বিশ্বব্যবস্থাপনায় ফেরেশতাদের ভূমিকা

প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

পবিত্র মাহে রমজানের প্রশিক্ষণ সূচির শুরুতে আছে ঈমান। আল্লাহতায়ালার মহান সত্তাসহ অদৃশ্য অনেক বিষয় সম্পর্কে এমন জ্ঞান, যা বিশ্বাসে পরিণত হয় সেটিই ঈমান। যারা সারাদিন রোজা রেখে ক্লান্ত শরীরে রাতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খতম তারাবি পড়েন তারা নিশ্চিতই ঈমানদার। কারণ আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও মনে ভয়-ভালোবাসা লালন না করলে কেউ রোজার সংযম সাধনার কষ্ট স্বীকার করতে পারে না।

আগুন যে কোনো দাহ্য জিনিসকে জ্বালায় আমরা তা বিশ্বাস করি। কিন্তু যখন স্বচক্ষে দেখি যে, আগুন কোনো জিনিসকে জ্বালাচ্ছে তখন বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়, এর নাম আইনুল ইয়াকীন। নিজের হাতটি আগুনের মধ্যে দিলে যখন পুড়ে যায়, তখন আগুনের দহনশক্তি সম্পর্কে অকাট্য জ্ঞান অর্জন হয় তার নাম হক্কুল ইয়াকীন, সুদৃঢ় ঈমান। রমজানে রোজা ও ইবাদতের মাধ্যমে এই জ্ঞান ও ঈমানের মাসব্যাপী অনুশীলন ও প্রশিক্ষণ হয়, ঈমান হক্কুল ইয়াকীন স্তরে পৌঁছে যায় ।

আল্লাহর প্রতি ঈমানের সঙ্গে আরো ছয়টি বিষয়ের অকাট্য বিশ্বাস থাকতে হবে, তবেই ঈমান পূর্ণতা পাবে। ১. ফেরেশতারা, ২. নাজিলকৃত কিতাবগুলো, ৩. আল্লাহর নবী রাসূলরা, ৪. পরকালীন জীবন, ৫. তকদীরের ভালোমন্দ ও ৬. মরণের পর পুনরুত্থান।

পৃথিবীর যে কোনো রাষ্ট্রে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষায় দুই ধরনের বাহিনী নিয়োজিত থাকে। দৃশ্যমান বাহিনী পুলিশ, বিডিআর বা আর্মি। অদৃশ্য বাহিনীতে থাকে গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। আল্লাহ পাক বিশ্ব¦ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব দিয়েছেন মানুষের উপর। তার সহাযোগী হিসেবে নিযুক্ত করেছেন প্রাকৃতিক শক্তি ও উপাদানগুলো। দৃশ্যমান এসব জিনিসের অন্তরালে রয়েছে আরো কতক সৃষ্টি ও শক্তি। এর একটির নাম ফেরেশতা। আল্লাহর সম্মানিত ফেরেশতা জিব্রাঈল (আ) নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে আল্লাহর বাণী কোরআন মজীদ নিয়ে এসেছিলেন। কাজেই কেউ ফেরেশতার অস্তিত্বে বিশ্বাস না করলে কাফের হয়ে যাবে।

ফেরেশতারা মানুষ ও জিনের মতো আল্লাহর আরেকটি সৃষ্টি। তারা অতি সম্মানিত। কোনো ব্যাপারে আল্লাহর আদেশের অমান্যতা করেন না। আল্লাহর প্রতিটি আদেশ পালনে সর্বক্ষণ নিয়োজিত। মানুষের সাথে তাদের পার্থক্য আছে, তারা অশরীরি নূরের (জ্যোতির) তৈরি। তাদের মধ্যে পুরুষ নেই, মেয়েও নেই। বিয়েশাদী বংশবিস্তার হয় না। তারা খান না, পান করেন না। ওসব চাহিদাও নেই। কোনো কাজে ক্লান্ত হন না। তাদের হায়াত অতি দীর্ঘ, তবে একদিন অবশ্যই মরণ বরণ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা তাদের বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত করে রেখেছেন। তাই তাদের বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা ও শক্তিশালী ডানায় সজ্জিত করা হয়েছে, যাতে চোখের পলকে যে কোনো একশনে যেতে পারেন।

মানুষের মধ্যে যারা নেককার তারা ফেরেশতাদের চেয়ে উচ্চ মর্যাদার অধিকারী বলে অধিকাংশ গবেষক আলেমের মতো। ফেরেশতাদের সংখ্যা এতই অগণিত যে, প্রতিদিন ৭০ হাজার ফেরেশতা সপ্ত আসমানে তাদের জন্য নির্মিত কাবাঘর ‘বায়তুল মামুর’-এ প্রবেশ করেন। যারা একবার প্রবেশ করেন জীবনে দ্বিতীয়বার প্রবেশের অনুমতি পান না। তারা মানুষের অবয়ব ধারণ করতে পারেন। নবীজির কাছে সাহাবী দাহিয়াতুল কলবি এবং ইব্রাহীম (আ.)-এর কাছে মুসাফির ও লূত (আ.) এর কাছে সুদর্শন বালকের অবয়বে এসেছেন বলে হাদীস ও কুরআনে উল্লেখ আছে। তাদের জ্ঞানের পরিধি অনেক ব্যাপক; তবে মানুষের মতো বিচার বিশ্লেষণের ক্ষমতা তাদের দেয়া হয়নি।

সৃষ্টির প্রতি ফেরেশতাদের কার্যাবলীকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যায়। তাদের কিছু কাজ জড়িত সাধারণ সব লোকের সাথে। কিছু কাজ মু‘মিন ও খাস নেককার বান্দাদের নিয়ে। কিছু দায়িত্ব পালন করেন কাফের, আল্লাহর অবাধ্যদের ব্যাপারে। আর কিছু কাজ মানুষ ব্যতীত অন্যসব সৃষ্টিকে নিয়ে।

মু‘মিনদের প্রতি ফেরেশতাদের বিশেষ দায়িত্ব, মুসলমানরা যখন দোয়া করে তখন তারা আমীন বলেন। মুসলমানদের প্রতি ভালোবাসা পোষণ করেন, যত্ন নেন। কাফেরদের ব্যাপারে তাদের দায়িত্ব আল্লাহর নাফরমানির সীমা ছাড়িয়ে গেলে তাদের শাস্তির সম্মুখীন করা।

তাদের মধ্যে চারজনের ওপর রয়েছে সমগ্র সৃষ্টি ব্যবস্থাপনার মূূল দায়িত্ব। একজন জিব্রাঈল (আ); তিনি আল্লাহর বাণী নবী রাসূলদের কাছে পৌঁছানোর দায়িত্বে নিয়োজিত। বদর যুদ্ধে মুসলমানদের পক্ষে কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। তিনি অতিশয় সম্মানিত। কোরআন মজীদে রুহুল আমীন ও রুহুল কুদুস উপাধীতে স্মরণ করা হয়েছে তাকে।

মিকাঈল (আ.)-এর দায়িত্ব পৃথিবীতে বৃষ্টির, মওসুমের পরিবর্তন এবং মানুষের খাদ্য পানীয়ের ব্যবস্থা করা।

আজরাঈল (আ.) হলেন মৃত্যুদূত। তিনি মানুষের জান কবজ করে নিয়ে যান।

ইসরাফিল (আ.) কেয়ামত সংগঠনের দায়িত্বশীল। তিনি সিঙ্গায় ফুঁক দিলে কেয়ামত সংগঠিত হবে। পৃথিবী আকাশমন্ডলী ধ্বংস হয়ে যাবে। আবার যখন ফুঁক দেবেন সবকিছু পুনরায় জীবন লাভ করবে।

মানুষের নৈমিত্যিক কাজকর্ম রেকর্ড করার দায়িত্বে দুই কাঁধে নিয়োজিত আছেন কেরামান কাতেবিন নামে দুই ফেরেশতা।

মৃত্যুর পর প্রত্যেকের কাছে দুজন ফেরেশতা এসে পৃথিবীতে কোন নীতিতে জীবনযাপন করেছে, তার প্রভু কে, ধর্ম কী এবং হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর পরিচয় জিজ্ঞাসা করবেন। তাদের নাম মুনকির নাকির।

আল্লাহর আরশ বহনে নিয়োজিত ফেরেশতাদের বলা হয় হামালাতিল আরশ। বেহেশতের প্রধান প্রহরি ফেরেশতার নাম রিদওয়ান ও দোযখের পাহারদার মালিক।

মানুষের আগেই ফেরেশতাদের সৃষ্টি। মানব সৃষ্টির ব্যাপারে আল্লাহ পাক ফেরেশতাদের নিয়ে পরামর্শ সভা করেছিলেন মর্মে কোরআন মজীদে বিস্তারিত বিবরণ আছে। রমজানে শবেকদরে জিব্রাঈল (আ.)-এর নেতৃত্বে অগণিত ফেরেশতা দুনিয়াবাসীর জন্য আল্লাহর রহমত নিয়ে আসেন। এই রমজানে যেন তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়, সেই মনোবল ও প্রস্তুতি চাই।