পরকালের ফসল বোনার মৌসুম রমজান

প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ড. মুহাম্মদ ঈসা শাহেদী

মাহে রমজানে মাসব্যাপী একটানা সিয়াম সাধনা আমাদের ঈমানের ভিত্তি মজবুত করে। সাধরণত আমরা ঈমান বলতে বুঝি আল্লাহ ও রাসুল (সা.)-কে বিশ্বাস করা। ঠিক আছে। তবে ঈমানের পরিধি আরো ব্যাপক। এর সঙ্গে অন্তত আরো পাঁচটি বিষয়ের উপর অকাট্য বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। রমজানের শুরু থেকে এর কয়েকটি বিষয় নিয়ে সীমিত পরিসরে আলোচনা করেছি। যেমন আল্লাহ তাআলার পরিচয়। আল্লাহর প্রতি ভয় ও ভালোবাসা, সৃষ্টিলোকের ব্যবস্থাপনায় ফেরেশতাগণের ভূমিকা, আসমানি গ্রন্থসমূহ, সৃষ্টির শুরু থেকে দুনিয়ার বুকে আগত নবী-রাসুল (আ.) প্রসঙ্গ। আরো তিনটি বিষয় বাকি আছে ঈমানের অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে। যেমন কিয়ামত বা মহাপ্রলয়, ভাগ্যলিপি ও মৃত্যুর পর পুনরুত্থান প্রসঙ্গ। আজকে আমরা মত্যুপরবর্তী জীবনের সূচনা নিয়ে কিছু আলোচনার প্রয়াস পাব। পরকালীন জীবন শুরু হয় মৃত্যুর পর থেকে। মৃত্যু প্রতিটি প্রাণির জীবনের পরম ও চরম সত্য। কেউ মৃত্যুবরণ করেছে এ কথা শোনার পর আমাদের মাথায় যে বুঝ আসে তা হলো লোকটির দেহ থেকে প্রাণ পৃথক হয়ে উড়ে গেছে। কোথায় গেছে জানতে হলে বুঝতে হবে আগে কোথায় ছিল, কোত্থেকে মানব দেহে এসেছে তা।

যে পৃথিবীর আলো বাতাসে বিচরণ করছি, এখানে আমরা ছিলাম না। এখানে আসার আগে ৯-১০ মাস একটি প্রকোষ্টে ছিলাম, যার নাম মাতৃগর্ভ। মায়ের গর্ভে আসার আগে যেখানে ছিলাম তার নাম আলমে আরওয়াহ, প্রাণের জগত। একে আল্লাহর সান্নিধ্যের জগত বলাই উত্তম। সেই জগত সূক্ষ্ম, তবে বিশাল। শক্তিশালী মেমোরিতে বহু বইপুস্তক, দলিল-দস্তাবেজ, তথ্য সংরক্ষণ করা যায়। এগুলো ছাপতে হলে বিশাল জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। অথচ এক সিলতে মেমোরিতে এত এত তথ্যভাণ্ডার সংরক্ষিত থাকে, যার একেকটি তথ্য লেখ্যরূপ দিলে কাগজে ধারণ করা কঠিন হয়ে যাবে। এমনই এক ব্যবস্থাপনার ভেতর থেকে রুহসমূহ আল্লাহর নির্ধারিত দুনিয়ার বুকে আত্মপ্রকাশ করে।

মাতৃগর্ভে শুক্রকিট সঞ্চারিত হওয়ার পর সময় অতিক্রম হতে থাকে। এরিমধ্যে শুক্রটি ভ্রুণে পরিণত হয় এবং কয়েকটি স্তর পার হয়ে মানব শিশুর অবয়ব ধারণ করে। চার মাস পূর্ণ হলে প্রাণের সঞ্চার হয় সেই দেহে। মওলানা রূমী বলেন, সৃষ্টি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত ফেরেশতা মাতৃগর্ভে শিশুর কানে কানে কথা বলে। বলে যে, তুমি একটি সংকীর্ণ জায়গায় মাতৃগর্ভে অবস্থান করছ। এটি তোমার চিরন্তন নিবাস নয়। শিগগিরই তোমাকে এই জগত ছেড়ে এমন এক জগতে চলে যেতে হবে, যার নাম দুনিয়া। সেই দুনিয়া তোমার এখনকার দুনিয়া মাতৃগর্ভ থেকে কতখানি বড় বিশাল সীমাহীন ও কল্পনাতীত তা বলে শেষ করা যাবে না। সেখানে তোমাকে নিজের পায়ে হাঁটতে হবে, দৌঁড়াতে হবে, দ্রুতগামী যানবাহনে করে দূরদূরান্ত পাড়ি দিয়ে সফর করতে হবে। সেখানে একাকীত্ব জীবনের সুযোগ নেই। হাঁটবাজার লোকালয় পাহাড়-পর্বত, গরু-ছাগল, খাল-নদী সাগর-মহাসাগর আছে। মানব শিশু তখন বলে, আমি মায়ের যে উদরে আছি তার চেয়ে বড় কোনো জগত হতে পারে, আমি বিশ্বাস করি না। দুনিয়ার জগত মাতৃগর্ভের চাইতে কোটি কোটিগুণ বড় হবে- এ ধারণা অবান্তর। আমি তো মায়ের গর্ভ থেকে খাবার সাপ্লাই পাচ্ছি, কত সুখে আছি। আবার গরু মহিষ ট্রাক্টর দিয়ে চাষাবাদের যে বয়ান দিচ্ছ তা বিশ্বাস করা যায় না। কিন্তু ৯-১০ মাস পরে বাধ্য হয়ে যখন মানব শিশুকে মাটির দুনিয়ায় নেমে আসতে হয় তখন সে বুঝে, ফেরেশতার কথাই সঠিক ছিল। এখানে আলো আছে, বাতাস আছে, দাদা-নানি, ঘর-সংসার দেশের পর দেশ, মহাদেশ আছে যা মাতৃগর্ভের তুলনায় শত কোটি কোটিগুণ বড়, বিশাল ও কল্পনার বাইরে।

পৃথিবীতে আসার পর আল্লাহর পথে আহ্বানকারী নবী-রাসুল আউলিয়া ও ওলামাগণ যখন বলেন, এই জগত তোমাদের স্থায়ী বাসস্থান নয়, এই জগত ছেড়ে তোমাদের যেতে হবে এমন এক জগতে যার আয়তন পৃথিবীর তুলনায় কত শত কোটি গুণ বেশি কেউ তা হিসেব করে বলতে পারবে না। পরকালে একজন সাধারণ বেহেশতীকে যে পরিমাণ ভূমি বরাদ্দ দেয়া হবে তার একটি গাছের ছায়ায় ৭০ বছর ঘোড়া দৌঁড়িয়েও তা অতিক্রম করতে পারবে না। নাফরমানরা ধার্মিকদের এ বয়ান বিশ্বাস করতে নারাজ; তবে ধার্মিক লোকেরা ধর্মের বাণী মনে প্রাণে বিশ্বাস করে এবং সংযমী জীবনযাপন করে।

মধ্যপ্রাচ্যে পেট্রোডলারের সয়লাব শুরু হওয়ার পর আমাদের দেশের যুবকরা সোনার হরিণের আশায় বাপের দিনের জমি-জিরাত বিক্রি করে বিদেশে পাড়ি জমায়। কিন্তু বিদেশ ক্ষণিকের আবাস। স্থায়ী থাকতে পারবে না। এনওসি’র মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে দেশে ফিরে আসতেই হবে। যারা বুদ্ধিমান বিদেশে কামানো অর্থ দেশে পাঠিয়ে দেয়। আর যারা জীবনের পরিণতি সম্পর্কে উদাসীন, পরিবারের প্রতি দায়িত্বহীন তারা রোজগার করা টাকা-পয়সা বিদেশের মাটিতেই উজাড় করে ফেলে। ফলে এনওসি’র মেয়াদ শেষে যখন দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয় তখন সম্পূর্ণ কপর্দকশূন্য। অথচ যারা পরিণতির কথা ভেবে বিদেশে উপার্জিত টাকা-পয়সা ব্যাংক মারফত দেশে পাঠিয়েছে তারা সুখি জীবনের অধিকারী হয়।

মূলত আমরা বেহেশতের অধিবাসী ছিলাম। দুনিয়াতে এসেছি রুটিরুজি কামাই করার জন্য। হাদিস শরিফে এ কথাই বলা হয়েছে, ‘দুনিয়া হলো আখেরাতের শষ্যখেত।’ এখানে যে ফসল ফলাবে, যাকিছু উপার্জন করবে ও ‘ব্যাংক অব আখেরাত’-এ জমা রাখবে ওপারে গিয়ে তা নগদে তুলতে পারবে। কুরআন মজিদে বলা হয়েছে- ‘যিনি সৃষ্টি করেছেন মৃত্যু ও জীবন, তোমাদের পরীক্ষা করার জন্য, তোমাদের মধ্যে কর্মে কে উত্তম প্রমাণ করার জন্য। তিনি পরাক্রমশালী, ক্ষমাশীল।’ সুরা মুলক, আয়াত-২)

আয়াতে মৃত্যুকে জীবনের আগে উল্লেখ করা হয়েছে। তার মানে জীবনের চেয়েও পরম সত্য হলো মরণ। মাহে রমজান এই মরণের প্রস্তুতি, পরকালের ফসল বোনার মৌসুম।