উৎপাদন-বিতরণ নীতিমালায় ঘাটতি

আতঙ্ক ছড়াচ্ছে গ্যাস সিলিন্ডার

প্রকাশ : ১৬ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

রাজধানীতে দিনে দিনে অসংখ্য বহুতল আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ হচ্ছে। তবে এসব ভবনে নতুন করে গ্যাস সংযোগ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দীর্ঘ কয়েক বছর আগের গ্যাস সংযোগের পথ বন্ধ করেছে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। ফলে বাধ্য হয়েই মানুষ বাসা-বাড়িসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বোতালজাত বা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করছে। কিন্তু এসব গ্যাসের বোতলের মেয়াদ কিংবা ব্যবহারের বিষয়ে সচেতনার অভাব রয়েছে। যার কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। বিস্ফোরণের ঘটনায় বহু মানুষ মারা গেছেন এবং অসংখ্য হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ফলে গ্যাসের সিলিন্ডার নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

গত বছর নাটোরের বড়াইগ্রামের খাকসা উত্তরপাড়া গ্রামে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে দুই সন্তানসহ এক মায়ের মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। একই অবস্থা রাজধানীর ভাটারার সাঈদ নগরে এক বাসায় রান্নার সময় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের আগুনে দগ্ধ হয়ে এক দম্পতির মৃত্যু হয়। এর আগে ফেনী নয়ন টাওয়ারে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে এক কেয়ারটেকারের মৃত্যু হয়। চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায় গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে খোরশেদ আলম নামের এক যুবক মারা যান। সর্বশেষ গত বুধবার গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় রাস্তায় ছুড়ে ফেলা গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ৩৫ জন দগ্ধ হন। এরমধ্যে গতকাল একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এভাবেই গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রতিদিন মানুষ দগ্ধ হচ্ছেন।

কালিয়াকৈর কলোনির বাসিন্দারা জানান, তেলিরচালা এলাকার শফিকুল ইসলাম শফিক তার বাসার জন্য গ্যাস সিলিন্ডার নিয়ে আসেন। সেটি চুলার সঙ্গে লাগানোর সময় গ্যাস বের হতে থাকে। একপর্যায়ে এটিকে বাইরে রাস্তায় ফেলে দেন। সেখানে একটি মাটির চুলার আগুন সিলিন্ডারে লেগে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে রাস্তায় ও আশপাশে থাকা ৩৫ জন দগ্ধ হন। তাদের ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স বলছে, ঢাকাসহ সারাদেশে দৈনিক গড়ে দুটি সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। যার বেশিরভাগই বাসা-বাড়িতে। বিস্ফোরণের অন্যতম দায়ী ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ। তাই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে আরো সতর্ক হওয়ার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান দেখা গেছে, গত বছর চুলার গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ২১০টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ২০২২ সালে তা ছিল ৯৪টি। এসব ঘটনায় হতাহতের পাশাপাশি মূল্যবান মালামালেরও ক্ষতি হয়। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কারিগরি ত্রুটি, অসচেতনতা ও অসতর্কতার ফলে সিলিন্ডার দুর্ঘটনা ঘটছে। দিনে দিনে তা বেড়েই চলেছে। রান্নার কাজকে সহজ করতে নিয়ে আসা সিলিন্ডার এখন মানুষের কাছে আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই গ্যাসসংক্রান্ত দুর্ঘটনা রোধে ব্যবহারকারীদের সচেতন করা দরকার। পরিসংখ্যান বলছে, বর্তমানে দেশে ৬০ লাখের বেশি এলপিজি ব্যবহারকারী রয়েছেন। আর এলপিজি সিলিন্ডার সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন কোটির কাছাকাছি। ২০১০ সালে আবাসিকে নতুন গ্যাস সংযোগ বন্ধের পর থেকে বাসাবাড়িতে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়তে থাকে। গত কয়েক বছর ধরে প্রাকৃতিক গ্যাসের সীমাবদ্ধতায় দেশজুড়ে রান্নার কাজের এলপিজি (তরল পেট্রোলিয়াম গ্যাস) ব্যবহার করা হচ্ছে। বাজারে সাড়ে ১২ কেজি থেকে শুরু করে ৪৫ কেজি পর্যন্ত বিভিন্ন আকারের সিলিন্ডার সরবরাহ করা হয়। গৃহস্থালি রান্নার পাশাপাশি রেস্তোরাঁ, পরিবহন, ছোট-বড় শিল্পকারখানায়ও এলপিজি ব্যবহার করা হচ্ছে। সিলিন্ডার জ্বালানি সহজলভ্যের পাশাপাশি বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার এবং এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেওয়ার সময় সতর্ক থাকুন। সাধারণত এলপিজি গ্যাস ২ শতাংশ ও লাইনের প্রাকৃতিক গ্যাস ৫ শতাংশ বাতাসের সংস্পর্শে এলেই তা বিস্ফোরণ সম্ভাবনা তৈরি করে। লাইন গ্যাসের চেয়ে ১০-১২ গুণ চাপ কম থাকে সিলিন্ডার গ্যাসে। গৃহস্থালির বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটছে গ্যাস লিকেজ থেকে। মূলত সিলিন্ডার থেকে কানেক্টিং পাইপ, চুলার রাবার কিংবা রেগুলেটরের ত্রুটি থেকে গ্যাস লিকেজ হচ্ছে। তা হয়তো বদ্ধঘরে জমা হচ্ছে। এক পর্যায়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক বা কোনোভাবে আগুন লেগে বিস্ফোরণ ঘটছে। তাই গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারে প্রয়োজন সচেতনতা।

গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা, ১৯৯১’র বিধি ১৫ এর বিধান সাপেক্ষে প্রস্তুতকারীর সুপারিশ অনুসারে সেফটি রিলিফ ব্যবস্থার রক্ষণাবেক্ষণ করিতে হইবে। পরীক্ষণকারী কর্তৃক প্রদত্ত মেরামত ও পরীক্ষণের বিবরণসহ, একটি প্রত্যয়নপত্র সংযুক্ত করা যে সিলিন্ডারটি পুনরায় গ্যাস ভর্তির উপযুক্ত। একটি সিলিন্ডার কতবার গ্যাস ভর্তি করা হয়, সেটি বোঝা কঠিন হয়ে পড়ে।

সারাদেশে কয়েকটি গ্রুপ অব কোম্পানি আবাসিক-বাণিজ্যিক খাতে ব্যবহারের জন্য গ্যাস সিলিন্ডার তৈরি এবং বাজারজাত করছে। আর নীতিমালা ভঙ্গ করে এসব সিলিন্ডার এখন যত্রতত্র বিক্রি হচ্ছে। বিস্ফোরক অধিদপ্তর গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রির জন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বিক্রয় ও বিপণন লাইসেন্স প্রদান করলেও সাব-ডিলারের নামে এসব প্রতিষ্ঠান জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নের বাজারে মুদি মালের মতো গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করছে।

বিস্ফোরক আইন ১৮৮৪-এর অধীনে গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা ২০০৪-এর ৬৯ ধারা অনুযায়ী লাইসেন্স ছাড়া অনধিক ১০টি গ্যাসপূর্ণ সিলেন্ডার মজুত করা যাবে। তবে বিধির ৭০ ধারা অনুযায়ী এসব সিলেন্ডার মজুত করার ক্ষেত্রে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতি এবং আগুন নিয়ন্ত্রক সরঞ্জাম মজুত রাখতে হবে। সিলিন্ডার গ্যাস স্থাপনা প্রাঙ্গণে দিয়াশলাই বা আগুন লাগতে পারে এমন কোনো বস্তু বা সরঞ্জাম রাখা যাবে না। মজুত করা স্থানের কাছাকাছি আলো বা তাপের উৎস থাকা যাবে না। এসব আইনের তোয়াক্কা না করে চা-দোকান থেকে আরম্ভ করে ভ্যারাইটিজ স্টোরেও পাওয়া যায় এ সিলিন্ডার গ্যাসের বোতল।

বিস্ফোরণ ঘটনার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা জানান, গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের বেশির ভাগ ঘটনার নেপথ্যে থাকে ত্রুটিপূর্ণ যন্ত্রাংশ ব্যবহার। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ত্রুটি পাওয়া যায় গ্যাস ভালভ ও রেগুলেটরে। কিছু ক্ষেত্রে মানহীন হোস পাইপ থেকেও এমন লিকেজ হয়। এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধে সিলিন্ডার নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি এর ব্যবহারকারীদেরও সচেতনতা বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া বলেন, সিলিন্ডার ব্যবহারে গ্রাহকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিতে হবে। বিশেষ করে গ্যাসে লিকেজ আছে কি না, চেক করে নিতে হবে। প্রয়োজনে গ্যাস লিকেজ ডিটেক্টর রাখতে হবে। সাধারণত একটি সিলিন্ডারের মেয়াদ ১০ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।