ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অবন্তিকার আত্মহত্যায় উত্তাল জবি ক্যাম্পাস

* অভিযুক্ত শিক্ষক বরখাস্ত, শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার * বিচারের আশ্বাস উপাচার্যের * ছয়দফা দাবি, প্রশাসনিক ভবন ঘেরাওয়ের হুমকি শিক্ষার্থীদের
অবন্তিকার আত্মহত্যায় উত্তাল জবি ক্যাম্পাস

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনায় চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। গত শুক্রবার রাতে কুমিল্লার নিজ বাড়িতে আত্মহত্যার পর মধ্যরাতে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফটক বন্ধ করে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করে। এ ঘটনায় জড়িতদের বিচারসহ ছয়দফা দাবিতে গতকাল দুপুর সাড়ে তিনটায় ফের বিক্ষোভণ্ডসমাবেশ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়’ শীর্ষক ব্যানারে আয়োজিত বিক্ষোভ মিছিলে শিক্ষার্থীরা এ দাবি জানান। মিছিলটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য চত্বর থেকে পুরো ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে আবার ভাস্কর্য চত্বরে এসে শেষ হয়। বিক্ষোভ মিছিলে ছয়দফা দাবি উপস্থাপন করেন অর্থনীতি বিভাগের মাস্টার্সে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী রেজোয়ান। দাবিগুলো হলো- হত্যার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে; অভিযুক্ত আম্মানের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোওয়ানা জারি করা এবং সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকেও অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও সুষ্ঠু বিচার নিশ্চিত করা; জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে অভিযুক্তদের স্থায়ীভাবে বহিষ্কার করতে হবে; ভিকটিমের পরিবারের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনকে বাদী হয়ে মামলা করতে হবে; বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে। এ সময় তারা ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দাবি পূরণ না হলে আগামীকাল সকাল ১১টায় প্রশাসনিক ভবন ঘেরাও করার ঘোষণা দেন।

এদিকে আত্মহত্যাকারী ছাত্রী ফাইরুজ অবন্তিকার ফেসবুক পোস্ট দ্বারা অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মানকে সাময়িক বহিষ্কার ও আম্মানকে সহায়তাকারী হিসেবে উল্লেখ করা সহকারী অধ্যাপক দ্বীন ইসলামকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। একই সাথে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। গতকাল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. আইনুল ইসলাম স্বাক্ষরিত পৃথক চারটি অফিস আদেশে এসব তথ্য জানানো হয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০০৫ এর ধারা ১১(১০) মোতাবেক আইন বিভাগের শিক্ষার্থী রায়হান সিদ্দিকি আম্মানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হলো। একই আইনে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শিক্ষক দ্বীন ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত ও সহকারী প্রক্টর থেকে অব্যহতি দেয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে গঠন করা হয়েছে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে আছেন, শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. জাকির হোসেন ও সদস্য সচিব আছেন আইন শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার অ্যাডভোকেট রঞ্জন কুমার দাশ। এছাড়া সদস্য হিসেবে আছেন, সামাজিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন, আইন অনুষদের ডিন ড. এসএম মাসুম বিল্লাহ ও সংগীত বিভাগের চেয়ারম্যান ড. ঝুমুর আহমেদ।

এদিকে অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকীকে সাময়িক বহিষ্কারের পর দ্রুত গ্রেপ্তারের নির্দেশনা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেছেন, ফাইরুজ অবন্তিকার আত্মহত্যার ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত, সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আইনের বাইরে গিয়ে তদন্ত ছাড়া আমরা এটা করতে পারি না। আমার হাতে যা আইন আছে, সে অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। আগামী ৭ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যাবে বলেও জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় একটা আইন অনুযায়ী চলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী অভিযুক্ত সহকারী প্রক্টরকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। তদন্ত সাপেক্ষে তাকে স্থায়ী বহিষ্কার করা হবে। শুক্রবার রাত দেড়টার দিকে ক্যাম্পাসে উপস্থিত হয়ে এসব কথা বলেন তিনি।

এ ঘটনায় আইনি পদক্ষেপের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার আইনুল ইসলাম বলেন, ‘গ্রেপ্তারের নির্দেশ বিশ্ববিদ্যালয় আইনে নেই। গ্রেপ্তারটা হলো আইনের বিষয়। তার পরিবার থেকে যদি মামলা করে তাহলে পুলিশ মামলা সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেবে।’

এদিকে ঘটনার পর থেকেই মুঠোফোন বন্ধ করে আত্মগোপনে রয়েছেন অভিযুক্ত শিক্ষার্থী আম্মান সিদ্দিকী। গত শুক্রবার দিবাগত রাত ২টার দিকে আম্মান সিদ্দিকী নিজের ব্যক্তিগত ফেসবুক আইডি থেকে একটি পোস্ট করেন। সেখানে তিনি লিখেন, ‘দুই বছর আগে অবন্তিকা নিজেই ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে সহপাঠীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা অপবাদমূলক কথা লিখেন। পরে বিষয়টি সে নিজে স্বীকার করে নিলে প্রক্টর অফিস থেকে তাকে কারণ দর্শানোর নোটিশও দেয়া হয়। এরপর অবন্তিকার পরিবারের পক্ষে তার বাবা এসে অঙ্গীকার নামা দেন যে, তার মেয়ে ভবিষ্যতে এমন কোনো কাজ করবে না। দুই বছর পর সে আত্মহত্যা করল কেন, এটা আমি জানি না। দুই বছর ধরে তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।’ এ সংক্রান্ত ডিজির কপি, কারণ দর্শানোর নোটিশ, অঙ্গীকারনামা এবং কিছু ম্যাসেঞ্জার বার্তার স্ক্রিনশট লেখার সঙ্গে সংযুক্ত করে দেন আম্মান।

এদিকে ফেসবুকে যে পোস্ট দিয়ে অবন্তিকা আত্মহত্যা করেন সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, ‘আমি যদি কখনো সুইসাইড করে মারা যাই, তবে আমার মৃত্যুর জন্য একমাত্র দায়ী থাকবে আমার ক্লাসমেট আম্মান সিদ্দিকী আর তার সহকারী হিসেবে তাকে সাপোর্টকারী জগন্নাথের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম। আম্মান যে আমাকে অফলাইন অনলাইনে থ্রেটের উপর রাখতো, সে বিষয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ করে ও আমার লাভ হয় নেই। দ্বীন ইসলাম আমাকে নানানভাবে ভয় দেখায়, আম্মানের হয়ে যে আমাকে বহিষ্কার করা ওনার জন্য হাতের ময়লার মতো ব্যাপার। আমি জানি এখানে কোনো জাস্টিস পাব না।

পোস্টে আরো উল্লেখ করা হয়, আমি উপাচার্য সাদোকা হালিম ম্যামের কাছে আপনি এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক হিসেবে আপনার কাছে বিচার চাইলাম। আর আমি ফাঁসি দিয়ে মরতেসি। আমার উপর দিয়ে কী গেলে আমার মতো নিজেকে এতো ভালোবাসে যে, মানুষ সে মানুষ এমন কাজ করতে পারে।

এ বিষয়ে আত্মহত্যাকারী অবন্তিকার মা তাহমিনা শবনমের সাংবাদিকদের অভিযোগ করেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে বার বার অভিযোগ জানিয়েও হয়রানির সুরাহা পাননি তারা। এ কারণেই মেয়ে আত্মহত্যা করেছেন। আমার মেয়েকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি আরো অভিযোগ করেন, ‘আমি বিভাগের চেয়ারম্যান, প্রক্টর সবার সঙ্গে যোগাযোগ করেছি, বিষয়টির সুরাহার জন্য। আমার মেয়ে যাতে ভালোভাবে পড়াশোনা শেষ করতে পারে, সেটি আর হলো না। ওদের জন্য আমি মেয়ে হারিয়েছি, আমি তাদের বিচার চাই।’

এ বিষয়ে পোস্টে নাম উল্লেখ করা সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম বলেন, মেয়েটাকে দেখি এক থেকে দেড় বছর আগে। তারা কয়েকজন সহপাঠী প্রক্টর অফিসে আসে। সেসময় তৎকালীন প্রক্টর মোস্তফা কামাল স্যার, আমিসহ আরো কয়েকজন সহকারী প্রক্টর অফিসে ছিল। মেয়েটা ফেক আইডি ব্যবহার করে তার বন্ধুদের এসএমএস দিত। এটা নিয়ে থানায় জিডি হয়েছে বলে আমাদের জানানো হয়। পরে মেয়েটা স্বীকার করে। এরপর তার পরিবারের লোকজন অনুরোধ করে জিডি তুলে নেবার জন্য। তখন সকল প্রক্টরিয়াল টিম মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়, তিন মাস পর্যবেক্ষণে রাখা হবে। কোনো ঝামেলা না হলে জিডি তুলে নেয়া হবে। আমি কখনো মেয়েটার সঙ্গে একা কথা বলিনি। সিসিটিভি ফুটেজ বা প্রক্টর অফিসে লিখিত অভিযোগ দেখলেও বুঝা যাবে। আপনারা ঘটনা তদন্ত করে দেখুন। আমি দোষী হলে শাস্তি দিন। কিন্তু আগেই আমাকে দোষী বানাবেন না দয়া করে। না হলে আমারও সুইসাইড করা লাগবে। গত শুক্রবার রাত ১০টার দিকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ২০১৭-২০১৮ শিক্ষাবর্ষের (১৩তম ব্যাচ) শিক্ষার্থী ফাইরুজ অবন্তিকা কুমিল্লায় নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। পরে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে উদ্ধার করে জেলা সদর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে হাসপাতালের চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। গত শনিবার জোহরের নামাজের পর কুমিল্লা সরকারি কলেজ মাঠে অবন্তিকার জানাজা শেষে স্থানীয় শাসনগাছা কবরস্থানে বাবার কবরের পাশেই সমাহিত করা হয় তাকে। সাংবাদিকদের এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন মৃত ফাইরুজ অবন্তিকার মামা লুৎফুর আনোয়ার ভূঁইয়া। তার মৃত্যুতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম এবং ট্রেজারার অধ্যাপক ড. মো: হুমায়ুন কবীর চৌধুরী গভীর শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করেন।

এদিকে অবন্তিকার মৃত্যুর ঘটনায় বিচার চেয়ে বিবৃতি দিয়েছে জবি সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট ও বিক্ষোভ মিছিল করেছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল। শাখা ছাত্রদল সভাপতি আসাদুজ্জামান আসলাম ও সাধারণ সম্পাদক সুজন মোল্লার নেতৃত্বে নয়াপল্টনের দলীয় কার্যালয়ের সামনে বেলা চারটার দিকে এ মিছিল করেন তারা।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত