উন্নত চিন্তা ও পরিকল্পনার গুরুত্ব

ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

প্রকাশ : ১৩ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাকের আহ্বানে সাত আসমান পাড়ি দিয়ে ঊর্ধ্বলোকে গিয়েছিলেন। ইসলামের ইতিহাসে ঘটনাটি মেরাজুন্নবী হিসেবে প্রসিদ্ধ। নবীজি আল্লাহর সান্নিধ্যে উপনীত হয়ে কিছু বিষয় নিবেদন করেন, জবাবে আল্লাহ পাক নবীজির সঙ্গে কথা বলেন। সেই কথাসমষ্টি আত্তাহিয়াত নামে পরিচিত। মহান আল্লাহ পাক ও নবীজির মধ্যকার সেই সংলাপ ‘আত্তাহিয়্যাতু’ আকারে আমরা নামাজে প্রতি দুই রাকাত শেষে বৈঠকে পাঠ করি।

মেরাজে গিয়ে মুসলিম উম্মাহর জন্য নবীজির পাওয়া চারটি প্রধান বিষয়ের একটি এই আত্তাহিয়্যাত। সবচে গুরুত্বপূর্ণ উপহার ছিল দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। নামাজ আগেও ফরজ ছিল, তবে পাঁচ ওয়াক্ত ফরজ হয় মেরাজের রাতে। নামাজ মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে উপহার- এ কথার তাৎপর্য কী। নামাজে পাঠ্য তকবির, তসবিহ, আয়াত ও সুরার ভাবার্থ নিয়ে চিন্তা করলে তার জবাব পাওয়া যাবে। মূলত নামাজ মানে দৈনিক পাঁচবার বান্দা আল্লাহর সামনে হাজির হওয়া। মনের আলাপনে, মুখের উচ্চারণে ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আন্দোলনে আল্লাহর সাথে কথা বলা ও নিজেকে আল্লাহর কাছে সম্পূর্ণ সমর্পণ করা। এজন্য নামাজের আরেক নাম ‘মুমিনের মেরাজ’। হাদিস শরিফে আছে নামাজরত ব্যক্তি আল্লাহর সাথে কথা বলে। বান্দার উচিত নামাজে আল্লাহর সাথে কী বলছে, তা জেনে বুঝে বলা।

মেরাজের রাতে মানবজাতির জন্য প্রদত্ত আরেকটি উপহার সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত। হাদিস শরিফের ভাষ্য অনুযায়ী এই দুই আয়াত হলো- বেহেশতের কোষাগারের চাবি। প্রশ্ন জাগতে পারে, চাবি তো হয় ইস্পাত বা তামার তৈরি। কোরআনের দুটি আয়াত চাবি হবে কীভাবে। এখন দেখা যাচ্ছে, সবকিছু খোলার জন্য তামা-লোহার চাবির দরকার হয় না। ইলেক্ট্রনিক জিনিস খোলার জন্য বর্তমানে পাসওয়ার্ডের ব্যবহার যত্রতত্র। তার মানে কয়েকটি সংখ্যা টিপলেই লক খুলে যায়। এর চেয়েও উন্নত হলো, দুয়েকটি অক্ষর বা শব্দ উচ্চারণ করলেই উন্নত ডিভাইসের দরজা খুলে যায়। এই অভিজ্ঞতা সামনে রাখলে বুঝা সহজ হবে সূরা বাকারার শেষ দুই আয়াত জান্নাতের কোষাগারের চাবি হওয়ার রহস্য। মাহে রমজানে নামাজ, আত্তাহিয়্যাত ও কোরআন তেলাওয়াতের চর্চা হয় অহরহ। কাজেই বারবার পাঠ্য বিষয়গুলোর অর্থ বুঝার চেষ্টা করলে, এর অন্তর্নিহিত রহস্য কিছুটা বুঝতে পারলে আমরা ইবাদতের স্বাদ অনুভব করতে পারব।

বান্দার জন্য মেরাজের আরেকটি উপহার আল্লাহর পক্ষ হতে একটি ঘোষণা। এ যেন রাষ্ট্রীয় ফরমান, প্রজ্ঞাপন। তা হলো আল্লাহর কোনো বান্দা যদি কোনো একটি ভালো কাজ করার সংকল্প করে, তার জন্য একটি সওয়াব লিপিবদ্ধ করা হবে। আর যদি বান্দা কাজটি বাস্তবায়ন করে বিনিময়ে তাকে কমপক্ষে দশটি সওয়াব দান করা হবে। আর যদি কেউ কোনো মন্দ কাজ করার মনস্থ করে তাহলে কাজটি না করা পর্যন্ত বান্দার নামে কোনো গোনাহ বা পাপ লেখা হবে না, যদি সে কাজটি করে বসে তাহলে এর পরিবর্তে তার জন্য একটিমাত্র গোনাহ বা পাপ লেখা হবে। তার মানে সৎ কাজের সংকল্প করলেই একটি সওয়াব, কাজটি করলে কমপক্ষে ১০ গুণ। মন্দ কাজের বেলায় ফেরেশতারা অপেক্ষায় থাকে মন্দ কাজ থেকে বান্দা বিরত হয় কি না। যদি করে ফেলে একটিমাত্র গোনাহ লেখা হয়।

বুখারি ও মুসিলম শরিফে বর্ণিত হাদিসে হজরত ইবনে আব্বাস রা. বলেন, নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সরাসরি আল্লাহর পক্ষ হতে যে হাদিস বর্ণনা করেছেন অর্থাৎ হাদিসে কুদসিতে বলেন, আল্লাহ তাআলা হাসানাত (নেক কাজ) ও সাইয়্যেআত (গোনাহের কাজ) কী কী তা সাব্যস্ত করেন। এরপর এই বিধান বর্ণনা করেন যে, যে ব্যক্তি কোনো সৎকাজের সংকল্প করবে, তা বাস্তবে কার্যকরি করার আগেই আল্লাহ পাক তার জন্য একটি পরিপূর্ণ নেকি বা সওয়াব লিপিবদ্ধ করবেন। আর যে কাজটির সংকল্প করবে এবং তা বাস্তবায়ন করবে বিনিময়ে আল্লাহ তাআলা নিজের কাছে সেই বান্দার জন্য ১০টি থেকে ৭০০ গুণ বা তার চেয়েও বেশিগুণ সওয়াব বরাদ্দ করে রাখবেন। আর যদি কেই কোনো মন্দ কাজ করার মনস্থ করে, পরে সে কাজ সম্পাদন না করে বিনিময়ে আল্লাহ তাকে একটি নেকি দান করবেন। আর যদি কাজটি করে বসে তার বিনিময়ে আল্লাহ সেই বান্দার নামে একটি মাত্র গোনাহ লিপিবদ্ধ করবেন।’ (মুসলিম শরিফ)

একবার একটি টেবলয়েড পত্রিকায় পড়েছিলাম, অনুন্নত মালয়েশিয়াকে মহাথির মুহাম্মদ যে কারিশমা দিয়ে উন্নত বিশ্বের কাতারে শামিল করেন, তার একটি ছিল ক্ষমতায় আসার পরপর তিনি তার দেশের যুব সমাজের প্রতি প্রতিদিন ডায়েরি লেখার আহ্বান জানান। প্রত্যেকে নিজের ভালো ভালো চিন্তা ও পরিকল্পনাগুলো ডায়রিতে লিখে রাখবে। লিখতে হলে তো ভালো কিছু চিন্তা করতে হবে। তারপর লিখবে। ফল দাঁড়াল দেশব্যাপী যুব সমাজের মধ্যে ভালো ভালো চিন্তা ও দেশ গড়ার পরিকল্পনার জোয়ার সৃষ্টি হলো। এটিই ছিল মালয়েশিয়ার উন্নত দেশের সারিতে শামিল হওয়ার মূলমন্ত্র। এই দৃষ্টান্তটি সামনে রাখলে আমারা সহজে বুঝতে পারব, মেরাজের চতুর্থ উপহার ও হাদিসের বর্ণনাটির সুফল কত সুদূর প্রসারি হতে পারে। পবিত্র রমজান মাসে যে কোনো সৎকর্মের সওয়াব কমপক্ষে ৭০ গুণ। সেই হিসেবে আমরা কি ভালো ভালো চিন্তা করে অনেক বড় বড় সওয়াবের ভাগি হতে পারি না। হ্যাঁ, অবশ্যই পারি। আমরা নিজের জীবনের জন্য স্বল্প মেয়াদি ও দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারি। স্বল্প মেয়াদি পরিকল্পনা হবে রমজানে কী কী সৎকাজ করব তা নিয়ে। যেমন আমরা জাগ্রত চেতনায় রোজার হক আদায় করে রোজা রাখব, সওয়াবের নিয়তে সাহরি খাব, ইফতার করব, তারাবি হতে কোরআন খতম শোনব, এত এত দান সাদকা করব, গরিব অসহায় মানুষকে সাহায্য করব, এক খতম কুরআন তেলাওয়াত করব, বারংবার পাঠ্য সুরা, দোয়া ও মোনাজাতগুলোর অনুবাদ শিখব, শবেকদর তালাশ করব, দেশ ও জনগণের উন্নয়ন এবং মুসলিম উম্মাহর জন্য অমুক অমুক কাজটি করব। তাতে সংকল্প বা নিয়ত করার সাথে সাথে একটি করে সওয়াব বরাদ্দ হয়ে যাবে। ভবিষ্যৎ জীবনের জন্য স্বপ্ন দেখা ও পরিকল্পনা গ্রহণের এই কাজটি আমরা রমজানের শুরুতে এখনই করতে পারি। এই চিন্তা, স্বপ্ন দেখা ও পরিকল্পনা আমাদের এগিয়ে নেবে, আমাদের জীবন বদলে যাবে।