ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

প্রতিবেশীর প্রতি যত্নবান হোন

প্রতিবেশীর প্রতি যত্নবান হোন

আমরা বিভিন্ন স্তরে পরীক্ষা দিয়ে শিক্ষিত বলে পরিচয় সংগ্রহ করেছি। আমাদের ছেলে-মেয়েদেরও নানা বিষয়ে পড়াশোনা, প্রস্তুতি ও পরীক্ষা দিয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সংগ্রাম করতে হচ্ছে। ধর্মীয় জীবনও এর ব্যতিক্রম নয়। নিজেকে মু’মিন হিসেবে প্রমাণ করার জন্য আমাদের অনেক কিছুর প্রস্তুতি, অনুশীলন ও পরীক্ষার প্রয়োজন। এই অনুশীলনের একটি দীর্ঘ মৌসুম পবিত্র রমজান মাস। একে মাসব্যাপী পরীক্ষা বললেও যথার্থ হবে।

সালমান ফারসি (র.) বর্ণিত হাদীসে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমজান মাসের পরিচয় দিয়ে বলেছেন, এটি ‘মুয়াসাত’ এর মাস। মুয়াসাত মানে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সহযোগিতা। পরিভাষাটি সুন্দর এবং এ সম্পর্কে বেশ সুন্দর সুন্দর কথা বলা যায়। কিন্তু নবীজি শুধু মুখের কথা বা উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত হননি। তিনি সেই উপদেশকে বাস্তবে অনুশীলন ও বাস্তবায়ন করে দেখিয়েছেন। আমাদেরও তার নির্দেশনা দিয়েছেন। গরিব অসহায় অভুক্ত মানুষের জন্য দরদ উজাড় করে মঞ্চ কাঁপিয়ে বক্তৃতা করা সহজ। শুধু কথায় বক্তৃতায় নয়, সারা দিন অর্ধাহারে অনাহারে যাদের দিন যায় রাত কাটে, তাদের যাতনা অনুভব করার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছে ইসলাম।

রমজানে প্রত্যেক রোজাদার উপবাস থেকে ভূখা-নাঙ্গা মানুষের মর্মযাতনা অনুভব করার সুযোগ পায়। মনের চেতনায় অভাবগ্রস্ত অসহায় মানুষ, বিশেষ করে চারপাশের মানুষের সাথে নামাজে ইফতারে মেলামেশা ও তাদের সাহায্যে এগিয়ে যাওয়ার তাগাদা অনুভব করে। নবী করিম (সা.) এর এই ঘোষণার মর্মার্থ কত গভীর ও তাৎপর্যপূর্ণ একবার চিন্তা করে দেখুন।

‘সে ব্যক্তি মু’মিন নয় যে পেট পুরে খায় আর তার পাশেই তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ -(মিশকাত, হাদীস-৪৯৯১; আদাবুল মুফরাদ হাদিস-১১২)

অসহায় গরিব প্রতিবেশী বন্ধুজনের প্রতি সদ্ব্যবহারের এই নির্দেশ কেবল হাদিস শরিফ সূত্রে দেয়া হয়নি, কোরআন মজীদেও এর কঠোর তাগাদা রয়েছে বিভিন্ন স্থানে।

আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন-‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত করবে ও কোনো কিছুকে তার শরিক করবে না; এবং পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, অভাবগ্রস্ত, নিকট প্রতিবেশী, দূর প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফির ও তোমাদের অধিকারভুক্ত দাস-দাসিদের প্রতি সদ্ব্যবহার করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না, দাম্ভিক অহঙ্কারিকে।’

-(সূরা নিসা, আয়াত-৩৬)

বর্ণ, ধর্ম আত্মীয়, অনাত্মীয়, ভালো, মন্দ নির্বিশেষে সব ধরনের প্রতিবেশীই কোরআন মজীদের এই শিক্ষার আওতাধীন। তার মানে আল্লাহ ও রাসুলের হুকুম অনুযায়ী সব প্রতিবেশীই আমার আপনার সদাচরণ পাওয়ার হকদার। প্রতিবেশীর এই হক ও অধিকার এতই শক্তিশালী যে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘জিব্রাঈল এসে আমাকে প্রতিবেশীর ব্যাপারে অবিরাম তাগাদা দিতে থাকেন, তাতে আমার মনে হতো হয়তো প্রত্যেকের প্রতিবেশী তার সম্পদের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা দেয়া হবে।’

-(বুখারি ও মুসলিম সূত্রে মিশকাত-৪৯৪৬)

প্রতিবেশীর অধিকারের ব্যাপারে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে তাগাদা দিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহ পরকালের প্রতি ঈমান রাখে সে যেন তার প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে।’

-(ইবনু মাজা -হাদিস-৩৬৭২; আদাবুল মুফরাদ হাদিস-১০২)

তিনি আরো বলেছেন, ‘তুমি তোমার প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণ কর, তাহলে তুমি মু’মিন হতে পারবে।’ -(তিরমিযী হাদিস-২৪৭৫; মিশকাত হাদিস-৫১৭১)

রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর কসম সে ব্যক্তি মু’মিন নয়, আল্লাহর কসম সে মু’মিন নয়। আল্লাহর কসম সে মু’মিন নয়। জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসুলাল্লাহ! কে সেই ব্যক্তি (যে মু’মিন নয় বলে আপনি কসম খেয়ে বলছেন?) নবীজি বললেন, যার অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ থাকে না।’ -(বুখারী, মুসলিমের বরাতে মিশকাত হাদিস-৪৯৬২)

প্রতিবেশীর সঙ্গে সদাচরণের সওয়াব নফল ইবাদত বন্দেগির সওয়াবকেও ছাড়িয়ে যায়। এ মর্মে একটি দৃষ্টান্তের কথা বর্ণিত হয়েছে হাদিসে রাসুলে পাকের জবানীতে। আবু হুরায়রা বলেন, একদা এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! ‘অমুক মহিলা বেশি বেশি নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং দান-সাদকা করে বলে খ্যাতি লাভ করেছে। অথচ সে নিজের মুখের দ্বারা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয়।

নবীজি বললেন, সে জাহান্নামি। লোকটি আবার বলল, হে আল্লাহর রাসুল! অমুক মহিলা সম্পর্কে বলাবলি হয় যে, সে অতিরিক্ত রোজা রাখে না, দান-সদকাও কম করে এবং বেশি বেশি নামাজও পড়ে না। তার দানের পরিমাণ পনীরের টুকরোর পরিমাণ। কিন্তু (তার একটি গুণ আছে যে) সে নিজের মুখ দ্বারা প্রতিবেশীদের কষ্ট দেয় না। নবীজি বললেন, সে জান্নাতি।’

-(মুসনদে আহমদ ও বায়হাকীর বরাতে মিশকাত হাদীস-৪৯৯২)

কোরআন ও হাদিসের এই শিক্ষা ও আদর্শের আবেদন ও গভীরতা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। আমাদের মাঝে ব্যাপকভাবে চর্চা করতে হবে।

যদি আমাদের প্রচার মাধ্যম ও শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামের এসব সুন্দর শিক্ষা ও আদর্শের চর্চা করা হয়, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার সিলেবাসভুক্ত করা হয় তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তা ও চেতনা সেভাবে গঠিত হবে। তখনই আমরা সম্প্রীতি ও সহমর্মিতার সুন্দর সমাজ ও শান্তিময় পরিবেশ আশা করতে পারব।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত