ইলেকট্রিক যন্ত্রের চাহিদা বাড়ছে

বৈদ্যুতিক তারের চাপ বাড়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে সচিবালয়

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়ে নিয়মিত শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত এসিসহ বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। তবে এসব যন্ত্র চালানোর জন্য সচিবালয়ের ভেতরে বৈদ্যুতিক তারের ওপর মাত্রাতিরিক্ত চাপ বাড়ছে। এরপরও বৈদ্যুতিক তার পরিবর্তনের কোনো নজর নেই সংশ্লিষ্ট সংস্থার। বরং দীর্ঘ ২০ থেকে ২৫ বছর আগের বৈদ্যুতিক তারের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে আছে। এতে সচিবালয়ে অবস্থিত বহুতল ভবনগুলো অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকিতে রয়েছে। গরমের মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় সরবরাহে ত্রুটিও দেখা যায়।

জানা গেছে, গরমের মৌসুমে সচিবালয়ে দৈনিক বিদ্যুতের চাহিদা প্রায় ৭ মেগাওয়াট। সচিবালয়ে ভবনগুলোতে ছোট ছোট মোট ২৮০০ এসি ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া অর্থ ভবনেই সেন্টাল এসি ১২০০ টনের। এরসঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসার স্থান সংকুলান নিরসনে ২০ তলা ভবনেও প্রায় ২ হাজার ৪০০ টন এসি স্থাপন করা হবে।

সরেজমিন সচিবালয়ে কয়েকদিন ঘুরে দেখা গেছে, সরকারের প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড চালাতে সচিবালয়ে মোট ১২টি ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যার ৮টি স্বাধীনতার আগে নির্মাণ করা হয়েছে। নতুন করে অর্থ ভবন ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ২০ তলা ভবন করা হয়েছে। এছাড়াও দুটি টিনশেড একতলা ভবনেও সচিবালয়ের অভ্যন্তরের বিভিন্ন দপ্তরের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। গরমের প্রকোপে এসব ভবনে বছরে বছরে এসির ব্যবহার বেড়েছে। এসি, কম্পিউটারের পাশাপাশি ফ্যান, চায়ের কেতলিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। আর এসব বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশ নিয়ন্ত্রণ করছে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ইডেনের ই/এম বিভাগ।

সূত্রে জানা গেছে, এতদিন মন্ত্রী-সচিবের সঙ্গে অতিরিক্ত সচিব এবং যুগ্ম-সচিবরা তাদের কক্ষে এসি ও কম্পিউটার পেলেও নতুন প্রাধিকারের তালিকায় উপসচিব, প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কক্ষে এসি ও কম্পিউটার ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও অন্যান্য কর্মচারীর দাপ্তরিক কার্যালয়ও শীতাতাপ নিয়ন্ত্রণের আওতায় আনা এবং তাদের কক্ষে একটি করে বৈদ্যুতিক কেটলি ব্যবহারের প্রাধিকার নির্ধারণ করে দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

সচিবালয়ে অনেক মন্ত্রণালয় নিজেদের মতো করে তাদের আওতাধীন ফ্লোরগুলোর ইন্টেরিয়র ডিজাইন করেছেন। এসব করতে গিয়ে তারা নিজেদের মতো করে বৈদ্যুতিক তার সংযোজন করেছেন। গণপূর্তের সঙ্গে আলাপ না করে এসব তার সংযোজন করায় সেগুলোও মাঝেমধ্যে ঝামেলার সৃষ্টি করছে। পূর্ব-পশ্চিম আরএমইউ থেকে ১১ হাজার ভোল্টের বৈদ্যুতিক মূল লাইন সচিবালয়ে টানা হলেও অনেক আগেই তাতে বেশি লোড পড়েছে। দিন দিন এই লোড বাড়ছে। প্রচণ্ড গরমে এসি ব্যবহারে কর্মস্থলে দুর্ঘটনার বড় কারণগুলোর মধ্যে ইলেকট্রিসিটি এবং আগুন অন্যতম। সেজন্য বিদ্যুতের বিপজ্জনক দিক সম্পর্কে যথেষ্ঠ সতর্কতা থাকা দরকার। প্রতিটি বৈদ্যুতিক লাইন সুইচ, সার্কিট ব্রেকার, ফ্যান, কাটআউট, বিদ্যুৎচালিত যন্ত্রপাতি পরীক্ষা করতে হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, স্বাধীনতার পর প্রশাসনে মন্ত্রণালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় চাহিদা মেটাতে ১৯৯১ সালে একটি ২১তলা বিশিষ্ট বহুতল ভবন নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড বহুলাংশে বেড়েছে এবং সরকারি যন্ত্রের সেবামুখী প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতিদিন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, বিভিন্ন পর্যায়ের জনপ্রতিনিধি, বিদেশি প্রতিনিধি, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী-উদ্যোক্তাসহ সাধারণ জনগণ তাদের নিজ নিজ প্রয়োজনে বাংলাদেশ সচিবালয়ে আসছেন। এসব কারণে সচিবালয়ে বৈদ্যুতিক যন্ত্রাংশের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রের জন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুতের প্রয়োজন হচ্ছে। পুরো সচিবালয়ে প্রায় ৪ হাজার টনের এসি ব্যবহার হচ্ছে।

নির্ভরশীল সূত্রে জানা যায়, সচিবালয়ে ২০ থেকে ২৫ বছর ধরে বৈদ্যুতিক তার লাগানো হয়েছে। এসব তার পরিবর্তন করা দরকার। ইলেক্ট্রনিক যন্ত্রাংশের ব্যবহার বাড়ায় তারে ঝুঁকি বাড়ছে। কারণ দিনে দিনে এসি, ওয়াটার হিটার, চায়ের কেটলিসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক যন্ত্র ব্যবহার হচ্ছে। সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ ও ঝুঁকি এড়াতে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি অধিক সংখ্যক চলছে। চাহিদা বৃদ্ধিতে ভবনগুলোর বৈদ্যুতিক তার পরিবর্তন করা দরকার। তা-না হলে যে কোনো মুহূর্তে বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

বাংলাদেশ সচিবালয়ে মন্ত্রী-সচিবরা নিয়মিত অফিস করেন। বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় ছোটোখাটো অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে সচিবালয়ে। যে কোনো সময় বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কয়েকবার বিদ্যুতের সংযোগ থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে। অথচ এখনও সচিবালয়ের ভবনগুলোর বিদ্যুতের অনেক লাইন অগোছালো। বোর্ড ও বক্স দিয়ে লাইনগুলো ঢেকে রাখা হলেও ভেতরে রয়েছে পুরোনো তার। তাই শর্টসার্কিটের কারণে আগুন লাগার শঙ্কা রয়ে গেছে।

জানা গেছে, সচিবালয়ের ভেতরে প্রত্যেকটি বহুতল ভবনের দেয়ালে টাঙানো অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র ফায়ার এক্সটিংগুইশারের সিলিন্ডার। আর এসব ফায়ার এক্সটিংগুইশারের সিলিন্ডার ব্যবহারেও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দক্ষ নয়। অতীতে আগুন নেভানোর কাজে এসব সিলিন্ডার ব্যবহার করা হয়েছিল কি না, তাও সচিবালয়ে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী বলতে পারেননি।

এ প্রসঙ্গে সচিবালয়ের অভ্যন্তরে গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। তবে বাংলাদেশ সচিবালয় আগের চেয়ে নিরাপদ। অতীতে বেশ কয়েকবার আগুন লাগলেও বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেনি। তবে বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ায়, পুরোনো ক্যাবলে যে কোনো সময় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে। তবে সচিবালয়ের প্রতিটি ভবনে পানির লাইন রয়েছে। লাইনে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহ করা হয়। এছাড়া সচিবালয়ের খুব কাছেই ফায়ার সার্ভিসের সদর দপ্তর। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে দ্রুতই ফায়ার সার্ভিসের দক্ষ কর্মীরা এখানে চলে আসবেন। তাই এ নিয়ে চিন্তার কোনো কারণ নেই।

এ বিষয়ে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসির) ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবদুল্লাহ নোমান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘সচিবালয় আমাদের কাছে বিশেষায়িত এলাকা। আমরা এটিকে প্রাধান্য দেই। সচিবালয়ে বিদ্যুতের চাহিদা ও ডিপিডিসির বিদ্যুৎ সরবরাহের মধ্যে খুব একটা তারতম্য নেই’।

সচিবালয়ে বিদ্যুতের তার ব্যবহারের সম্পর্কে তিনি বলেন, ডিপিডিসি মেইন ডিস্টিবিউশন পয়েন্ট পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ করে থাকে। আর সচিবালয়ের ভেতরের বিষয়টি গণপূর্ত অধিদপ্তর দেখে। গণপূর্তকে বলা আছে- তারা যখন সচিবালয়ে এসির সংখ্যা ও বিদ্যুতের লোড বাড়াবে তখন যেন তারের ক্যাপাসিটি অনুযায়ী করেন। এ ব্যাপারে ডিপিডিসির সংশ্লিষ্টরা গণপূর্তের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছেন।

সচিবালয়ের ভেতের ২০ থেকে ২৫ বছর আগের তার দিয়েই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে গণপূর্তের সংশ্লিষ্ট সূত্রের এমন তথ্যের বিষয়ে আবদুল্লাহ নোমান বলেন, ‘তাহলে গণপূর্তের দায়িত্ব নিয়েই এ বিষয়গুলো সমাধান করা উচিত। যেহেতেু সচিবালয়ের ভেতরে ওয়ারিং গণপূর্তই দেখে’।

বিদ্যুৎ আইন অনুযায়ী কোনো স্থাপনায় ৫ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হলে সেখানে ৩৩/১১ কেভি (কিলো-ভোল্টেজ) উপকেন্দ্র স্থাপন করতে হবে। কিন্তু সচিবালয়ে গরমের মৌসুমে দৈনিক প্রায় ৭ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলেও এখানে ব্যবহার করা হচ্ছে ১১.৪ কেভি সাবস্টেশন। এ বিষয়ে ডিপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বলেন, ‘সচিবালয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিতে গুলিস্তান জিপিও মোড়ের উল্টোপাশে সচিবালয় সংলগ্ন জায়গায় প্রকল্পের আওতায় সাবস্টেশন স্থাপনের কাজ চলছে। এরইমধ্যে সাবস্টেশনের অবকাঠামোর কাজ শেষপর্যায়ে’।

সচিবালয়ে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, ‘অধিকাংশ অগ্নিকাণ্ডের পেছনে ইলেকট্রিক ওয়ারিংয়ের ইস্যুটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তারের সক্ষমতার চেয়ে ইলেকট্রিক লোড বাড়লেই অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ে। সেখানে সচিবালয়ে বিদ্যুতের চাহিদার সঙ্গে তারের সক্ষমতা না বাড়ানো হলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে’।

তিনি আরও বলেন, ‘দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা সচিবালয়ে কাজ করছেন। সেখানে ইলেকট্রিক ত্রুটি নিরসনে দায়িত্বশীল সংস্থাকে নজর দিতে হবে’।

সচিবালয়ে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী কোম্পানি ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদ্যুৎ সরবরাহে পুরোনো তার পরিবর্তন করতে হবে। ত্রুটিপূর্ণ তারে যে কোনো সময় ভয়াবহ বিদ্যুৎ বিপর্যয় হতে পারে।