আসমানি কিতাবসমূহ নাজিল হয় রমজানে

প্রকাশ : ১৮ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

মাহে রজমানের পবিত্রতা ও গুরুত্ব অনুধাবনের জন্য একটি তথ্যই যথেষ্ট। তাহলো পবিত্র কুরআন মজিদ নাজিলের জন্য আল্লাহ পাক রমজান মাসকেই নির্র্বাচন করেন। শুধু কুরআন নয়, অন্যান্য আসমানি গ্রন্থও নাজিল হয়েছে মাহে রমজানে। ইমাম বগবী হযরত আবু যর (রা.) সূত্রে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে বর্ণনা করেন, ইবরাহীম (আ) এর সহিফাসমূহ নাজিল হয়েছে রমজানের তৃতীয় রাতে, বর্ণনান্তরে প্রথম রাতে। মূসা আলাইহিস সালামের উপর তাওরাত নাজিল হয়েছে রমজানের ষষ্ঠ রাতে। ঈসা আলাইহিস সালামের ওপর ইঞ্জিল অবতীর্ণ হয়েছে ১৩ রমজানের রাতে। দাউদ আলাইহিস সালামের ওপর যবুর নাজিল হয়েছে রমজানের ২৮তম রাতে আর মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর কুরআন নাজিল হয়েছে ২৪ রমজান রাতে। সৃষ্টির শুরু থেকে নবী রাসুলগণের উপর যেসব আসমানি কিতাব নাজিল হয়েছে সবগুলোর প্রতি বিশ্বাস পোষণ করা ঈমানের অন্যতম শর্ত। আমরা মুসলমানরা হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মত। একই সাথে আল্লাহর যত পয়গাম্বর দুনিয়াতে এসেছেন এবং তাদের প্রতি যত কিতাব নাজিল হয়েছে সবগুলোকে আমরা শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি। আমরা বিশ্বাস করি যে, সকল কিতাব মানব জাতির হেদায়তের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে নাজিল হয়েছে। কখনো আল্লাহ মানব জাতিকে হেদায়তশূন্য রাখেননি। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এসব কিতাবের অনুসারীরা নিজেদের স্বার্থে এসব কিতাবের বিধিবিধানে পরিবর্তন সাধন করেছে। একপর্যায়ে এগুলোর অস্তিত্ব বিপন্ন হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে তারা ইচ্ছামত এমনভাবে পরিবর্তন করেছে যার ফলে পরবর্তী লোকদের জন্য কোনটি আল্লাহর বাণী বা কোনটি পয়গাম্বরের বাণী কিংবা অন্য লোকদের দ্বারা সংযোজিত তা ফারাক করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে।

খুশির বিষয় হলো এসব কিতাবে বর্ণিত আল্লাহর বাণী ও শিক্ষাসমূহ কুরআন মজিদে সংরক্ষিত হয়েছে। ফলে কুরআন হয়েছে আসমানি গ্রন্থসমূহের সর্বশেষ সংস্করণ ও সংকলন। কুরআনকে অনুসরণ করলে আগেকার দিনের সব কিতাবের অনুসরণ হয়ে যায়। এর মূল কারণ, আগেকার দিনের নবী রাসুলগণ বিশেষ সময়কাল বা নির্দিষ্ট জনপদের কাছে প্রেরিত হয়েছিলেন। তাদের উপর নাজিলকৃত কিতাবের আবেদনও বিশেষ অঞ্চল, কাল বা জনপদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল। এ কারণে আল্লাহ পাক এসব কিতাব সংরক্ষণের দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেননি। ফল দাঁড়িয়েছে. কিতাবগুলোর অরিজিনাল রূপ কোথাও সংরক্ষিত নেই। এটি আমাদের দাবি নয়, ওইসব কিতাবের অনুসারীরাও দাবি করে না, করতে পারে না যে, তাদের নবীর উপর নাজিলকৃত কিতাব হুবহু তাদের কাছে সংরক্ষিত আছে।

আরেকটি বাস্তবতা হচ্ছে ওইসব কিতাবের কোনো একটির হাফেজ বা পুরো গ্রন্থ কণ্ঠস্থ করেছে- এমন লোক সারা দুনিয়া চষে একজনও পাওয়া যাবে না। সেই তুলনায় কুরআন মজিদের লক্ষ লক্ষ হাফেজ পৃথিবীর সর্বত্র বিদ্যমান, যারা বুকের সিন্দুকে আল্লাহর পবিত্র কালামের আমানত সংরক্ষণ করেন। কুরআনের প্রতিটি বাক্য, অক্ষর ও যতীচিহ্ণ সংরক্ষিত আছে, বিন্দু বিসর্গ পরিবর্তন বা সংযোজন বিয়োজন হয়নি।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ইসলামের প্রথম যুগে নবী করিম (সা.) এর সময়ে কাফের মুশরিকরা কুরআন আল্লাহর বাণী নয় বলে আপত্তি তুলেছিল, তখন আল্লাহ পাক তাদের সামনে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেন। বলেন যে, তোমরা যদি কুরআন আল্লাহর বাণী হওয়ার বিষয়ে সন্দেহ পোষণ করো তাহলে কুরআনের ছোট্ট একটি সুরার মতো কোনো কথা তোমরা রচনা করে দেখাও। এই চ্যালেঞ্জ এমন লোকদের সামনে ঘোষণা করা হয়, যারা নিজেদের আরবি ভাষা ও সাহিত্যে বিশ্বসেরা মনে করত। অথচ তারা ভাবের ঐশ্বর্য, ভাষার লালিত্য ও বক্তব্যের অকাট্যতা নিয়ে একটি ছোট্ট বাক্যও রচনা করে দেখাতে পারেনি।

এই চ্যালেঞ্জ এখনো বলবৎ আছে। ইহুদি খ্রিষ্টানদের মধ্যেও আরবি ভাষার অনেক পন্ডিত আছে। কিন্তু দুনিয়ার শ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিকরা সবাই মিলে এখনো কুরআনের এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে পারবে না। অতীতেও পারেনি : ভবিষ্যতেও কিয়ামত অবধি কেউ এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারবে না। এর কারণ, স্বয়ং আল্লাহ তাআলা কুরআন হিফাজতের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অন্য কোনো কিতাবের হেফাজতের দায়িত্ব তিনি নেননি। এই হেফাজতের একটি কাজ তিনি সম্পাদন করেন হাফেজে কুরআনদের মাধ্যমে। কুরআন মুখস্থ করার পর প্রতি বছর রমজানে হাফেজগণ তারাবিহ নামাজে এক খতম কুরআন মুখস্ত তেলাওয়াত করেন আর মুসল্লিরা তন্ময় হয়ে সেই তেলাওয়াত শোনেন ইবাদতে নিমগ্ন মনে। এভাবে হাফেজদের বুকের খাজানায় কুরআন মজিদ সুরক্ষিত থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। তারাবিহ নামাজ ও হাফেজদের উসিলায় আসমানি গ্রন্থ কুরআন মজিদের সুন্দর সংরক্ষণ ও চর্চার এই ব্যবস্থা অভিনব।

বর্তমানে পৃথিবীর বুকে মুসলমান ছাড়া ইহুদি খ্রিষ্টানরাই দাবি করতে পারে, তাদের কাছে আসমানি গ্রন্থ আছে। কিন্তু দাউদ (আ.)-কে দেয়া যবুর, মূুসা (আ.)-কে দেয়া তাওরাত ও ঈসা (আ.)-কে দেয়া ইঞ্জিল কিতাবের অরিজিনাল কপি কারো কাছে নাই। ইহুদি খ্রিষ্টানদের কাছে বর্তমানে যা আছে তার নাম বাইবেল। বাইবেলের ওল্ড টেস্টামেন্ট ও নিউ টেস্টামেন্ট এর সম্মিলিত সংকলন এটি। গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে বর্তমান বাইবেল আল্লাহর বাণী নয়, এমনকি যীশু বা ঈসা (আ.) এর বাণীও নয়, বরং যীশুর শিষ্যদের অন্যতম মথি মার্ক লুক যোহন যীশুর বাণী বলে নিজেরা যে ভাষ্য তৈরি করেছেন, সেটির সংকলন বাইবেল। এ কারণে বাইবেলের ভিন্ন ভিন্ন পাঠ পাওয়া যায়, যার একটির সাথে আরেকটির মিল নেই। এ ব্যাপারে ইসলামিক ফাউন্ডেশন হতে প্রকাশিত আমার ‘রাসুলুল্লাহর দরবারে খ্রিষ্টান প্রতিনিধিদল’ নামক বইতে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।

হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থ যে বেদ বেদান্ত তাও ইশ্বরের বাণী নয় এবং তারাও সে দবি করে না। বৌদ্ধদের ত্রিপিটকও ইশ্বরের বাণী নয়। কারণ, বৌদ্ধ ধর্ম তো ইশ্বরের অস্তিত্বেই বিশ্বাসী নয়। ইরানের প্রাচীন পারসিক ধর্মগ্রন্থ আভেস্তার অস্তিত্ব পৃথিবীর বুকে নাই। অভেস্তার ব্যাখ্যাগ্রন্থ যিন্দাভেস্তার অস্তিত্বও জাদুঘরের গবেষণার বিষয়। এক্ষেত্রে জাতি হিসেবে মুসলমানরা বড়ই ভাগ্যবান। কিন্তু রমজানে কুরআনের তেলাওয়াত চর্চা থাকলেও তাদের জীবনে মননে শিক্ষা ব্যবস্থার মূল অঙ্গনে কুরআন নাই। যে কারণে বলতে হয়- আজকের মুসলমানরা বড়ই হতভাগা জাতি।