ঈমান ও আল্লাহর পরিচয়

প্রকাশ : ১৫ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

রমজান মাসে সবচে বেশি অনুশীলন হয় ঈমানের। ঈমান মানে বিশ্বাস। সাধারণত মনে করা হয় যারা মুসলমান নয়, কাফের মুশরিক তারা আল্লাহকে বিশ্বাস করে না। এই ধারণা সঠিক নয়। যাদেরকে আমরা কাফের, আল্লাহকে অস্বীকারকারী বলে জানি কিংবা যারা মুশরিক অংশীবাদী মূর্তিপূজারী হিসেবে পরিচিত তারাও আল্লাহকে বিশ্বাস করে, যদিও আল্লাহর পরিবর্তে তারা ইশ্বর বা অন্য কোনো পরিভাষা ব্যবহার করে। এই বিশ্বাসের কারণে তারা কিছুতেই মুসলমান বা ঈমানদার বলে গণ্য হবে না। আরবের কাফের মুশরিক যারা ইসলামের চরম শত্রু তারাও আল্লাহকে বিশ্বাস করত। এমনকি মুহাম্মদ (সা.) ও মুসলমানদের উপর যুদ্ধে বিজয় লাভের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইত। কোরআন মজিদের একটি আয়াত সামনে রাখলে বিষয়টি পরিষ্কার বুঝা যাবে।

‘আপনি যদি এদের জিজ্ঞাসা করেন, আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবী কে সৃষ্টি করেছেন? তারা অবশ্যই বলবে, আল্লাহ। বলুন, তোমরা কি ভেবে দেখ, আল্লাহ আমার অনিষ্ট চাইলে তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদেরকে ডাক তারা কি সেই অনিষ্ট দূর করতে পারবে? অথবা তিনি আমার প্রতি অনুগ্রহ করতে চাইলে তারা কি সেই অনুগ্রহ রোধ করতে পারবে? (কাফির মুশরিকরা এর কোনো সদুত্তর দিতে পরবে না। কাজেই আপনি) বলুন, আমার জন্য আল্লাহই যথেষ্ট। নির্ভরকারীগণ আল্লাহরই উপর নির্ভর করে।- (সূরা যুমার, আয়াত-৩৮)

বুঝা গেল, কাফের মুশরিকরাও বিশ্বজগতের একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন এ কথা বিশ্বাস করে। তবে তারা আল্লাহভিন্ন অন্য কোনো মানুষ, দেবদেবী মূর্তি ও অশরীরি শক্তিকে মানুষের উপকার বা অপকার সাধনে আল্লাহর অংশীদার বলে মনে করে। এ কারণেই তারা মুশরিক, অংশীবাদী, মূর্তিপূজারী ও কাফের।

মুসলমানরা বিশ্বাস করে আল্লাহর কোনো অংশীদার নেই। তারা ত্রিত্ববাদে বিশ্বাস করে না। আল্লাহর কোনো পুত্র বা পরিজন থাকতে পারে না। আল্লাহ তাআলার গুণাবলী ও কার্যাবলীতেও কোনো অংশীদার নেই। আল্লাহর সমান গুণ ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী দেবদেবি বা পীর পুরোহিত কেউ নেই। আল্লাহর কার্যক্ষমতায় কারো অংশীদারিত্ব নেই। একমাত্র তিনিই মানুষের উপকার বা অপকার সাধন করতে পারেন। অসু¯’ হলে তিনিই শেফা দান করেন। তিনিই জীবন ও মরণ দিতে পারেন। কারো উপকার কিংবা অপকার সাধনের চূড়ান্ত ক্ষমা একমাত্র তারই নিয়ন্ত্রণে। কাজেই তার কাছেই সাহায্য চাইতে হবে। বিপদে আপদে তার আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে।

আমরা কাজে কর্মে একে অপরের সাহায্য সহযোগিতা চাই, তার অর্থ এই নয় যে, যার কাছে সাহায্য চাই একমাত্র তিনিই আমার দুঃখ মোচন করে দিতে পারবেন। ডাক্তার আমার চিকিৎসা করতে পারবেন। কিš‘ চূড়ান্তভাবে শেফা আরোগ্য দান করার ক্ষমতা একমাত্র আল্লাহর। নচেত ডাক্তারের চিকিৎসা নিলে সব রোগীই ভালো হয়ে যেত। কাউকে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হত না।

মহামহিম আল্লাহর এই পরিচয় ও বিশ্বাস মুমিনের অন্তরে বদ্ধমূল করার অনুশীলন হয় পবিত্র রমজানে। চিন্তা করুন, একমাত্র আল্লাহর ভালোবাসা ও ভয় না হলে অন্যকোনো শক্তি মানুষকে দিনের বেলা পানাহার ও স্বামী স্ত্রীর যৌন জীবন থেকে বিরত রাখতে পারত না। কারণ রোজাদার বিশ্বাস করে, আর কেউ না দেখলেও স্বয়ং আল্লাহ সর্বক্ষণ আমাকে দেখছেন। তার আদেশ লংঘনের শক্তি আমার নেই।

মুসলমানরা কোনো শক্তি, মূর্তি, পীর, পুরেহিত বা দেবদেবিকে আল্লাহর সমকক্ষ মনে করে না। তারা যে খোদায় বিশ্বাসী তার একটি পরিচয় ফুটে উঠে সূরা ইখলাসে।

মুকাতিল, কাতাদাহ ও দাহহাক বর্ণনা করেন, কতিপয় ইয়াহূদী একবার রাসূলুল্লাহ (সা)-এর কাছে এসে বলল : আমাদের আপনার প্রভু সম্পর্কে বিবরণ দিন। আল্লাহ তো তাওরাত কিতাবে তার পরিচয় নাযিল করেছেন। কাজেই আমাদের বলুন : তিনি কিসের তৈরি? কোন ধাতু দিয়ে নির্মিত? তিনি কি খান বা পান করেন? দুনিয়ার উত্তরাধিকার তিনি কার কাছ থেকে পেয়েছেন এবং কার জন্য এই দুনিয়ার উত্তরাধিকার রেখে যাবেন?

অপর বর্ণনায় মক্কার কতিপয় মুশরিক নবী করীম (সা)-কে বলল: আপনি আমাদের কাছে আপনার রবের বংশপরিচয় বর্ণনা করুন।

ইবনে আব্বাস (রা) হতে বর্ণিত, নাজরানের প্রতিনিধিদল রাসূলুল্লাহ (সা)-এর খিদমতে আসে। তাদের মধ্যে সৈয়দ ও আকিব (-এর মতো ব্যক্তিত্ব)-ও ছিলেন। তারা নবী করীম (সা)-কে বললেন, আপনি আমাদের কাছে আপনার রবের বিবরণ দিন যে, তিনি কোন জিনিস দিয়ে তৈরি? তখন নবী করীম (সা) বলেন : আমার রব কোনো ব¯‘ দিয়ে তৈরি নন, তিনি সকল ব¯‘ হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ইখলাস (কুল হুয়াল্লাহ) নাযিল করেন।

‘বলুন, ‘তিনি আল্লাহ, এক-অদ্বিতীয়, আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সবাই তাঁর মুখাপেক্ষী; তিনি কাউকে জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেয়া হয়নি। এবং তাঁর সমতুল্য কেউ নেই।’ -(সূরা ইখলাস)

আল্লাহ তাআলার পরিচয় আরো স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে আয়াতুল কুরসিতে, যা আমদের অনেকের মুখস্ত এবং নিয়মিত পড়ি।

‘আল্লাহ, তিনি ব্যতীত কোনো ইলাহ নেই। তিনি চিরঞ্জীব, সর্বসত্তার ধারক, তাকে তন্দ্রা অথবা নিদ্রা স্পর্শ করে না। আকাশ ও পৃথিবীতে যাকিছু আছে সমস্ত তারই। কে সে, যে তাঁর অনুমতি ব্যতীত তাঁর নিকট সুপারিশ করবে। তাদের সম্মুখে ও পশ্চাতে যাকিছু আছে তা তিনি অবগত। যা তিনি ই”ছা করেন তা ব্যতীত তার জ্ঞানের কিছুই তারা আয়ত্ব করতে পারে না। তাঁর কুরসি আকাশ ও পৃথিবীময় পরিব্যপ্ত : এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ তাকে ক্লান্ত করে না; আর তিনি মহান, শ্রেষ্ঠ।- (সূরা বাকারা, আয়াত-২৫৫)