জলদস্যুর কবলে বাংলাদেশি জাহাজ

নাবিকদের উদ্ধারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার

প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

বাংলাদেশি কয়লাবাহী জাহাজ (বাল্কশিপ) ভারত মহাসাগরে জিম্মি করেছে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এমভি আবদুল্লাহ জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাত ৮টায় পর্যন্ত জাহাজটি সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ১৭০ মাইল দূরে রয়েছে। জোয়ারের কারণে জাহাজ চলাচলে গতি বাড়ায় আজ সকালে এটি সোমালিয়া উপকূলে পৌঁছানোর সম্ভবনা রয়েছে। এর আগেও জাহান মনি নামের বাংলাদেশি জাহাজ দস্যুরা জিম্মি করেছিল। দীর্ঘ চেষ্টার পর জলদস্যুদের কবল থেকে জাহান মনি ও নাবিকদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এবারও একইভাবে চেষ্টা অব্যাহত রাখা হয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।

জলদস্যুদের হাত থেকে জাহাজ ও ২৩ নাবিক উদ্ধারের বিষয়ে গতকাল বুধবার সচিবালয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেছেন, ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশি জাহাজের নাবিকদের সুস্থ ও নিরাপদভাবে ফেরত আনার বিষয়ে সরকার বদ্ধপরিকর। প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখন পর্যন্ত পাওয়া খবর অনুযায়ী নাবিকরা সুস্থ এবং ভালো আছেন। অপহরণ হওয়া জাহাজ উদ্ধারে আমাদের কথা হচ্ছে যে কোনো মূল্যে আমাদের নাবিকদের বাংলাদেশে ফেরত আনতে আমরা বদ্ধপরিকর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিয়েছেন। অন্যান্য জায়গাগুলোতে তিনি কথা বলেছেন। নাবিকদের নিরাপদে বাংলাদেশে ফেরত আনার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। জানা গেছে, ভারত মহাসাগরে জলদস্যুর কবলে পড়েছে জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। জাহাজটি কয়লা নিয়ে আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে যাচ্ছিল। এ সময় জাহাজটিতে ২৩ জন ক্রু ছিলেন। গত মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে ১০ থেকে ১৫ জনের একটি দস্যু দল এমভি আবদুল্লাহ নামের জাহাজটিতে উঠে ক্যাপ্টেনকে জিম্মি করে। এরপর জাহাজটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যায়। শামসুদ্দিন নামে এক নাবিক উদ্বেগ নিয়ে একটি ভয়েস রেকর্ডে বলেন, ‘মুক্তিপণের জন্যই দস্যুরা আমাদের জিম্মি করেছে। মুক্তিপণ না পেলে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে পারে। এমনকি আমাদের হত্যাও করতে পারে।’ ওই নাবিক তাদের উদ্ধারের জন্য বাংলাদেশ সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আকুতি জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা সাতটার দিকে জাহাজটির সব নাবিকের কাছ থেকে মোবাইল ফোন নেয় জলদুস্যরা।

এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের দ্বিতীয় প্রকৌশলী মো. তৌফিকুল ইসলামের মা দিল আফরোজা বলেন, ছেলেকে জিম্মি করার কথা শোনার পর তাকে কয়েকটি দোয়া পড়ার কথা বলি। তখন সে আমাদের সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। কথা বলার একপর্যায়ে জলদস্যুরা তার ফোন কেড়ে নেয়। এরপর থেকে তার সঙ্গে আর কথা বলতে পারিনি। ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকলে অন্তত স্বস্তি পেতাম। নৌপরিবহণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কমোডর মোহাম্মদ মাকসুদ আলম বলেন, সোমালিয়ার জলদস্যুরা জাহাজটি কোথায় রেখেছে এবং নাবিকদের অবস্থা সম্পর্কে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। জাহাজের নাবিকরা নিরাপদে আছেন। তাদের উদ্ধারে আন্তর্জাতিক যে প্রক্রিয়া ও কৌশল রয়েছে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, গত ৪ মার্চ এমভি আবদুল্লাহ মোজাম্বিকের মাফুতো বন্দর থেকে ৫৮ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আমিরাতের (শারজাহ) বন্দরে যাচ্ছিল। সেখানে কয়লা আনলোড করার কথা। কিন্তু পথে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়ে জাহাজটি। প্রথমে একটি ছোট বোট থেকে তিনজন জলদস্যু রাইফেল টাইপের ভারী অস্ত্র নিয়ে জাহাজের হুড বেয়ে উঠে পড়ে। তারা প্রথমেই জাহাজের ক্যাপ্টেনকে জিম্মি করে। বন্ধ করে দেয় জাহাজ চলা। এরপর জাহাজের সব নাবিককে তাদের সামনে আসতে বলে। নাবিকরা সামনে আসার পর আরেকটি ছোট বোট দ্রুত জাহাজের দিকে এগিয়ে আসে। ওই বোট থেকে নেমে ১০ থেকে ১৫ জন অস্ত্রধারী জলদস্যু কয়লাবাহী জাহাজে উঠে পড়ে। এ সময় তারা সবার কাছে থাকা ডলারসহ যার কাছে যা আছে তা বের করে দিতে বলে। এক গ্রুপ নাবিকদের এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকতে বলে। আরেক গ্রুপ জাহাজে যার যার অবস্থানে চলে যেতে বলে। নিজেদের স্থানে যাওয়ার পর নাবিকরা ওয়াইফাই ও মোবাইল ব্যবহার করে মালিকপক্ষ ও স্বজনদের সঙ্গে ফোনে বা ভয়েস রেকর্ডে যোগাযোগ করেন। এদেরই একজন নাবিক আনোয়ারার মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। তিনি জাহাজের অয়েলার হিসাবে কর্মরত। স্বজনদের কাছে পাঠানোর তার একটি ভয়েস রেকর্ড তিনি বলেন, ‘আমাদের জাহাজ মোজাম্বিকের মাফুতো বন্দর থেকে কয়লা লোড করে ৪ মার্চ ছাড়ে। শারহাজাহ হামারিয়া পোর্টে কয়লা আনলোড করার কথা। পথে সোমালিয়া রুটে জলদস্যুরা আমাদের জাহাজে অ্যাটাক করে। জলদস্যুপ্রবণ এলাকা এড়িয়ে জাহাজটি চলার কথা ছিল। এরপরও জলদস্যুর কবলে পড়েছে আমাদের জাহাজ।

জিম্মি করার পর নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হয় জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে। চট্টগ্রামভিত্তিক কেএসআরএম গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ মূলত বাল্ক ক্যারিয়ার (খোলা পণ্যবাহী)। এটি নৌপথে পণ্য পরিবহণ করে। এসআর শিপিংয়ের সিইও মোহাম্মদ মেহেরুল করিম বলেন, গত মঙ্গলবার দুপুর সোয়া একটার দিকে জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। ওই সময় জলদস্যুরা জাহাজে উঠছিল। এরপর থেকে আর নাবিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। কোনো খবরও পাইনি। ধারণা করছি, জলদস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। এখন জলদস্যুরা যোগাযোগ না করা পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

জাহাজটিতে থাকা নাবিকরা হলেন- মোহাম্মদ আবদুর রশিদ (মাস্টার), মোহাম্মদ আতিক উল্লাহ খান (চিফ অফিসার), মোজাহেরুল ইসলাম চৌধুরী (সেকেন্ড অফিসার), মোহাম্মদ তারেকুল ইসলাম (থার্ড অফিসার), হোসাইন মোহাম্মদ শাহরিয়ার (ডেক ক্যাডেট), এএসএম সাঈদুজ্জামান (চিফ ইঞ্জিনিয়ার), মোহাম্মদ তৌফিকুল ইসলাম (সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার), মোহাম্মদ রোকন উদ্দিন (থার্ড ইঞ্জিনিয়ার), আহমেদ তানভির (ফোর্থ ইঞ্জিনিয়ার), আইয়ুব খান (ইঞ্জিন ক্যাডেট), ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (ইলেকট্রিশিয়ান), মোহাম্মদ আনোয়ারুল হক, (এবি), মাহমুদ জয় (ওএস), মো. নাজমুল হক (ওএস), আইনুল হক (অয়েলার), মোহাম্মদ শামসুদ্দিন (অয়েলার), আলী হোসাইন (অয়েলার), মোশাররফ হোসাইন শাকি (ফায়ারম্যান), মো. শফিকুল ইসলাম (চিফ কুক), মোহাম্মদ নুর উদ্দিন (জিএস), সালেহ আহমেদ।

জাহাজের অবস্থা সম্পর্কে কেএসআরএম’র মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম বলেন, একটি গোপন ডিভাইসের মাধ্যমে আমরা গভীর রাতে একজন জিম্মি নাবিকের সাথে কথা বলেছি। তারা সবাই সুস্থ আছে। এখনো কোনো ধরনের মুক্তিপণ দাবি করেনি। জিম্মি অবস্থায় জাহাজটি ভারত মহাসাগরের সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যায়। মুক্তিপণের জন্য জলদস্যুরা এখনো কোনো প্রস্তাব দেয়নি। আমরা বিভিন্নভাবে তাদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। মিজানুল ইসলাম আরো বলেন, সাধারণ দস্যুদের একটি ক্যারেক্টার থাকে। তারা জাহাজ ও নাবিকদের আটকের পরই কোনো ডিমান্ড করে না। তারা আসলে একটা সেইফ জোন খুঁজে। সেইফ জোন তৈরি করার পর তারা ডিমান্ড করবে। দেন-দরবার করবে। এখনো হয়তো সেইফ জোনে জলদস্যুরা পৌঁছাতে পারেনি। সেজন্য বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারেনি। বাংলাদেশ নৌপরিবহন অধিদপ্তর বলেছে, গত মঙ্গলবার জাহাজটি যখন জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নেয়, তখন জাহাজটি সোমালিয়া উপকূল থেকে প্রায় ৫৭০ মাইল দূরত্বে ছিল। বর্তমানে জাহাজের অবস্থান রয়েছে সোমালিয়ার রাজধানী মোগাদিসু থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইলের কাছাকাছি দূরত্বে। এটি আস্তে আস্তে সোমালিয়া উপকূলের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বলেও দেখা যাচ্ছে ট্র্যাকিং ম্যাপে। জাহাজটি খুব ধীরে ধীরে চলছে। জলদস্যুদের গতিবিধি একেক সময় একেক রকম। উল্লেখ্য, এর আগেও ২০১০ সালে ৫ ডিসেম্বর একই কোম্পানির জাহাজ জাহান মনি পড়েছিল সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে। ওই জাহাজটি নিকেলভর্তি, ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রী ছিলেন। দীর্ঘ চেষ্টার পর ১০০ দিনের মাথায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা। পরে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।