ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

কাফেরের পরকালযাত্রার দৃশ্যপট

কাফেরের পরকালযাত্রার দৃশ্যপট

মানুষের মৃত্যুর পরবর্তী সময়টি কেমন হবে, তার রুহ কীভাবে কবজ করা হবে মওলানা রূমী কয়েকটি রূপক উদাহরণ দিয়ে তার হাকিকত ব্যক্ত করেছেন। কাফেরদের মৃত্যু পরবর্তী দৃশ্যপট রচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, মানব শিশু জন্ম নেয়ার সময় আত্মীয়-স্বজন আশা নিরাশার দোলাচালে দুলতে থাকে। তাদের আশা একটি সুন্দর ছেলে সন্তান জন্ম নেবে। কিন্তু জন্মের পর দেখা গেল, মানব শিশু নয়, এক অদ্ভুত জানোয়ারের শাবক প্রসব করেছে। তখন আত্মীয়স্বজনের মনের অবস্থা কিরূপ হবে। আল্লাহর অবাধ্য কাফেরদের ইহকাল ছেড়ে পরকালে যাবার সময়ও অপেক্ষমান ফেরেশতাদের মনের অবস্থা ও ব্যবহার তেমনই হবে। কুরআন মজিদে এ মর্মে বলা হয়েছে- ‘ফেরেশতারা যখন উহাদের মুখমণ্ডলে ও পৃষ্ঠদেশে আঘাত করতে করতে প্রাণ হরণ করবে, তখন তাদের দশা কেমন হবে।’ (সুরা মুহাম্মদ : ২৭)

রাসুলুল্লাহ (সা) নিজে এই দৃশ্যপটটি এভাবে ব্যক্ত করেছেন, ‘একজন কাফেরের দুনিয়া থেকে বিদায় এবং পরকালের পথে যাত্রার সময় যখন ঘনিয়ে আসে, তখন তার কাছে অসুন্দর চেহারার ফেরেশতারা আগমন করেন। তাদের সঙ্গে থাকে চুল দ্বারা তৈরি কতক কষ্টদায়ক কাপড়ের বস্তা। তার চোখ বুজে যাওয়া পর্যন্ত ফেরেশতারা তার কাছে বসে থাকেন। এরপর আসেন মালাকুল মউত (মৃত্যুর ফেরেশতা), তিনি এসে তার মাথার কাছে বসেন এবং বলেন, হে অপবিত্র আত্মা! আল্লাহর রাগ ও অসন্তুষ্টির দিকে বেরিয়ে এসো।

তখন তার দেহে প্রচণ্ড কম্পন শুরু হয়। তার আত্মা টেনে বের করা হয়, যেভাবে ভেজা রেশমের ভেতর থেকে লোহার ব্রাশ বের করা হয়।

আজরাইল (আ) তার রুহ বের করার পরপর অন্য ফেরেশতারা সেই আত্মা মুহূর্তের জন্য হাতছাড়া করেন না। বরং নোংরা বস্তায় ভরে নেন। এর থেকে মৃত পচা লাশের দুর্গন্ধ বের হতে থাকে, যা (কখনো কখনো) দুনিয়ার মানুষও অনুভব করে।

ফেরেশতারা একে নিয়ে ঊর্ধ্বারোহণ করেন। তারা যখনই ফেরেশতাদের কোনো দলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করেন, সেই ফেরেশতারা জিজ্ঞেস করেন, এই নাপাক আত্মা কার? তখন তারা দুনিয়ায় তার কুৎসিত নাম উল্লেখ করে বলেন, অমুকের ছেলে অমুকের।

এভাবে তারা প্রথম আসমানে পৌঁছেন। তার জন্য আসমানের দরজা খোলার আহ্বান করা হয়; কিন্তু তার জন্য দরজা খোলা হয় না। বর্ণনার এ পর্যায়ে রাসুল (সা.) একটি আয়াত তিলাওয়াত করেন, যার অর্থ হলো,

‘যারা আমার নিদর্শনকে অস্বীকার এবং সে সম্বন্ধে অহংকার করে, তাদের জন্য আসমানের দরজাসমূহ খোলা হবে না এবং তারা জান্নাতেও প্রবেশ করতে না, যতক্ষণ না সুচের ছিদ্রপথে উট প্রবেশ করবে। (অর্থাৎ কক্ষণো জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। ) এইরূপে আমি অপরাধীদের প্রতিফল দেব।’ (সূরা আরাফ, আয়াত-৪০)

আল্লাহ তখন বলবেন-তার আমলনামা জমিনের সর্বনি¤েœ অবস্থিত সিজ্জিন-এ রেখে দাও। তারপর তার রুহ ছুড়ে ফেলা হয়। এরপর রাসুল (সা.) কুরআনের আয়াত পাঠ করেন, যার অর্থ হলো-

‘...এবং যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে শরিক করল, সে যেন আকাশ থেকে ছিটকে পড়ল, অতঃপর মৃতভোজী পাখি তাকে ছোঁ মেরে নিয়ে গেল অথবা বাতাস তাকে উড়িয়ে নিয়ে কোনো দূরবর্তী স্থানে নিক্ষেপ করল।’ (সুরা হজ : আয়াত-৩১)

তারপর তার রুহ দেহে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। তার কাছে দুজন ফেরেশতা আসেন। তারা তাকে বসান। অতপর তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমার রব কে? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। তারা জিজ্ঞেস করেন, তোমার ধর্ম কী? সে বলে, হায় আফসোস! আমি জানি না। তারা বলেন, তোমাদের কাছে পাঠানো এই লোকটি কে? সে বলে, হায় আফসোস! আমি চিনি না।

তখন আসমান থেকে একজন ঘোষক বলেন, ‘সে মিথ্যা বলেছে। তার জন্য জাহান্নামের বিছানা বিছিয়ে দাও। তাকে জাহান্নামের পোষাক পরিয়ে দাও এবং জাহান্নামের দিকে তার জন্য একটি দরজা খুলে দাও।’

ফলে তার কাছে জাহান্নামের উত্তাপ ও বিষাক্ত লু হাওয়া আসতে থাকে। তার কবর এতটা সংকীর্ণ করে দেওয়া হয় যে, তার এক পাঁজরের হাড়গুলো অন্য পাঁজরে ঢুকে যায়। অতপর তার কাছে কুৎসিত চেহারার, দূষিত পোশাকের ও দুর্গন্ধযুক্ত এক লোক এসে বলে, ‘দুঃসংবাদ গ্রহণ করো। যে দিনের খারাপ পরিণতি সম্পর্কে তোমাকে বলা হয়েছিল তা আজ উপভোগ করো। সে এই বিদঘুটে চেহারার লোকটিকে জিজ্ঞেস করে, তুমি কে? লোকটি বলে, আমি তোমার অসৎকর্ম। এরপর সে বলে, ‘হে রব, আপনি যেন কিয়ামত সংঘটিত না করেন।’ (মুসনাদে আহমদ)

আমাদের কৌতূহল জাগতে পারে সামগ্রিকভাবে মৃত ব্যক্তিরা কবরে কোন অবস্থায় থাকে। যারা দুনিয়াতে আছে তারা কবরবাসীদের কোনো সাহায্য করতে পারে কি না। রাসুল (সা.) এর একটি হাদিসে এই প্রশ্নের জবাব আছে।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা) বলেছেন : নিশ্চয়ই মৃত ব্যক্তি হলো পানিতে পড়ে যাওয়া সাহায্যপ্রার্থী ব্যক্তির ন্যায়, সে তার বাবা, মা, ভাই বন্ধুর দোয়া পৌঁছার অপেক্ষায় থাকে। যখন তার কাছে তা পৌঁছে তখন তা তার কাছে সারা দুনিয়া ও এর বস্তুসামগ্রি অপেক্ষাও প্রিয়তর হয় এবং আল্লাহ তা’আলা কবরবাসীদের জমিনবাসীদের দোয়ার কারণে পর্বত সমতুল রহমত পৌঁছান আর জিন্দাদের পক্ষ হতে মুর্দাদের জন্য হাদিয়া হলো তাদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করা। (বায়হাকী শুআবুল ঈমান এর বরাতে মিশকাত, হাদিস নং-২২৪৬)

কবরের ভয়াবহতা হতে পরিত্রাণের জন্য আমাদের নিজেদের করণীয় কী আছে। এই সম্পর্কেও আল্লাহর রাসূলের হাদিসে পথের দিশা আছে।

হযরত আমর ইবনে আওছী (রা.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, হুজুর পাক (সা.) এক ব্যক্তিকে উপদেশ স্বরূপ বললেন, পাঁচটি বস্তু আসার পূর্বে পাঁচটি কাজ করাকে বড় নেয়ামত মনে কর। ১) তোমার বার্ধক্য আসার পূর্বে যৌবনকে, ২) রোগে আক্রান্ত হওয়ার পূর্বে সুস্থতাকে, ৩) অভাবগ্রস্ত হওয়ার পূর্বে অভাবমুক্ত থাকা অবস্থাকে। ৪) ব্যস্ততা শুরু হওয়ার পূর্বে অবসর ও অবকাশকে, আর ৫) মৃত্যু আসার পূর্বে জীবনকালকে। (তিরমিজির বরাতে মিশকাত, হাদিস নং-৪৯৪৭)

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত