মানব সভ্যতার নির্মাতা নবী-রাসুলগণ (আ.)

প্রকাশ : ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

যুগে যুগে মানবজাতির হেদায়তের জন্য আল্লাহপাক অসংখ্য নবী-রাসূল প্রেরণ করেছেন।। তাদের সবার প্রতি ঈমান আনা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। গত কয়েক বছরে ফ্রান্স ডেনমার্ক প্রভৃতি আধুনিক সভ্যতার দাবিদার দেশে মহানবীকে ব্যঙ্গ করে কার্টুন ছাপা হয়। অথচ খ্র্রিষ্টান সমাজ একে গর্হিত মনে করেনি। মুসলিম সমাজের দিকে তাকান। মুসলিম সমাজের কেউ অন্য নবীদের শানে বেয়াদবি করেছেন এমন নজির ইতিহাসে নেই। শুধু তাই নয়, বনি ইসরাঈল বংশের নবী হিসেবে পরিচিত ইবরাহীম, ইয়াকুব, ইউসুফ, ইউনুস, ঈসা, মূসা আলাইহিমুুস সালামের নাম এখনও মুসলিম সমাজের ঘরে ঘরে। মানব সভ্যতা ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের জন্য এর চেয়ে উজ্জ্বল উদাহরণ দ্বিতীয়টি হতে পারে না। মানব সৃষ্টির শুরু থেকে আগত এসব নবী ও রাসূলের সংখ্যা অগণিত। ইমাম গাজ্জালী (রহ.) কিমিয়ায়ে সাআদাত এর ভূমিকায় নবী রাসূলগণের সংখ্যা ১ লাখ ২৪ হাজার বলে উল্লেখ করেছেন। তবে কুরআন মজিদে মাত্র ২৫ জন নবীর নামের উল্লেখ রয়েছে।

১. হজরত আদম আলাইহিস সালাম। মোট ৯টি সূরার ২৫ জায়গায় তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। তিনি সর্বপ্রথম মানুষ ও নবী ছিলেন।

২. হজরত ইদরিস আলাইহিস সালাম। কুরআনের দুটি সূরায় দুইবার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। তিনিই সর্বপ্রথম কলম দ্বারা লিখেছেন। আল্লাহতায়ালা তাকে কুরআনে সিদ্দিক আখ্যা দিয়েছেন এবং তিনি সর্বপ্রথম কাপড় সেলাই করে পরিধান করা শুরু করেন।

৩. হজরত নুহ আলাইহিস সালাম। ২৮টি সূরায় ৪৩ বার উল্লেখ করা হয়েছে তার নাম। তিনি নিজ জাতিকে সাড়ে ৯শ’ বছর দাওয়াত দিয়েছেন। তার ছেলে কেনানকে কুফরির কারণে আল্লাহতায়ালা মহাপ্ল­াবনে ডুবিয়ে মেরেছিলেন।

৪. হজরত হুদ আলাইহিস সালামের নাম তিনটি সূরায় সাতবার উল্লেখিত হয়েছে। তাকে আদ জাতির নিকট প্রেরণ করা হয়েছিল। নূহ (আ.)-এর সম্প্রদায়কে প্লাবন দ্বারা ধ্বংস করার পর সর্বপ্রথম তার সম্প্রদায়ের লোকেরা মূর্তিপূজায় লিপ্ত হয় এবং আল্লাহ তাদেরকে প্রচণ্ড ঝড় দ্বারা ধ্বংস করে দেন।

৫. হজরত সালেহ আলাইহিস সালামের নাম ৪ সূরায় ৯ স্থানে উল্লেখ আছে। তাকে ছামূদ জাতির নিকট প্রেরণ করা হয়। সালেহ (আ.)-এর মুজেযা ছিল উটনি।

৬. হজরত ইবরাহিম আলাইহিস সালামের নাম ২৫ সূরায় ৬৯ বার উল্লেখ হয়েছে। তিনি ইরাকে জন্মগ্রহণ করেন ও ফিলিস্তিনে বসতি স্থাপন করেন। পরে আল্লাহতায়ালার হুকুমে স্ত্রী ও শিশু সন্তান ইসমাঈলকে জনমানবহীন মক্কায় রেখে আসেন। সেই সূত্রে কাবাঘর নির্মিত, হজের প্রবর্তন এবং মক্কা নগবীর গোড়াপত্তন হয়।

৭. হজরত লুত আলাইহিস সালাম। ১৪টি সূরায় ২৭ বার উল্লেখ করা হয়েছে তার নাম। তার স্ত্রী কাফের ছিল। তার সম্প্রদায়ের লোকেরা সমকামিতার মতো পাপে লিপ্ত ছিলো। ফলে আল্লাহতায়ালা তাদের কঠোর শাস্তি প্রদান করেন।

৮. হজরত ইসমাঈল আলাইহিস সালাম। ৮ সূরায় ১২ জায়গায় উল্লেখ হয়েছে এই নবীর নাম। পিতা ইবরাহীম (্আ) শৈশবে তাকেই আল্লাহর নামে কুরবানি দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। পরে তাকে নিয়ে কাবাঘর নির্মাণ করেন।

৯. হজরত ইসহাক আলাইহিস সালাম। কুরআনের ১২টি সূরায় মোট ১৭ বার আলোচিত হয়েছে তার নাম। তিনি ও ইসমাঈল (আ.) সম্পর্কে ভাই ছিলেন।

১০. হজরত ইয়াকুব আলাইহিস সালাম। ১০টি সূরায় ১৬ বার আলোচিত হয়েছে তার নাম। তার আরেক নাম হলো- ইসরাঈল। তার নামানুসারে বনী ইসরাঈল সম্প্রদায়ের নামকরণ করা হয়েছে।

১১. হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম। তিনটি সূরায় ২৭ বার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। সূরা ইউসুফ নামে হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালামের ঘটনা সম্বলিত একটি স্বতন্ত্র সূরা রয়েছে কুরআনে। তিনি নিজে নবী ছিলেন এবং তার পিতা ইয়াকুব (আ.), তার দাদা ইসহাক (আ.) ও পরদাদা ইবরাহীম (আ) নবী ছিলেন।

১২. হজরত শোয়াইব আলাইহিস সালাম। ৪ সূরায় ১১ বার উল্লেখ করা হয়েছে তার নাম। তার সম্প্রদায়ের লোকেরা মাপে বা ওজনে কম দেওয়ার প্রেক্ষিতে আসমানি আজাবে পতিত হয়েছিল।

১৩. হজরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম। চারটি সূরার চার জায়গায় আলোচিত হয়েছে তার নাম। আল্লাহতায়ালা তাকে দীর্ঘকাল কঠিন অসুখ দিয়ে পরীক্ষা করেছিলেন। কিন্তু তিনি ধৈর্যধারণ করে ওই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন।

১৪. হজরত যুলকিফল আলাইহিস সালাম। দুটি সূরায় দুইবার আলোচিত হয়েছে তার নাম।

১৫. হজরত মুসা আলাইহিস সালাম। পবিত্র কুরআনে সবচেয়ে বেশি তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। ৩৪টি সূরায় ১৩৭ বার আলোচিত হয়েছেন তিনি। বনী ইসরাঈলের প্রথম নবী ছিলেন তিনি। জন্মের পর মুসা আলাইহিস সালামকে তার মা বাক্সে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। আল্লাহর কুদরত হিসেবে পরে তিনি জালেম বাদশা ফেরাউনের বাড়িতে লালিত-পালিত হন। নবী মূসাকে আল্লাহতায়ালা অনেকগুলো মুজেযা দিয়েছিলেন। তন্মধ্যে একটি হলো- মূসা (আ.) তার হাতের লাঠি মাটিতে রেখে দিলে তা বিশাল বড় সাপে পরিণত হতো। পরে তিনি সেটা হাতে নিলে আবার লাঠি হয়ে যেত।

১৬. হজরত হারুন আলাইহিস সালাম। ১৩টি সূরায় ২০ বার আলোচিত হয়েছেন তিনি। তিনি নবী মূসা (আ.)-এর ভাই ছিলেন। তিনি ছিলেন বাগ্মী ও মূসা (আ) এর মন্ত্রী।

১৭. হজরত দাউদ আলাইহিস সালাম। ৯টি সূরায় ১৬ বার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। তিনি নিজে রোজগার করে সংসার চালাতেন। তাকে যাবুর কিতাব প্রদান করা হয়েছিল। তিনি একদিন রোজা রাখতেন, আরেকদিন রাখতেন না।

১৮. হজরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম। ৭টি সূরায় ১৭ বার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। তিনি সারা পৃথিবীর বাদশাহ ছিলেন। পশু-পাখীর ভাষা বুঝাসহ মুজেযাস্বরূপ বাতাস নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পেয়েছিলেন তিনি।

১৯. হজরত ইলিয়াস আলাইহিস সালাম। দুটি সূরায় তিনবার উল্লেখ করা হয়েছে তার নাম।

২০. হজরত ইয়াসা আলাইহিস সালাম। দুটি সূরায় দুইবার আলোচনা করা হয়েছে তার প্রসঙ্গ।

২১. হজরত ইউনুস আলাইহিস সালাম। দুটি সূরায় দুইবার উল্লেখ হয়েছে তার নাম। তাকে মাছে গিলে ফেলেছিল। পরে তিনি দোয়া করার পর আল্লাহতায়ালা তাকে মুক্তি দিয়েছেন। তিনি ইরাকের নাইনওয়া এলাকার লোকদের নিকট প্রেরিত হয়েছিলেন। পূর্ববর্তী সমস্ত নবীর অধিকাংশ উম্মত তাদের সঙ্গে কুফরি করলেও ইউনুস (আ.)-এর সম্প্রদায়ের সবাই তার প্রতি ঈমান এনেছিলেন।

২২. হজরত জাকারিয়া আলাইহিস সালাম। চারটি সূরায় সাতবার উল্লেখ হয়েছে পেশায় কাঠুরে এই নবীর নাম।

২৩. হজরত ইয়াইয়া আলাইহিম সালাম। চারটি সূরায় পাঁচবার উল্লেখ হয়েছে তার প্রসঙ্গ। তাকে কিশোর অবস্থাতেই আল্লাহ জ্ঞানী করেছিলেন এবং তাকে তাওরাতের শিক্ষা দিয়েছিলেন।

২৪. হজরত ঈসা আলাইহি সালাম। ১১টি সূরায় ২৫ বার উল্লেখ হয়েছে তার প্রসঙ্গে। তিনি বনী ইসরাইল সম্প্রদায়ের সর্বশেষ নবী। তার আরেক নাম মাসিহ।

২৫. হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। চারটি সূরায় চার জায়গায় তার নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া কুরআনের ২০টি স্থানে তার গুণবাচক নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এটা বিশ্বনবীর সম্মান ও মর্যাদার পরিচয় বহন করে।

নবী রাসূলগণের প্রতি বিশ্বাস ও ভালোবাসার প্রতিদানে আমাদের চরিত্রে তাদের ফয়েয তথা আত্মিক ঝলক পতিত হবে, আমরা আলোকিত হতে পারব। হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.) ও সকল নবী-রাসূলগণের প্রতি নিবেদন করছি হৃদয়নিংড়ানো অসংখ্য দরুদ ও সালাম।