ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জলদস্যুর কবলে বাংলাদেশি জাহাজ

নাবিকদের উদ্ধারে তোড়জোড়

নাবিকদের উদ্ধারে তোড়জোড়

সোমালিয়া জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া বাংলাদেশি কয়লাবাহী জাহাজের (বাল্কশিপ) অবস্থা নিশ্চিত করা গেছে। গতকাল বাংলাদেশ সময় বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে জাহাজটি সোমালিয়া উপকূল গ্যারাকাদ থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে নোঙর করা হয়েছে। জলদস্যুদের কেউ জাহাজ মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। তবে জলদস্যুদের কাছ থেকে প্রথম প্রতিক্রিয়া পেতে আরো কয়েক দিন সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত বৃহস্পতিবার রাতে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএমওএ) দেওয়া সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, সোমালিয়া উপকূল গ্যারাকাদ থেকে প্রায় ২০ মাইল দূরে জাহাজটি নোঙর করা হয়েছে। জাহাজে থাকা সব নাবিক নিরাপদে আছেন। জলদস্যুদের সাথে আলোচনা এবং নাবিকদের নিরাপদে দেশে ফেরত নিয়ে আসার জন্য প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবেন বলে আশ্বাস দিয়েছে কেএসআরএম। জাহাজে বন্দি থাকা এক নাবিকের পাঠানো বার্তায় বলা হয়েছে, ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ উদ্ধারে গত বুধবার রাতে পিছু নেয় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) একটি জাহাজ। একপর্যায়ে ইইউ নৌবাহিনীর সঙ্গে জলদস্যুদের গোলাগুলি হয়। তবে জলদস্যুদের সঙ্গে গোলাগুলির একপর্যায়ে দস্যুরা বাংলাদেশি জাহাজের জিম্মি নাবিকদের হত্যার হুমকি দেয়। এতে উপায় না পেয়ে পিছু হঠে ইইউর নৌবাহিনীর জাহাজটি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবিসি নিউজ জানিয়েছে, জাহাজটিকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি (ইইউ) জাহাজ। এ বিষয়ে গত মঙ্গলবার ইউরোপীয় ইউনিয়নের মেরিটাইম সিকিউরিটি ফোর্স জানিয়েছে, তাদের একটি রণতরী উপকূলে বাংলাদেশি ওই জাহাজটিকে অনুসরণ করছে। জাহাজটিতে ২৩ নাবিক জিম্মি অবস্থায় রয়েছেন।

সংশ্লিষ্টরা আরও বলছেন, ২০১০ সালে ৫ ডিসেম্বর একই কোম্পানির জাহাজ ‘জাহান মনি’ নামের একটি জাহাজ জিম্মি করেছিল সোমালিয়ান জলদস্যুরা। ওই জাহাজে নিকেলভর্তি ও ২৫ নাবিক ছিলেন। দীর্ঘ চেষ্টার পর ১০০ দিনের মাথায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্ত করা হয় জাহাজটি। পরে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। পুরোনো অভিজ্ঞতার আলোকে এবারের জিম্মি জাহাজটি উদ্ধারে খুব বেশি সময় লাগবে না। আগামী দুই থেকে তিন দিনের মধ্যেই সম্ভবত একটা সমাধান আসবে।

বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাখাওয়াত হোসেন বলেন, লন্ডন ও কুয়ালালামপুরভিত্তিক জলদস্যুতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম ব্যুরো’র (আইএমবি) তথ্যে বলা হয়েছে- জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূল গ্যারাকাদ থেকে ২০ নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর করে রাখা হয়েছে। উপকূল থেকে জাহাজে যেতে প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগবে।

জাহাজটির মালিকপক্ষ কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম বলেন, জাহাজটি সোমালিয়ান উপকূলে নোঙর করার কথা আমরাও জেনেছি। তবে দস্যুদের কেউ এখনও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। নাবিকরা সবাই সুস্থ আছেন। নিরাপদে আছেন। তাদের মুক্ত করার ব্যাপারে কাজ করছি।

অতীতের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর বিষয়ে মিজানুল ইসলাম বলেন, নাবিকদের উদ্ধারে আমরা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছি। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করছে। তাদের গাইডলাইন অনুযায়ী এগোন হচ্ছে। কোনো ভুলের কারণে যাতে নাবিকদের জীবন বিপন্ন না হয়, সে বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করা হচ্ছে।

এদিকে নাবিকদের খোঁজে বারবার মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন জিম্মি থাকা নাবিকদের স্বজনরা। গত বুধবার থেকেই নাবিকদের স্বজন ছুটে গেছেন কেএসআরএম কার্যালয়ে। তাদের একজন জান্নাতুল ফেরদৌস। জিম্মি নাবিক নুরউদ্দিনের স্ত্রী স্বামীর সঙ্গে শেষ কথোপকথনের তথ্য জানিয়ে তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার সন্ধ্যার পর শেষবারের মতো কথা হয়েছে। সে বলেছে বিপদে আছে। মুক্তিপণ না পেলে জলদস্যুরা তাদের মেরে ফেলবে, তাদের মুক্ত করতে আমরা যাতে মালিকপক্ষের সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগ করি। তাই এখানে ছুটে এসেছি।

জানা গেছে, এর আগেও বাংলাদেশি অনেক জাহাজ, নাবিক ও ক্রু সোমালিয়ান জলদস্যুদের কাছে জিম্মি হয়েছিলেন। তাদের কেউ ২০ মাস পর, কেউ ১০ মাস পর জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পান। ২০১২ সালে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে ২০ মাসেরও বেশি সময় জিম্মি থাকার পর বাংলাদেশি সাতজন নাবিক মুক্তি পান। ২০১০ সালের ২৬ নভেম্বর ভারত মহাসাগর থেকে মালয়েশিয়ার পতাকাবাহী জাহাজ এম ভি আলবেডোকে জিম্মি করে সোমালিয়ার জলদস্যুরা। এ সময় তারা জাহাজটিতে থাকা ২২ জন কর্মকর্তা এবং ক্রুকেও জিম্মি করে। এই ২২ জনের মধ্যে ছিলেন ৭ জন বাংলাদেশি, ৭ জন পাকিস্তানি, ৬ জন শ্রীলঙ্কাকান এবং একজন করে ভারতীয় ও ইরানি নাগরিক। তাদের সবাই মুক্তিপণ দিয়ে দীর্ঘ সময় পর মুক্ত হয়েছিলেন।

তবে এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ কোন পথে এগোচ্ছেন সেটি বলতে নারাজ। এ ব্যাপারে কেএসআরএম গ্রুপের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার জাহান রাহাত বলেন, জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে মুক্তিপণের অর্থ কত হতে পারে সেটি কৌশলগত কারণে প্রকাশ করা হয় না। আগেও করিনি, এবারও করব না। আমাদের মূল উদ্দেশ্য নাবিক ও ক্রুকে নিরাপদে দেশে ফিরিয়ে আনা।

এ বিষয়ে নৌ বাণিজ্য দপ্তরের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ বলেন, এটা পুরোবিশ্বেই গোপন রাখার একটা প্রবণতা আছে। মুক্তিপণের অর্থ জানাজানি হলে এটি পাঠাতে জটিলতা তৈরি হয়। আবার দেশে বিভিন্ন দপ্তর ভ্যাট-ট্যাক্স বিষয়ে প্রশ্ন তুলতে পারে। বিষয়টি জানাজানি হলে অন্য দস্যুরাও এ কাজে উৎসাহিত হতে পারে। এমন নানা বিষয় মাথায় রেখে মুক্তিপণের অর্থ প্রকাশ্যে আনে না কেউই। জাহাজ ও নাবিকদের উদ্ধারে মুক্তিপণের অর্থের বিষয়ে বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক পথে চলাচল করা প্রতিটি জাহাজের ঝুঁকি বীমা থাকে। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা লন্ডনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এর সঙ্গে যুক্ত থাকে। এ ধরনের সংকট বা জাহাজ পরিচালনায় কোনো সমস্যা দেখা দিলে আগে বিমা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করে জাহাজের মালিকপক্ষ। এখানেও সে প্রক্রিয়ায় কাজটি এগোচ্ছে। নিজেরা সরাসরি সম্পৃক্ত হলে অর্থের জটিলতা কিংবা প্রক্রিয়াগত জটিলতা তৈরি হতে পারে।

জানা গেছে, জাহাজটি জলদস্যুদের কাছ থেকে মুক্ত করতে এরই মধ্যে বিমা কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করেছে মালিকপক্ষ। তবে বিমা কোম্পানি কিংবা তাদের প্রতিনিধির নামণ্ডঠিকানা প্রকাশ করা হচ্ছে না।

জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান এক অডিও বার্তায় জানিয়েছেন, জাহাজে ২০ থেকে ২৫ দিনের খাবার পানি আছে। খাবার আছে ২০০ টনের মতো। পানি-খাবার শেষ হলে বিপদে পড়ার শঙ্কা রয়েছে সবার। এ বিষয়ে মালিকপক্ষ জানায়, জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ায় এখন রেশনিং করে চলতে হবে। ২০০ টন খাবার দিয়ে সাধারণত এক মাস চলা যায়। রেশনিং করলে আরো বেশি দিন যাবে। একইভাবে ২৫ দিনের খাবার রেশনিং করে আরও কিছুদিন চালিয়ে নেওয়া যাবে। এর মধ্যে সুরাহা না হলে তারা তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে প্রয়োজনে খাবার ও পানীয় পাঠাবে জাহাজে। ‘এমভি আবদুল্লাহ’তে কিছু কোল্ড কার্গো আছে, যেগুলো ভয়ের কারণ বলে মনে করছেন জাহাজের চিফ অফিসার আতিক উল্লাহ খান। অডিও বার্তায় তিনি এসব নিয়ে বিশেষজ্ঞ মতামত নেওয়ার অনুরোধ করেন। তিনি বলেন, জাহাজে প্রায় ৫৫ হাজার টন কোল্ড কার্গো আছে, যা বিপজ্জনক। যেকোনো মুহূর্তে আগুন লাগতে পারে। সর্বশেষ যখন মাপায় হয় তখন অক্সিজেন ৯-১০ শতাংশ লেভেলে ছিল।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত