জলদস্যুদের কবলে বাংলাদেশি নাবিকরা

পানির স্তর থেকে ডেকের দূরত্ব কম থাকায় দ্রুত উঠে পড়ে দস্যুরা

প্রকাশ : ২০ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  তামীম রহমান, চট্টগ্রাম

ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে পড়া এমভি আবদুল্লাহ জাহাজটি এখনো উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তাদের উদ্ধারে তৎপরতা চলছে বলে জানিয়েছে জাহাজের মালিকপক্ষ।

জানা যায়, জাহাজটি ধারণ ক্ষমতার সমান (ফুল লোডেড) পণ্য নিয়ে চলছিল। এতে সাগরে পানির স্তর থেকে ডেকের দূরত্ব একেবারেই কমে যায়। জাহাজের গতিও ছিল কম। ছিল না আর্মস গার্ড তথা নিরাপত্তারক্ষী। পানির স্তর থেকে ডেকের দূরত্ব কমে যাওয়ায় জলদস্যুরা ক্ষিপ্ত গতির নৌযান থেকে দ্রুত ডেকে উঠে যায় ডেকে। এদিকে গত রোববার (১৭ মার্চ) পর্যন্ত ঘটনার ৬ দিনে এসেও দস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি। জাহাজটির মালিক পক্ষ যোগাযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। সবমিলে জিম্মি নাবিকদের পরিবারে উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। এদিকে নাবিকদের পরিবারে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ক্রমেই বাড়ছে। তারা প্রতিদিন খবর নিচ্ছেন জাহাজ মালিকের প্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ে। সূত্র জানায়, জিম্মি ২৩ নাবিকের ১১ জনের বাড়ি চট্টগ্রামে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার উত্তর বন্দরের বাসিন্দা মোহাম্মদ সাজ্জাদ হোসেন ও বৈরাগ সেন্টার এলাকার বাসিন্দা শামসুদ্দিন শিমুল। জিম্মি হওয়ার খবর আসার পর থেকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় কাটছে তাদের স্বজনদের। গত রোববার তারা তাদের স্বজনদের ফিরে পাওয়ার আকুতি জানান। সাজ্জাদ হোসেনের পিতা গাজু মিয়া বলেন, আল্লাহর কাছে দোয়া করছি আমার ছেলে যেন ফিরে আসে। আমার পাঁচ ছেলের মধ্যে সাজ্জাদ ৩ নম্বর। এই ছেলে আমার কোনো কিছুতে কমতি রাখে নাই। প্রতিদিন ফোনে আমার খোঁজখবর নিত। আজ এক সপ্তাহ আমার ছেলের কোনো খবর নেই। আমাদের একেকটা দিন কাটছে বছরের মতো। অপর জিম্মি নাবিক শামসুদ্দিন শিমুলের স্ত্রী ফারজানা সুলতানা জানান, আমার তিন মেয়ে। মেয়েরা বাবার জন্য খুব কান্না করছে। আমার দুই মেয়ে স্কুলে পড়ে, ছোট মেয়ের বয়স এখন ১৪ মাস। ফারজানা সুলতানা আরো বলেন, আমার স্বামীর অনেক ধার ছিল, তিনি বলেছিলেন আমি জাহাজ থেকে এখন আসব না। জাহাজটি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগ মুহূর্তে ক্রুদের ধারণ করা কয়েক সেকেন্ডের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, জাহাজটিতে দ্রুত উঠে যাচ্ছে দস্যুদলের এক সদস্য। পেছনে ভারী অস্ত্র থাকলেও ডেকে দ্রুত সময়ে পৌঁছাতে খুব বেশি বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। একই সময়ের মধ্যে এমভি আবদুল্লাহর সামনে-পেছনে আরো কয়েকটি জাহাজ চলাচল করলেও জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার সুযোগ পায়নি। কারণ ওই জাহাজগুলো দ্রুত গতিতে চলছিল। জলদস্যুরা সামনে-পেছনের জাহাজগুলো এড়িয়ে স্থানীয় সময় সকাল ১০টায় দিনের আলোয় টার্গেট করে এমভি আবদুল্লাহকে। ধারণা করা হচ্ছে, আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক পোর্ট থেকেই এমভি আবদুল্লাহ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছে জলদস্যুরা। এরপর তারা ভারত মহাসাগরে জাহাজটির চলাচল পথের আশপাশে অবস্থান নেয়। ১২ মার্চ সমুদ্রের নির্ধারিত এলাকায় পৌঁছার পরপরই দস্যুদলের সদস্যরা নিয়ন্ত্রণ নেয় জাহাজের। ছিনতাইকৃত জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির স্টিল রি-রোলিং মিলস (কেএসআরএম) গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিং পরিচালনা করছে। এই প্রতিষ্ঠানটির অধীনে মোট ২৩টি জাহাজের মধ্যে সর্বশেষ যুক্ত করা জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ। ২০১৬ সালে তৈরি এই বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। ড্রাফট ১১ মিটারের কিছু বেশি। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেওয়ার আগে এটির নাম ছিল গোল্ডেন হক। মালিকানা পরিবর্তনের পর জাহাজের নামও পরিবর্তন করা হয়। পরে নতুন নাম হয় এমভি আবদুল্লাহ। বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন জানান, জাহাজটিতে ৫৫ হাজার টন কয়লা ছিল। ধারণক্ষমতা অনুযায়ী তখন এটি ছিল ফুল লোডেড অবস্থায়। ফলে পণ্যভর্তি জাহাজটির পানির লেভেল থেকে ডেকের দূরত্ব কমে যায়। সংগঠনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনামুল হক জানান, জাহাজটি ফুল লোডেড থাকার কারণে ২৩ ফুট পানির নিচে ছিল। জাহাজটির ড্রাফটই ছিল ১১ মিটারের বেশি। ফুল লোডেড থাকায় জাহাজ বেশি পরিমাণে পানির নিচের দিকে চলে যায়। এতে পানির স্তর থেকে ডেকের দূরত্ব ১০ থেকে ১২ ফুটে চলে আসে। তাতে জলদস্যুদের ছোট নৌযান থেকে এমভি আবদুল্লাহতে দ্রুত উঠে যেতে সুবিধা হয়। তিনি আরো বলেন, নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার আগে জাহাজ সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা দস্যুদের পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। তারা জেনেশুনে অনেকটা আগে থেকে রেকি করেই জাহাজ নিজেদের কব্জায় নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।

এদিকে, বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার জলদস্যুরা নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর এক সপ্তাহ পার হয়েছে। জলদস্যুদের সময়ক্ষেপণের কারণ খুঁজছে মালিকপক্ষ। কী কারণে জলদস্যুরা এখনো যোগাযোগ করেনি বা সময়ক্ষেপণ করছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। এতে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। প্রশ্ন উঠেছে- জলদস্যুরা মুক্তিপণ কি বেশি চাইবে, নাকি মুক্তিপণের বাইরে অন্য কোনো দাবি-দাওয়া আছে। জাহাজ মালিকের কাছ থেকে দাবি আদায়ে নিজেদের মধ্যে সমন্বয় নেই বলেও মনে করছেন অনেকে। সময় যত গড়াচ্ছে, ততই নানা প্রশ্ন আসছে সামনে। করণীয় নির্ধারণে চিন্তায় পড়েছে খোদ জাহাজটির মালিক কেএসআরএম গ্রুপ। তারা জলদস্যুদের সময় ক্ষেপণের কারণও খুঁজে দেখছে। তবে মালিক পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বিষয়টির শান্তিপূর্ণ সমাধানে কাজ করছেন তারা। তারা চান জাহাজটির ২৩ নাবিকের অক্ষত অবস্থায় মুক্তি। নৌ বাণিজ্য অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির আহমদ গত সোমবার জানান, হুট করে দ্রুত সময়ে জলদস্যুরা সাধারণত দাবি-দাওয়া জানাবে না। তাদের লিডার আছে। তাদের বিভিন্ন টিম আছে। কেউ খাদ্য সরবরাহ করবে। কেউ পাহারা দেবে। আর কেউ আর্থিক বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। তাদের মধ্যেও দাবি-দাওয়া নিয়ে সমঝোতার একটি বিষয় আছে। এর পরই হয়তো তারা জাহাজটির মালিক পক্ষের কাছে দাবি জানাতে পারে। কেএসআরএম কর্তৃপক্ষের একটি জাহাজ আগেও নিয়ন্ত্রণে নিয়েছিল জলদস্যুরা। ওই জাহাজের সব নাবিককে অক্ষত অবস্থায় ছাড়িয়ে আনার অভিজ্ঞতা মালিক পক্ষের আছে। তাই এ ক্ষেত্রে খুব বেশি উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কিছু নেই।

খাবার সংকটে পড়তে পারেন নাবিকরা : এমভি আবদুল্লাহ জাহাজের নাবিক-ক্রু ২৩ জন। মোজাম্বিকের বন্দর থেকে ৫৫ হাজার মেট্রিক টন কয়লাবোঝাই করে রওনা দেওয়ার আগে খাবার নেওয়া হয় ২৫ দিনের। ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায় জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ে। ওই দিনই ছোট নৌযান থেকে জাহাজে উঠে পড়ে ৫০ জলদস্যু। জাহাজে প্রথম দিনেই নাবিক আর জলদস্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল ৭৩ জনে। সেদিন থেকে সোমালিয়ার গ্যারাকাড উপকূলে নেওয়ার আগ পর্যন্ত নাবিক ও জলদস্যু মিলে ৭৩ জনের খাবারে ব্যবস্থা করতে হয় জাহাজের শেফদের। নাবিকদের সঙ্গে জলদস্যুরাও দিব্যি খাবার খেয়ে আসছে প্রতিদিন। এতে টান পড়ে জাহাজে মজুত খাদ্যের। এমভি আদুল্লাহ সোমালিয়ার গ্যারাকাড উপকূলে পৌঁছার পর জলদস্যুদের প্রথম দলটি জাহাজ থেকে নেমে পড়ে। এরপর নতুন আরেকটি দল ওঠে জাহাজে। এদের সংখ্যা ৪০ থেকে ৪৫ হবে বলে মালিকপক্ষকে জানিয়েছেন নাবিকরা। যদি ৪৫ জন জলদস্যুও জাহাজে থাকে, তা হলে নাবিকসহ বর্তমানে ৬৮ জনের খাবারের ব্যবস্থা করতে হচ্ছে। প্রতিদিন তিনবেলা খাবারের ব্যবস্থা করতে গিয়ে মজুত খাদ্য আর এক সপ্তাহ চলবে কি না সন্দেহ। তবে কেএসআরএমের মিডিয়া অ্যাডভাইজর মিজানুল ইসলাম বলেন, খাবার নিয়ে আমরা খুব বেশি চিন্তিত নই। আমরা জলদস্যুদের পক্ষ থেকে কী দাবি-দাওয়া আসে, তার অপেক্ষায় আছি। এর আগে যে জাহাজটি সোমালিয়ার জলদস্যুরা হাইজ্যাক করেছিল, সেখানে তারা নিজেরাই খাবারের ব্যবস্থা করে দেয়। তাই এবারও তারাই তা করবে বলে মনে করছি। তবে বিশুদ্ধ পানির সংকট হলে একটা সমস্যা হতে পারে। সেই ব্যবস্থাও কোনোভাবে ম্যানেজ হবে, তাতে সন্দেহ নেই।