যানজটে নাকাল রাজধানী

* রাস্তায় রাস্তায় ইফতার * ঈদের আগে সংকট বাড়ার আশঙ্কা

প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

যানজটের কবল থেকে রেহাই মিলছে না রাজধানীর বাসিন্দাদের। মানুষের কাছে যানজট নিত্যদিনের ভোগান্তিতে পরিণত হয়েছে। রমজানে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা অফিস শেষ করে বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে ইফতার ভাগাভাগি করে খাবারের জন্য ছুঁটে চলেন। তবে যানজটের কারণে অনেককেই রাস্তায় ইফতার করতে হচ্ছে। গতকাল রাজধানীর অধিকাংশ সড়কে সকাল থেকে যানজট দেখা গেছে। তবে, ইফতারের সময় তীব্র যানজটের নাকাল হয় রাজধানীবাসী। যানজটের কারণে মানুষ অস্বস্তিতে পড়ে।

ইফতারের আগ-মুহূর্তে পল্টন, প্রেসক্লাব, গুলিস্তান, মতিঝিল, মগবাজার, খিলগাঁও, বাসাবো, কারওয়ান বাজার, মালিবাগ ও রামপুরা সড়কসহ অধিকাংশ রুট যানবাহনের চাপে হিমশিম খেতে হয় ট্রাফিক পুলিশের। সড়কের পাশাপাশি মেট্রোরেলেও যাত্রীদের বাড়তি চাপ ছিল।

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে কর্মরত বেশকিছু কর্মকর্তা যানজটের কবল থেকে রেহাই পেতে ৫টায় বের হোন। কিন্তু এতেও যানজট থেকে রেহাই পাননি তারা। একজন অতিরিক্ত সচিব বলছেন, শুক্র ও শনিবার সাপ্তাহিক ছুটির পর রোববারও জাতীয় শিশু দিবস উপলক্ষ্যে সরকারি ছুটি ছিল। টানা তিনদিন ছুটির পর সরকারি চাকরিজীবীরা অফিসে আসেন। ফলে গতকাল তীব্র যানজটের কবলে পড়ে রাজধানীবাসী। পাড়া-মহল্লার গলি থেকে শুরু করে ভিআইপি সড়কেও গাড়ির জট লেগে থাকতে দেখা যায়।

সরেজমিন রাজধানীর বিভিন? এলাকা ঘুরে দেখা যায়, যানজটের ভয়াবহ চিত্র। যানজট থেকে বাদ যায়নি এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও। বিজয়সরণি এলিভেটেড এক্সেপ্রেসওয়ের কাউন্টারের সামনে থেকে উত্তরা মূল সড়কে নামার মুখে দীর্ঘ সময় যানজটে আটকে থাকতে দেখা যায় গাড়িগুলোকে। কোথাও কোথাও যেন ঘুরছিল না গাড়ির চাকা। বাস বা প্রাইভেটকার চালকদের অবস্থা ছিল আরো শোচনীয়। অনেককে বাস থেকে নেমে গন্তব্যে হেঁটে রওয়ানা করতেও দেখা যায়। মোটরসাইকেল চালকদেরও যানজটে আটকে থাকতে হয়। বেসরকারি চাকরিজীবী আরিফুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলছেন, রমজান এলে যানজটের আতঙ্ক বেড়ে যায়। অফিস শেষে বাসায় গিয়ে ইফতারের ব্যবস্থা করাটা চ্যালেঞ্জ হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, বাসায় গিয়ে পরিবারের সঙ্গে ইফতার করার ইচ্ছা নিয়ে মতিঝিল থেকে বাসে উঠলেও তীব্র যানজটের কারণে মৎস্যভবন মোড়ে পৌঁছাতে অনেক সময় লেগে যায়। বাধ্য রাস্তায় ইফতার করতে হয়।

গুলিস্তান থেকে বিজয় সরণি ফেরা যাত্রী আবদুল হালিমের সঙ্গে বাংলামোটর মোড়ে কথা হলে তিনি বলেন, সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় রাস্তায় গাড়ির চাপ অনেক কম ছিল। কিন্তু বিকালে অফিস ছুটির পর হঠাৎ রাস্তায় যানবাহনের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তিনি বলেন, পল্টন থেকে এক ঘণ্টায় বাংলামোটর পৌঁছতে পেরেছি। কখন যে বাসায় পৌঁছাব জানি না। ৫টার দিকে দেখা গেছে, শাহবাগ থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত গাড়ির চাপে পুরো রাস্তাটি ছিল বন্ধ। সিগন্যাল ছাড়লে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে গাড়ি সামনে এগোতে থাকে।

রামপুরের বাসিন্দা শরিফুল ইসলাম বলেন, অফিস ও স্কুল একই সময় হয়ে গেছে। সকাল আটটা থেকে সাড়ে ৯টার মধ্যে একযোগে প্রাইভেটকার, বাস ও মোটরসাইকেল নামায় সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়ছে। উত্তরা, এয়ারপোর্ট, বনানী, শ্যামলী, কলাবাগন, শেরে বাংলাসহ চারদিকে সকাল থেকেই যানজট বাধে। তবে সকাল সোয়া ১০টার দিকে কিছুটা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও ইফতারির সময়ে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয় বলে জানান ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক-তেজগাঁও বিভাগের শেরে বাংলা নগর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মো. তারেক সেকান্দার। তীব্র যানজটের সঙ্গে আবার একাধিক স্থানে ভিভিআইপি মুভমেন্ট ছিল। ফলে যানজটের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হয়েছে বলে জানান ট্রাফিক-গুলশানের উপ-পুলিশ কমিশনার আব্দুল মোমেন। ঢাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থায় একাধিক মেগা প্রকল্প যুক্ত হলেও বিগত বছরগুলোর মতো এবারও নগরবাসীর পিছু ছাড়েনি রমজান কেন্দ্রিক যানজট। ঈদের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে চলমান যানজট আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

পুরান ঢাকা লালবাগ কেল্লার বাসিন্দা কাজল সরকার গুলশান-১ একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে কাজ করতে আসেন। কিন্তু যানজটের কারণে নির্ধারিত সময়ে সেই এজেন্সির অফিসে পৌঁছাতে পারেননি। কাজল সরকার বলছেন, পুরান ঢাকার বাসিন্দা হিসেবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন?য়নের ছোঁয়া আমরা পাই না। ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যেই বসবাস করছি। বর্তমান সরকার যোগাযোগব্যবস্থা উন?য়নমূলক কাজ করছে; কিন্তু যানজট কমছে না। রমজানে মেট্রো স্টেশনের আশপাশে থাকা মানুষজন একটু সুবিধা পাচ্ছেন। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষকেই আগের মতো ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মেট্রোরেল আরো কয়েক রুটে চালু করা গেলে রাজধানীতে যানজটের সমাধান হবে।

ঢাকার সড়কে যানজটে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কেড়ে নিচ্ছে। যানজট নিরসনে সরকারি-বেসরকারি কোনো উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। বিশেষজ্ঞদের মতে, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, যত্রতত্র পার্কিং, ফুটপাত দখল, গাড়ির তুলনায় রাস্তার স্বল্পতা, রাজধানীকেন্দ্রিক শিল্পকারখানা স্থাপন, ট্রাফিক ব্যবস্থাপকদের অদক্ষতা, দুর্নীতি ও অনিয়ম, পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার অভাব, আইনের বাস্তবায়ন না হওয়া, আইন-আদালত, সচিবালয়, টার্মিনাল, স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব অফিস ঢাকার মূল পয়েন্টগুলোতে স্থাপনের কারণে সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলছেন, যানজট ঢাকার দীর্ঘদিনের সমস্যা এবং এ সমস্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। গত ২০ বছর আগেও ঢাকার যানবাহনের যে গতি ছিল সেই গতি ধীরে ধীরে কমছে। আর যানবাহনের ধীরগতি পুরো নগরে জন্ম দিচ্ছে স্থবিরতার। বিগত দিনগুলোতে যানজট সমস্যা নিরসনে যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সে উদ্যোগগুলো স্মার্ট ছিল কি না তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তিনি বলেন, ঢাকার যানজট নিরসনে ২০০৫ সালে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) প্রণয়ন করে সরকার। ২০০৫ সালের সেই প্ল্যানটাকে যদি বাস্তবায়ন করা যেতো তাহলে ২০২৩ সালে এসে অনেক উন্নতি করার কথা ছিল। অর্থাৎ যানজট বাড়ার কথা ছিলো না। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ঢাকার ফুটপাত নিয়ে এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, মেগাসিটি ঢাকার ট্রান্সপোর্ট সমস্যা সমাধানের কৌশল হিসেবে ঢাকায় হাঁটার যে জায়গা অর্থাৎ ফুটপাতগুলো চলাচলের জন্য আরও সুগম করার প্রয়োজন। বাস সার্ভিসটাকে আরো বেশি জনবান্ধব করা উচিত। এগুলো এসটিপির আওতায় ছিল; কিন্তু বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। ঢাকার যানজটের অন্যতম কারণ হিসেবে অধ্যাপক ড. আদিল অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়ার বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা খোঁড়া ও সড়কের উন?য়নযজ্ঞ যখন অনিয়ন্ত্রিতভাবে হয়, তখন সেটা যানজটের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এগুলো যদি নিয়ন্ত্রিত এবং পরিকল্পিত উপায়ে করা যায়, তাহলে যানজট লাঘব সম্ভব। ড. আদিল বলেন, গত পাঁচণ্ডসাত বছরে ঢাকায় ভয়ংকরভাবে মোটরসাইকেলের সংখ্যা বেড়েছে। যেখানে প্রাইভেট গাড়ির কমানোর কথা, সেখানে প্রতিনিয়তই গাড়ির সংখ্যা বাড়ছে। বিদ্যমান রাস্তাঘাট এত গাড়ির ভার নিতে পারছে না। মেগা সিটি মানেই প্রচুর গণপরিবহন; কিন্তু সেই গণপরিবহনের মাত্রা কিন্তু বাড়ছে না। গণপরিবহন ব্যবস্থা যত আধুনিক করা যাবে, ততই প্রাইভেট গাড়ির প্রতি অনাগ্রহ তৈরি হবে এবং মানুষ গণপরিবহনে যাতায়াত করবে।