবে দরকার। আমাদের দেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রবণ। এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষের জানমাল রক্ষা করা, গভীর সমুদ্রে যারা যান, মৎস্য আহরণে বা অন্যান্য কাজে তাদের নিরাপত্তা দেওয়া, ঘুর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যায়সহ দেশের বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রেও আমি মনে করি এই বাহিনী যথাযথ অবদান রাখতে পারবে।

সরকারপ্রধান বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী জাতি আমরা। সেই বিজয়ের পতাকা সমুন্নত রেখেই দেশকে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দারিদ্র্যের হার হ্রাসসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের বিভিন্ন কর্মসূচি সরকার বাস্তবায়ন করছে। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশে আরেকটি মানুষও ভূমিহীন-গৃহহীন থাকবে না, সকলেরই মৌলিক অধিকারগুলো নিশ্চিত করা হবে।’ ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলা করে আগামী প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করারও পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে।

শেখ হাসিনা দৃঢ় কন্ঠে বলেন, ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাবে এবং ২০৪১ সাল নাগাদ জাতির পিতার স্বপ্নের উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ তথা স্মার্ট বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলব।

অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান এবং কোস্ট গার্ড মহাপরিচালক রিয়ার অ্যাডমিরাল মীর এরশাদ আলী উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ডের একটি সুসজ্জিত চৌকষ দল প্রধানমন্ত্রীকে গার্ড অব অনার প্রদান করে এবং রাষ্ট্রীয় সালাম জানায়। নবসংযোজিত কোস্ট গার্ড ভিস্যাটনেট সিস্টেমের ওপর অনুষ্ঠানে একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শিত হয়। প্রধানমন্ত্রী পরে মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও উপভোগ করেন।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত